এ যেন ধ্বংসস্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে আসা। কে বলবে, এই মুস্তাফিজই চলতি মাসেই বাংলাদেশের ওয়ানডে দলে ছিলেন না। সিরিজের শেষ ওয়ানডেও খেলেছেন আরেক পেসার তানজিম হাসান সাকিবের ইনজুরির কারণে। কিন্তু আইপিএলে চেন্নাইয়ের জার্সিতে মনোমুগ্ধকর এক শুরু হলো বাংলাদেশি এই পেসারের।
আইপিএল যেন মুস্তাফিজময়। চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে অভিষেকেই অবিশ্বাস্য বোলিং স্পেলে প্রশংসায় ভাসছেন কাটার মাস্টার। গত শুক্রবার সপ্তদশ আসরের উদ্বোধনী ম্যাচে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর বিপক্ষে নিজের প্রথম ১০ ডেলিভারিতেই একে একে তুলে নেন ৪ উইকেট।
৪ ওভারে ২৯ রান। সঙ্গে ৪ উইকেট। সেই চার উইকেটের মাঝে আছে বিরাট কোহলি, ফাফ ডু পেস্নসিস, ক্যামেরন গ্রিনের মতো তারকার নাম। আছে রজত পতিদারের মতো উদীয়মান তারকাও। ফিজের তান্ডবের পর আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে চেন্নাই ম্যাচ জিতেছে ৮ বল হাতে রেখেই ৬ উইকেটের ব্যবধানে। প্রত্যাশিতভাবেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ এবং ফ্যান্টাসি পেস্নয়ার অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার জিতেছেন মুস্তাফিজ।
সেই সঙ্গে মুস্তাফিজে মুগ্ধ ক্রিকেট দুনিয়া। ম্যাচ শেষে চেন্নাইয়ের অধিনায়ক ঋতুরাজ গায়কোয়াড সরাসরিই উলেস্নখ করেছেন মুস্তাফিজের কথা, 'শুরুর ২-৩ ওভার এলোমেলো হলেও পরে খেলা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। বিশেষ করে মুস্তাফিজের ওভার থেকে আমরা দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছি।
সত্য বলতে তার হাত ধরেই ম্যাচের টার্নিং
পয়েন্ট এসেছে।'
নিজেদের বোলিং বিভাগের কথা উলেস্নখ করে তিনি বলেন, 'ম্যাক্সওয়েল ও ফাফ ডু পেস্নসি (উইকেট নেন মুস্তাফিজ) আউট হওয়াতে আমরা স্বস্তি পাই।
সেটিতে পরের পাঁচ-ছয় ওভার আমরা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে পেয়েছি।'
মুস্তাফিজের বোলিং দেখে তাকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন দুই সাবেক ভারতীয় অনিল কুম্বলে এবং রবিন উথাপ্পা। ভারতের বিশ্বকাপজয়ী কিংবদন্তি অলরাউন্ডার ইরফান পাঠান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, 'চেন্নাইয়ের উইকেটে মুস্তাফিজের বোলিং বৈচিত্র্য বেশ লোভনীয়। তার কাছ থেকে সেরা বোলিং দেখা গেল।'
জিও সিনেমার পোস্ট ম্যাচ শোতে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক বলছিলেন, 'আজ যে খেলাটাকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন তিনি হলেন মুস্তাফিজুর, নিজের চেন্নাই সুপার কিংস অভিষেকে (ভালো করেছেন)। দারুণ সুপারচার্জড পারফরম্যান্স করেছে মুস্তাফিজুর। বিশেষ করে ডানহাতি ব্যাটারদের ক্ষেত্রে তার বিশেষ কিছু আছে।'
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকা কুম্বলে বলেন, 'এখানে তার পেস বৈচিত্র্যের কথাও মাথায় রাখতে হবে। ব্যাটাররা মনে হয় না তার পেসের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে। (গ্রিনকে করা বলটা) তার দারুণ একটি ডেলিভারি ছিল, গতি কম ছিল, সঙ্গে স্কিড করে চলে গিয়েছে। বলের চকচক করা অংশটা যখন পিচে ল্যান্ড করে তখন এমনটা হয়ে থাকে।'
আরও জানান, 'সে বাঁ হাতি পেসার হিসেবে দারুণ ইউনিক একজন বোলার। ফাফ ডু পেস্নসি ভালো ব্যাটিং করছিল পাওয়ারপেস্নতে। তার বিরুদ্ধে সে ভালো ফিল্ডিং সেট করে ভালো জায়গায় বল করেছে। দারুণ বোলিং করেছে মুস্তাফিজুর। সে আজকের সেরা বোলার ছিল।'
আরেক আলোচক রবিন উথাপ্পা বলেন, 'বাঁ হাতি পেসারকে আপনি সব সময় একাদশে রাখতে চাইবেন। গত কয়েক বছরে আইপিএলে মুস্তাফিজুর অত বেশি ভালো করতে পারেনি। কিন্তু যেকোনো ক্রিকেটার যখন চেন্নাই সুপার কিংসের জার্সি গায়ে জড়ায়, তখন তাদের সেরাটা বেরিয়ে আসে। ফিজের বিষয়টি হচ্ছে তার কবজির পজিশনটি কিছুটা বিভ্রান্তি ধরিয়ে দেওয়ার মতো (ব্যাটারদের মনে)। পেসাররা কবজি ভাঙবে কিন্তু জোরে বলও করবে। দারুণভাবে ব্যাটারদের ঘোল খাওয়ালো (ডিসেপশন এট ইটস বেস্ট)।'
এমনকি টুইটার ট্রেন্ডিংয়েও উঠে এসেছে মুস্তাফিজের নাম। তার এমন পারফরম্যান্স অন্য সব বাংলাদেশির মতো স্পর্শ করেছে দেশের তারকা ক্রিকেটারদের মধ্যেও। তামিম ইকবাল সামাজিকমাধ্যমে মুস্তাফিজের সঙ্গে আগুনের ডানার একটি ছবি দিয়ে লেখেন, 'দুর্দান্ত শুরু হলো মুস্তাফিজের!'
মুশফিকুর রহিম লিখেছেন, 'মাশাআলস্নাহ ভাই, অভিনন্দন, টুর্নামেন্টের বাকি সময়ের জন্য শুভকামনা রইল।'
তাসকিন আহমেদ দুটি পুরস্কারের কথা উলেস্নখ করে লিখেছেন, 'সাফল্যের মুকুটে আরও পালক যুক্ত হোক। অভিনন্দন ফিজ।'
২০১৬ সালে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে অভিষেক আইপিএল খেলতে নেমেই বিশ্ব ক্রিকেটে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন মুস্তাফিজ। ওই সিজনে ১৭ উইকেট শিকার করে দলের শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই বাঁ হাতি পেসার। সে সময় মুস্তাফিজদের হায়দরাবাদের কোচ থাকা টম মুডি এদিন তার পারফরম্যান্সের পর বলেছেন, 'সে একেবারেই ভিন্ন। তার গতিতে বৈচিত্র্য ছিল এবং বল সুইং করাতে পারত। এরপর আসলে তার ওপর দিয়ে অনেক কিছু গেছে। আপনার যখন এই ধরনের ভিন্নতা থাকবে, তখন আপনাকে সেটার মূল্য দিতে হবে। দুই কিংবা তিন বছর পর যখন সে অস্ত্রোপচার করিয়েছে, তখন সে ওই স্পিড এবং স্স্নোয়ার বল করতে অনেক ধুঁকেছে। তবে তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে আবারও ফিরে আসছে।'