স্বাধীনতা পদক পেয়ে দ্রম্নততম মানবীর কান্না
প্রকাশ | ১৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
ক্রীড়া প্রতিবেদক
দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক স্বীকৃতি স্বাধীনতা পদক পুরস্কার। ২০২৪ সালে দশ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এই পুরস্কার পাচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছেন একসময়ের তারকা অ্যাথলেট সাবেক দ্রম্নততম মানবী ফিরোজা খাতুন। ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবদানের জন্য তিনি এই পুরস্কার পাচ্ছেন। শুক্রবার ছুটির দিন সকাল গড়িয়ে দুপুরের দিকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ফোনকল পেয়েছিলেন ফিরোজা।
পদক প্রাপ্তির খবর শুনতেই চোখে অশ্রম্ন চলে আসে তার, 'দুপুরের একটু আগে সচিব পর্যায়ের এক আপা ফোন করে বললেন আমি স্বাধীনতা পদক পুরস্কার পাচ্ছি। শোনামাত্রই চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল। দেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার পাব আমি।' ময়মনসিংহ থেকে মুঠোফোনে এভাবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছিলেন ফিরোজা। শুক্রবার ছুটির দিন এমন একটি খবর পাব আসলে ভাবতেই পারিনি।
সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯৭৭ সাল থেকে। প্রথম বছরেই অ্যাথলেট হাবিলদার মোস্তাক এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০০১ পর্যন্ত অনিয়মিতভাবে ক্রীড়াঙ্গনের অল্প কয়েকজন পেয়েছেন এই বিশেষ পুরস্কার। ২০০১ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ক্রীড়া ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে একমাত্র এই পুরস্কারে ভূষিত হয়। এরপর গত ২১ বছর ক্রীড়াঙ্গনে আর এই পুরস্কার আসেনি। গত বছর রকিবুল হাসান প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে স্বাধীনতা পদক পুরস্কার পেয়েছিলেন। এ বছর পেতে যাচ্ছেন অ্যাথলেট ফিরোজা খাতুন।
এর আগে ক্রীড়াবিদদের মধ্যে প্রথম নারী হিসেবে স্বাধীনতা পদক পেয়েছিলেন প্রয়াত সুলতানা কামাল। দ্বিতীয় নারী হিসেবে এই পুরস্কার পাচ্ছেন ফিরোজা। এই তথ্য শোনার পর আরও বেশি আবেগাক্রান্ত সাবেক এই দ্রম্নততম মানবী, 'স্বাধীনতা পুরস্কার এমনিতেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। এরপর ক্রীড়াঙ্গনে দ্বিতীয় নারী হিসেবে পাব। এটা জেনে আরও বেশি সম্মানিত বোধ হচ্ছে। দুইজন নারীই অ্যাথলেট।'
ফিরোজা খাতুন ১৯৮৭-১৯৯৬ পর্যন্ত বাংলাদেশের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে রাজত্ব করেছেন। দশবার দ্রম্নততম মানবী ছিলেন তিনি। ১০০ মিটার ছাড়াও ২০০ মিটার ও হাইজাম্পেও ছিল তার পদক। ঘরোয়া পর্যায়ে এক দশকের বেশি সময় শ্রেষ্ঠত্ব দেখালেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত অর্জন রৌপ্য। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে বড় সুপারস্টার মোনেম মুন্না। সেই সময় শীর্ষ কয়েকজন ফুটবলারের পর অ্যাথলেট ফিরোজার তারকা খ্যাতিও ছিল বেশ। ১৯৯৬ সালে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড থেকে অবসর নেওয়ার পর অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে তিনি আর সেভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন না। জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে সাবেক অনেক তারকা আসলেও ফিরোজাকে গত এক দশকে দেখা গেছে খুব কমই।
ময়মনসিংহে নিজের এক মেয়ে নিয়ে অনেকটা নিভৃতেই বাস করছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। নিজ জেলা ময়মনসিংহ বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে কাজ করছেন। নিভৃতে থেকেও ক্রীড়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদক পাওয়ার বিষয়ে ফিরোজা বলেন, 'বেশ কিছুদিন ধরেই নেলী আপা (মহিলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদিকা) ও আরও অনেকেই এই পুরস্কারের জন্য আবেদন করতে বলেছিলেন। আমি আবেদন করেছি। আজ জানলাম পুরস্কার পাচ্ছি।'
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে জড়িত সুফিয়া খাতুন। স্বাধীনতার পর পর এখন পর্যন্ত অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজিয়া সুলতানা অনু। শু্যটার সাবরিনা দেশে-বিদেশে নানা প্রতিযোগিতায় একাধিক স্বর্ণ পেয়েছেন। ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক পরিচয়ের গন্ডি পেরিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে দুই নারী আইকনের খ্যাতিমান কিংবদন্তি কামরুন নাহার ডানা ও জোবেরা রহমান লিনু। এদের আগেই স্বাধীনতা পদক পেতে যাচ্ছেন ফিরোজা। এ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য, 'এই পুরস্কারের জন্য আবেদন করতে হয়। আমি আবেদন করেছি। মূল্যায়নের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের। অন্যরা কখনো আবেদন করেছেন কিনা আমার জানা নেই।'
ক্রীড়াঙ্গনের সবারই মূলত লক্ষ্য থাকে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পাওয়ার, যা ক্রীড়াঙ্গনে অবদানের জন্য যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় প্রদান করে। স্বাধীনতা পদক এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩ জন ক্রীড়াবিদ ও একটি ক্রীড়া সংস্থা পেয়েছে।
১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ স্বীকৃতির এই পুরস্কার পেয়েছিলেন অ্যাথলেট হাবিলদার মোস্তাক আহমেদ। চার বছর পর মরহুম আব্বাস মির্জা মরণোত্তর পুরস্কার পান। ১৯৮৫ এসএ গেমসে পাঁচ স্বর্ণ জেতা সাঁতারু মোশাররফ হোসেন খান পরের বছর পান রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদক। গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পরপরই দাবাড়ু নিয়াজ মোর্শেদ ১৯৮৯ সালে এই স্বীকৃতি পেয়েছেন। ১৯৯১ সালে দ্রম্নততম মানব শাহ আলম, ১৯৯৩ সালে কাজী আব্দুল আলীম, ১৯৯৪ সালে শু্যটার আতিকুর রহমান, ১৯৯৫ সালে জাকারিয়া পিন্টু, ১৯৯৬ সালে কাজী সালাউদ্দিন (একই বছর তার চাচা চিকিৎসক কাজী আবুল মনসুরও পেয়েছিলেন), ১৯৯৮-২০০০ সালে তিনজন মরণোত্তর শেখ কামাল, ব্রজেন দাস ও সুলতানা কামাল পুরস্কার পান। ২০০১ সালে বিসিবির পর ২০২৩ সালে ক্রিকেটার রকিবুল হাসানও এই পুরস্কার গ্রহণ করেছেন।
দেশের সর্বোচ্চ স্বীকৃতির প্রাপ্তিতে অন্য খেলার চেয়ে অ্যাথলেটরাই এগিয়ে। সেই অ্যাথলেটরা এখন সেই অর্থে তারকা খ্যাতি পান না বললেই চলে। এ বিষয়ে ফিরোজার মন্তব্য, 'আসলে আমি একটু অন্য রকম ও বাস্তববাদী। আমরা যখন খেলতাম তখন অ্যাথলেটিক্সের জনপ্রিয়তা ছিল এটা যেমন সত্য, এখন সে রকমটা নেই, এটাও বাস্তব। আমি দুটোই স্বাভাবিকভাবে দেখি।'