ক্রিকেট বিশ্বে আফগানিস্তান এখন বড় শক্তি
প্রকাশ | ২৪ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
আমিনুল ইসলাম লিটন
যে দেশের নাগরিকরা এক সময় ঠিকমতো খেতেও পারত না। দেশটায় ছিল না কোনো ঘাসের সবুজ মাঠ, আর টার্ফের উইকেট যে কী সেটা অজানাই ছিল তাদের। সেই আফগানিস্তান থেকে উঠে আসা ক্রিকেট দল এখন বিশ্ব ক্রিকেটে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করছে। বড় বড় দলকে হারিয়ে দিয়ে নিজেদের অবস্থানকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। টি২০ বিশ্বকাপে চমক দেখিয়েছে রশিদ খানরা।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আফগানিস্তানের অনেক আগেই পদচারণা শুরু বাংলাদেশের। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে নিজেদের উত্থানের ঘোষণা দেওয়া বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলে। সেই আসরে স্কটল্যান্ড ও পাকিস্তানকে হারিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও দেখিয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাসও পেয়ে যায় টাইগাররা। কিন্তু এরপর থেকে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্যের খতিয়ান যৎসামান্য। ওয়ানডে বিশ্বকাপে একবার কোয়ার্টার ফাইনাল ও সুপার এইট এবং টি২০ বিশ্বকাপে দুইবার সুপার এইটে খেলাটাই সর্বোচ্চ সাফল্য। অনেক পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পথচলা শুরু করা যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান দ্রম্নতই বাংলাদেশকে পেছনে ফেলছে নৈপুণ্যে।
২০০১ সালে আইসিসির অধিভুক্ত হয় আফগানিস্তান। প্রতিবেশী দেশগুলোর উদ্বাস্তু শিবিরে বেড়ে ওঠা খেলোয়াড়দের হাত ধরেই হাঁটি-হাঁটি পা করে এগিয়েছে তাদের ক্রিকেট। আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ও উন্নত জীবনমানের ধারে কাছেও কিছু ছিল না আফগান ক্রিকেটের বিকাশকালে। এরপরও আত্মবিশ্বাস ও খেলার প্রতি তীব্র আত্মনিবেদন তাদের এগিয়ে নিয়েছে।
২০১০ সালে আইসিসি ওয়ার্ল্ড টি২০ কোয়ালিফায়ার জিতে ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো টি২০ বিশ্বকাপে সুযোগ পায় আফগানিস্তান। আর এর মাত্র ১৪ বছর পরই প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে জায়গা করে নিয়েছে তারা। অথচ বাংলাদেশ ২০০৭ সালে প্রথম টি২০ বিশ্বকাপেই সুপার এইটে জায়গা করে নিলেও এরপর আর সামনে এগুতেই পারেনি। ২০২৪ সালে এসে দ্বিতীয়বারের মতো সুপার এইটে জায়গা করে নিলেও এই রাউন্ডে জয়ের মুখ দেখেনি। আফগানদের বিপক্ষে আগে কখনো বিশ্বকাপে না হারলেও এবার সেই অভিজ্ঞতাও হয়েছে বাংলাদেশের।
বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানের বিপক্ষে হারের মুখ দেখে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে বৃষ্টি আইনে ৮ রানে হারিয়ে দেশটির ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আইসিসির কোনো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয়। অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে পেছনে ফেলে সেমিফাইনালে ভারতের সঙ্গী হয়েছে আফগানিস্তান। সুপার এইট থেকে বাংলাদেশের সঙ্গী হয়ে বিদায় নিয়েছে টি২০'র সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ও ওয়ানডের বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া।
আফগানিস্তানের ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান ভাবনা কেবলই দেশের ক্রিকেটের উন্নতির জন্য কাজ করে যাওয়া। সব ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সেটাই করে যাচ্ছে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড। ফলাফলটা দৃশ্যমান, রশিদ খানদের ফলাফলে। প্রতিনিয়ত বড় দলের সঙ্গে ম্যাচ জয়ের পাশাপাশি বিশ্বের নামিদামি লিগে খেলছেন দলটির একাধিক তারকা।
সর্বশেষ টি২০ বিশ্বকাপে উগান্ডার বিপক্ষে ১২৫ রানের বিশাল জয় দিয়ে শুরু করে। এরপর ৮ জুন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয় তুলে নেয় আফগানরা। কিউইদের ৭৫ রানে গুটিয়ে দিয়ে ৮৪ রানের জয় পায় তারা। ১৪ জুন তৃতীয় ম্যাচে পাপুয়া নিউগিনিকে ৭ উইকেটে হারিয়ে সুপার এইট নিশ্চিত করে রশিদ খানরা। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডের বিদায় ঘণ্টা বাজে।
আফগানিস্তানের প্রদেশ সংখ্যা ৩৪টি। এর মধ্যে ৩২টি প্রদেশে নিয়মিত প্রাদেশিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়ে থাকে। দুটি লিস্ট এ টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়, যার একটিতে ২০টি এবং অন্যটিতে ১২টি প্রাদেশিক দল অংশ নেয়।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলা আফগানিস্তানের ২৪ জন ক্রিকেটার থাকেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সেখানের বিভিন্ন টি২০ লিগেও খেলেন তারা। গত ২৩ জুন টি২০ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো আফগানিস্তান দলের ১০ জন খেলে বেড়াচ্ছেন বিশ্বের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে।
২০০৮ সালে ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট লিগ ডিভিশন ফাইভ জয়ী আফগানিস্তান খুব দ্রম্নততম সময় একের পর এক সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। ২০০৯ সালে প্রথমবার আন্তর্জাতিক ওয়ানডে ক্রিকেটে পা রাখা দলটির ২০১০ টি২০ বিশ্বকাপ দিয়ে অভিষেক হয় বিশ্ব আসরে। ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলতে না পারলেও ওয়ানডে মর্যাদা পেয়ে যায় ততদিনে। মোহাম্মদ নবির নেতৃত্বে ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ দিয়ে এক দিনের বিশ্বকাপে অভিষেক হয় আফগানিস্তানের। এরপর ২০১৭ সালে পায় টেস্ট মর্যাদা।
২০১৯ সালে একবার বাংলাদেশে সিরিজ খেলতে এসে রশিদ খান বলেন, 'আফগানিস্তানের দ্রম্নত উন্নতির কারণ হলো আমাদের সহজাত প্রতিভা এবং এটিই আমাদের আরও বেশি বিশেষ করে তুলছে। বাচ্চা বয়সে ক্রিকেট শুরুর সময় মৌলিক ব্যাপারগুলোই শিখতে ইচ্ছে করে। এরপর আস্তে আস্তে উন্নতি করতে করতে ভালো ক্রিকেটার হয়ে উঠতে হয়। কিন্তু কম বয়সেই যদি বোঝা যায় যে, সহজাত প্রতিভা ও স্কিল আছে এবং সেসব নিয়ে আরও কাজ করা যায়, তাহলে সেরা হয়ে ওঠা যায়। দেশে আমাদের খুব বেশি সুযোগ-সুবিধা নেই। অনেক তরুণ ক্রিকেটার বের করে আনার মতো ঘরোয়া ক্রিকেটও আমাদের নেই। তবে ভালো ব্যাপার হলো, আমাদের অনেক সহজাত প্রতিভাবান ক্রিকেটার আছে। এ কারণেই আফগানিস্তান এই পর্যায়ে উঠে এসেছে।'
তিনি আরও বলেন, '১০-১৫ বছর আগে আমাদের সিনিয়ররা যখন ক্রিকেট শুরু করেছেন, সেই সময় আমাদের সুযোগ-সুবিধা ছিল শূন্য। ছিল না কোনো মাঠও। গোটা আফগানিস্তানে কোনো ঘাসের মাঠ ছিল না। সারাদেশে কোনো টার্ফ উইকেট ছিল না। তারা সিমেন্টের উইকেটে খেলতেন। তারা ওই সময় অনেক লড়াই করেছেন। কিন্তু তাদের ভাবনায় ছিল আফগানিস্তানের ক্রিকেটকে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়া। তাদের সেই দক্ষতা ও প্রতিভা ছিল। টেনিস বলের ক্রিকেট থেকে ক্রিকেটারদের এনে তারা সরাসরি এই পর্যায়ে খেলিয়েছেন। তবে তাদের মানসিকতা এ রকম ছিল যে, দলের জন্য সেরাটা দিতে তারা সক্ষম। তাদের সেই ধৈর্য ছিল। আমার মতে, সেটিই আফগানিস্তানকে আরও বিশেষ করে তুলেছে এ পর্যায়ে। এখন আমরা সেরা সুযোগ-সুবিধা ও কোচসহ সবকিছু পাই। নিজেদের দেখভাল করতে পারি ও সেরা ক্রিকেটার হয়ে উঠতে পারি।'
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট হিলারি ক্লিনটন গোল্ডম্যান স্যাকসের বক্তৃতায় আফগান ক্রিকেট দলের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, 'যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতি কীভাবে একটা খেলাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারে, তার বিরল নজির এই আফগানিস্তান।'
যে দেশের খেলোয়াড়রা এখনো দেশের মাটিতে খেলতে পারে না। ভারতের দেরাদুনে স্টেডিয়াম ভাড়া করে খেলতে হয় তাদের। আত্মঘাতী হামলাকারীরা আজও হামলা করার জন্য লক্ষ্যবস্তু বানায়, কাবুল-কান্দাহারের ক্রিকেট স্টেডিয়ামগুলো সেই দেশ এখন ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিজেদের প্রমাণ করছে। প্রবল ইচ্ছাশক্তি যে অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে, সেটার প্রমাণ আফগানিস্তানের ক্রিকেট।
ক্রিকেটে আফগানিস্তান যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এতে শিগগিরই বড় কোনো অর্জন তাদের ঝুলিতে জমা হলে অবাক হওয়ার উপায় নেই। এবারের বিশ্বকাপের কন্ডিশন ও উইকেটের সুবিধা তারা যেভাবে কাজে লাগিয়েছে, তা প্রশংসার যোগ্য। আর সবকিছুর নেপথ্যে আছে তাদের ক্রিকেট পরিকল্পনা। তাদের প্রধান কোচের দায়িত্বে আছেন সাবেক ইংলিশ ক্রিকেটার জোনাথন ট্রট। এ ছাড়া সহকারী কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিশ্বকাপজয়ী ক্যারিবিয়ান তারকা ডোয়াইন ব্রাভো। এ ছাড়া ব্যাটিং পরামর্শক হিসেবে আছেন ভারতের সাবেক তারকা ক্রিকেটার অজয় জাদেজা। তাদের দুর্দান্ত পরিকল্পনা মাঠে দারুণভাবে বাস্তবায়ন করছেন আফগান ক্রিকেটাররা।