বৈচিত্র্যের বার্তা নিয়ে বাংলাদেশের টি২০ ভুবনে আলিস

প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

ক্রীড়া ডেস্ক
আলিস আল ইসলাম আর চমক-পাশাপাশি খুব মানিয়ে যায়। দেশের ক্রিকেটে শীর্ষ আঙিনায় তার আবির্ভাবের গল্প চমকপ্রদ। শুরুর ম্যাচের পারফরম্যান্সও ছিল চমক জাগানিয়া। এরপর তার হারিয়ে যাওয়া এবং ফেরা, দু'টিই চমকানোর মতো। সবশেষ তিনি বড় চমক হয়ে এলেন জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়ে। শ্রীলংকার বিপক্ষে বাংলাদেশের টি২০ দলে সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য নামটি তারই। আলিসের সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা না থাকলে স্রেফ তার পরিসংখ্যান দেখে ধাক্কা লাগতে পারে যে কারও। অফিসিয়াল বয়স পেরিয়ে গেছে ২৭। প্রথম শ্রেণির ম্যাচ এখনো খেলার সুযোগ পাননি। লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে ৭ ম্যাচে উইকেট মোটে ৮টি। যে সংস্করণে তিনি বাংলাদেশ দলে সুযোগ পেলেন, সেই টি২০তে ২৪ ম্যাচে উইকেট ১৯টি। এমন পরিসংখ্যানের একজন কেন জাতীয় দলে? এই উত্তরটির গভীরে গেলেই জানা যাবে কেন তিনি আলাদা। সীমিত ওভারের ক্রিকেটারের জন্য যে ধরনের স্পিনার হাপিত্যেশ করে খুঁজছিল দেশের ক্রিকেট, একজন 'মিস্ট্রি' বা রহস্য স্পিনার, সেই খরায় স্বস্তির বর্ষণ হয়ে উঠতে পারেন আলিস। তাকে দলে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই সংবাদ মাধ্যমকে সাবেক প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু বললেন সেই কথাটিই, 'আলিস ভিন্ন ধরনের বোলার। একটু ব্যতিক্রমী স্পিনার। এ রকম একজনকে আমরা খুঁজছিলাম। এই ধরনের বোলার থাকলে খুব সুবিধা হয়, বিশেষ করে টি২০তে। এবার বিপিএলে আলিস ভালো করেছে। সামনে বিশ্বকাপ আছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য রেডি কিনা, সেটি আরও দেখতেই আমরা ওকে টিম ম্যানেজমেন্টের তত্ত্বাবধানে রাখতে চেয়েছি। আরও ভালোভাবে ওকে দেখা যাবে তাহলে।' প্রধান নির্বাচক যেটিকে 'ব্যতিক্রমী' স্পিনার বলছেন, আধুনিক ক্রিকেটে তাদেরকেই 'মিস্ট্রি' স্পিনার বলা হয়। আলিসকেও তেমনি স্পিনার হিসেবে কোনো সুনিদিষ্ট ঘরানায় ফেলা কঠিন। বল ঘোরাতে পারেন দুই দিকেই। টপ স্পিন, ফ্লোটার ভালো পারেন। সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য, সুইং ও সিমও করাতে পারেন। আধুনিক ক্রিকেটে স্পিনারদেরও সুইং করানো এখন আর নতুন কিছু নয়। অজান্তা মেন্ডিস, সুনিল নারাইনরা টুকটাক যা শুরু করেছিলেন, সময়ের সঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়েছে অনেক স্পিনারের মধ্যে। বিশেষ করে ইমাদ ওয়াসিম, মাহিশ থিকসানার মতো টি২০তে নতুন বলে বোলিং করা স্পিনাররা নিয়মিতই সুইং করান। অনেক পার্ট টাইম স্পিনারও এই ঝলক দেখাতে শুরু করেছেন। আলিস এই ঘরানাই অনেকটা রপ্ত করেছেন। স্কিলে নিজের উন্নতির ছাপ এবারের বিপিএলে দারুণভাবেই রেখেছেন তিনি। তবে অনেক চমক দেখালেও তার ক্যারিয়ারের এগিয়ে চলা খুব চকমকে নয়। ২৭ বছর বয়সই বলে দিচ্ছে, এই পর্যায়ে আসার পথটা তার মৃসণ ছিল না। ঢাকার ক্রিকেটে তার পথচলা শুরু বছর দশেক আগে দ্বিতীয় বিভাগ লিগ দিয়ে। বছর তিনেক পর সুযোগ মেলে প্রথম বিভাগে। প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলা তখন তার স্বপ্ন। প্রথম বিভাগে খেলার সময়ই ২০১৯ বিপিএলে ঢাকা ডায়নামাইটসের নেটে বোলিংয়ের সুযোগ পান। নেটেই তাকে দেখে মনে ধরে যায় কোচ খালেদ মাহমুদের। সাভারের ছেলেটিকে মূল স্কোয়াডে জায়গা করে দেন তিনি। ১১ জানুয়ারি ২০১৯ রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে স্বীকৃত ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে যায়। তার মাথায় ক্যাপ পরিয়ে দেন সুনিল নারাইন, যাকে আদর্শ মেনেই এই ঘরানার বোলিং শেখার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তখনো আলিস দেশের ক্রিকেটে অচেনা এক নাম। তবে সেদিনই নিজেকে চিনিয়ে দেন তিনি। শুধু মাঠে নেমে নয়, ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্সেই। দেশের প্রধান স্টেডিয়ামে গ্যালারিভরা দর্শকের সামনে প্রথমবার খেলতে নেমে স্নায়ুর চাপে পড়েই হয়তো সহজ দুটি ক্যাচ ফসকে যায় তার হাত থেকে। তবে নিজেকে ঠিকই সামলে নিয়ে জ্বলে ওঠেন বোলিংয়ে। বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ে ৮৩ রান করা রাইলি রুশোকে ফিরিয়ে প্রথম উইকেটের স্বাদ পান। এরপর ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন তিনি অষ্টাদশ ওভারে হ্যাটট্রিক করে। এমনকি শেষ ওভারে চাপের সঙ্গে লড়াই জিতে দলকে এনে দেন ২ রানের জয়। বড় রানের ম্যাচে ২৬ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হয়ে তিনি তোলপাড় ফেলে দেন। সবাই তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করে। কিন্তু তার সেই স্বপ্নময় সময় দ্রম্নতই বিষাদে পরিণত হয় বোলিং অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায়। প্রথম বিভাগ ক্রিকেটেও তার অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। পরে কিছুটা শুধরে নেন। আবার তাকে পড়তে হয় সংশয়ের মুখে। সেই প্রশ্নকে সঙ্গী করেই পরের দুই ম্যাচে আঁটসাঁট বোলিং করেন। সপ্তাহ দু'য়েক পর অ্যাকশনের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই চতুর্থ ম্যাচেই চোট পেয়ে ছিটকে পড়েন। গুরুতর সেই চোটের পরে অস্ত্রোপচার করাতে হয় তাকে। ৮ মাসের মতো ছিলেন মাঠের বাইরে। ফেরার পর অ্যাকশনের পরীক্ষা দিয়ে বোলিংয়ের সবুজ সঙ্কেত পান। ২০২০ বিপিএলে খেলেন খুলনা টাইগার্সের হয়ে। এক ম্যাচে মোটামুটি ভালো করলেও আরেক ম্যাচে ছিলেন খরুচে। আগের বছরের সেই ধারা প্রায় উধাও। একাদশের বাইরে চলে যান। ওই বিপিএলে আর কোনো ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। আর সেই হতাশার সঙ্গে টুকটাক চোট লেগেই ছিল। ২০২০ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে অভিষেকে ওল্ড ডিওএইএস ক্লাবের হয়ে ৩৬ রানে ২ উইকেট নেন। মৌসুমে ম্যাচ খেলতে পারেন ওই একটিই। ২০২১ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ টি২০ ১২ ম্যাচ খেলে উইকেট মেলে কেবল ৪টি। এভাবেই ধুঁকতে ধুঁকতে চলছিল তার ক্যারিয়ার। ২০২২ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে শাইনপুকরের হয়ে একটি ম্যাচ খেলে খরুচে বোলিংয়ের পর আবার বাইরে ছিটকে যান। এবার একরকম হারিয়েই যান। লম্বা বিরতির পর আবার তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় ২০২৩ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে। প্রাইম ব্যাংকের হয়ে ৫ ম্যাচে ৬ উইকেট নেন ওভারপ্রতি ৪.১০ রান দিয়ে। খুব দারুণ কিছু না হলেও কিছুটা আশার সঞ্চার হয়। বোলিং নিয়ে কাজ করে যেতে থাকেন। পাশে পান তিনি ঘরোয়া ক্রিকেটের সফল কোচ মোহাম্মদ সালাউদ্দিনকে। এই কোচের কর্মক্ষেত্র সাকিব-মাসকো একাডেমিতে নিজেকে ঝালিয়ে নিতে থাকেন তিনি। ততদিনে অ্যাকশনে পরিবর্তন এসেছে। বোলিংয়ের স্কিল বাড়ছে আর রহস্য যোগ হতে শুরু করেছে। আর তিনি অপেক্ষা করছেন তখন সুযোগের। বিপিএলের ড্রাফটে এবার তাকে কেউ নেয়নি। সালাউদ্দিনের তত্ত্বাবধানে নিজেকে শাণিত করে যাচ্ছিলেন তিনি। তার জন্য দুয়ারটা খুলে যায় সৌভাগক্রমে। কুমিলস্না ভিক্টোরিয়ান্স জানতে পারে, শুরুর অনেক ম্যাচে তারা পাবে না সুনিল নারাইনকে। অনুশীলনে আলিসের বল খেলার পর তার উন্নতিটা বুঝতে পেরে লিটন কুমার দাস, ইমরুল কায়েসদের পরামর্শে তাকে কুমিলস্নার স্কোয়াডে নিয়ে নেন কোচ। চার বছর পর তিনি বিপিএলে ফেরেন গত ২৩ জানুয়ারি। এবার কোনো চমক নেই। ৩ ওভারে ৩০ রান দিয়ে উইকেট শূন্য থাকেন সৌম্য সরকার, মুশফিকুর রহিমদের আক্রমণের সামনে। তবে বিস্ময় ঠিকই জমা রেখেছিলেন তিনি। সেসব মেলে ধরেন সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে। বিশ্বমানের রহস্য স্পিনারদের মতই সেদিন স্পিন, টার্ন, সুইংয়ের মিশেলে সিলেটের ব্যাটসম্যানদের ঘোর লাগিয়ে উইকেট নেন ৪টি। সেই ম্যাচের পারফরম্যান্সেই মূলত জাতীয় নির্বাচকদের নজর কাড়েন তিনি।