নানা সমালোচনা আর বিতর্কের পর নির্বাচক প্যানেল থেকে মিনহাজুল আবেদীন নান্নুকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ পড়েছেন হাবিবুল বাশার সুমনও। নির্বাচক প্যানেলে যুক্ত করা হয়েছে হান্নান সরকারকে। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ৮ বছর পর নতুন প্রধান নির্বাচক পেল দেশের ক্রিকেট। নান্নুর স্থলাভিষিক্ত হলেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। গত সোমবার সন্ধ্যায় বিসিবির পরিচালনা পরিষদের সভায় প্রধান নির্বাচকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গাজী আশরাফ হোসেন লিপুকে।
প্রধান নির্বাচকের পদ পেয়ে গতকাল মঙ্গলবার মিরপুরে আসেন লিপু। দুপুরে বিসিবির আঙিনায় পা রেখেই গাজী আশরাফ হোসেন লিপু বলে উঠলেন, 'অনেকদিন পর।' সেই অনেকদিন আসলে এক দশকেরও বেশি সময়।
২০১৩ সাল পর্যন্ত বোর্ড পরিচালক ছিলেন তিনি, সেবার নির্বাচনে হেরে বিসিবির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল সাবেক এই অধিনায়কের। অনেকদিন তাকে আর দেখা যায়নি দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো ভূমিকায়। অথচ গাজী আশরাফ হোসেনের কত পরিচয়, ১৯৮৬ সালে তার নেতৃত্বেই প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে নেমেছিল বাংলাদেশ। পরে ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবেও লম্বা সময় দেখা গেছে।
১৯৯৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি জেতা দলের ম্যানেজারও ছিলেন। ২০০৭ সালে অ্যাডহক কমিটির প্রধান হিসেবে আইসিসির বোর্ড মিটিংয়ে পাঁচবার বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্বও করেছেন। বিসিবির পরিচালক, ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের পরিচালক, বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের প্রধান...কত অভিজ্ঞতা তার ঝুলিতে।
লম্বা সময় পর তাকে বোর্ডে ফেরানো হয়েছে জাতীয় নির্বাচক কমিটির প্রধান করে। বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের কাছে প্রধান নির্বাচকের যে তালিকা গিয়েছিল সেখানে গাজী আশরাফের নাম দেখে জিজ্ঞাসা ছিল, 'উনি কি কাজ করবেন?'
এমন প্রশ্নের পেছনের কারণ বিসিবি এর আগে নানা সময় গাজী আশরাফকে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু মায়ের অসুস্থতা ও নিজের ব্যস্ততার কারণে বিসিবির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এবার প্রধান নির্বাচকের প্রস্তাব পাওয়ার পর বেশকিছু বিষয় সামনে আনেন তিনি। বোর্ড থেকে সেসব বিষয় নিয়ে সবুজ সংকেত পাওয়ার পরই কাজ করতে রাজি হয়েছেন। বোর্ড তাকে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছে। যার শুরুটা হচ্ছে পহেলা মার্চ থেকে।
যে বিষয়গুলো গাজী আশরাফ সামনে এনেছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল, স্বাধীনভাবে নির্বাচক প্যানেল কাজ করতে পারবে তো? বোর্ড থেকে সেই নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানালেন তিনি।
মঙ্গলবার মিরপুরে লিপু বলেন, 'স্বাধীনতা থাকবে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। তবে আগের প্রক্রিয়া নিয়ে আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। কারণ এটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আমরা জানি যে এটা বড় একটা প্রক্রিয়া ছিল। দল নির্বাচন সেখানে অধিনায়ক ও কোচ নিশ্চিতভাবেই অংশগ্রহণ করবেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে প্রক্রিয়া মেনে চলে আমরা সেটাই রাখার চেষ্টা করব।'
২০১৩ সালে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বাংলাদেশের কোচিং প্যানেলে যুক্ত হওয়ার পর নির্বাচক প্যানেলের সঙ্গে গন্ডগোল বাঁধে। তখন ফারুক আহমেদ প্রধান নির্বাচক। তার কাজে হস্তক্ষেপ এবং পরবর্তীতে বিসিবি থেকে স্বাধীনতা না পাওয়ায় পদত্যাগ করেন। এবারও হাথুরুসিংহে আছেন। এবারও তার নির্বাচকদের কাজে হস্তক্ষেপ করার কথা। যদি করেন তাহলে কী করবেন গাজী আশরাফ? উত্তরটা তিনি দিয়েছেন এভাবে, 'বল এখনো ডেলিভারি হয়নি। বলটা আগে করতে দিন। তারপরই না খেলব। ঠিক আছে।'
আর যদি স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ না পান? গাজী আশরাফ খোলা মনেই বলেছেন, 'আমি বিশ্বাস করি স্বাধীনভাবে না হলে কাজ করে তো কোনো আনন্দ নেই। রাস্তা সব সময় খোলা। আসার রাস্তাও খোলা। যাওয়ার রাস্তাও খেলা।'
শুরুতেই তাই ব্যাখ্যা করে জানান তার প্রোফাইলের ভারের সঙ্গে নির্বাচকের পদ না মিললেও যে কারণে দায়িত্বটা নিয়েছেন, 'আপনারা জানেন ২০১৩ সালের পর থেকে আমি বোর্ডের সঙ্গে নেই। করোনাকালের আগেও একাধিকবার বোর্ড থেকে আমার কাছে বিভিন্ন ভূমিকায় কাজের প্রস্তাব এসেছে। আমার মা অসুস্থ ছিলেন তখন চিন্তা করারই সুযোগ হয়নি। নির্বাচনের আগেও প্রস্তাব এসেছে। এবার যখন আসল (প্রস্তাব)। কথা বললাম। আমার দিক থেকে যেটা ছিল, আমি বোর্ড পরিচালক ছিলাম। হয়তো অনেকে জানেন না ২০০৭-০৮ সালের দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আমি পাঁচ-ছয়টা আইসিসি সভায় প্রতিনিধিত্ব করেছি। এতগুলো ভূমিকা পালন করার পর আমাকে এখন এই পদে আসা, যেখানে একটা নিয়মের মধ্যে একটা বেতন কাঠামোর মধ্যে কাজ করতে হবে। সেটার জন্য ওপেনিং স্পেস চেয়েছিলাম। গঠনতন্ত্রের বাইরে একটা সমমানের সম্মান যাতে এই পদকে দেওয়া হয়। সেই জায়গায় তারা আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন।'
গাজী আশরাফকে প্রধান নির্বাচক ও হান্নান সরকারকে নির্বাচক কমিটিতে যুক্ত করা হয়েছে। সঙ্গে আছেন আব্দুর রাজ্জাক। নিজের প্যানেল নিয়ে কাজের দিক থেকে শতভাগ সৎ থাকার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন গাজী আশরাফ, 'ক্রিকেট মানেই চ্যালেঞ্জ। আমি এবং আমার প্যানেল (হান্নান সরকার ও আব্দুর রাজ্জাক) যে নতুন দায়িত্ব পেয়েছি আমরা চেষ্টা করব মেধা, প্রজ্ঞা, সততা ও একাগ্রতা দিয়ে আমাদের যেই সীমিত সম্পদ আছে সেটা দিয়ে, আমি বলব না যে প্রচুর রিসোর্স আছে। সেটা থেকে প্রতিপক্ষের আলোকে, কোন বিদেশি দলের বিপক্ষে দেশে কিংবা বিদেশে কোন আলোকে বা গেস্নাবাল টুর্নামেন্টে সেই আলোকে দেশের সেরা দলটা তৈরি করার চেষ্টা করব।'
লিপু বলেন, 'আমি আনুষ্ঠানিকভাবে কদিন পর দায়িত্ব নেব। ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধানের সঙ্গে কথা বলে আরও কিছু বিষয় পরিষ্কার হব। তার আগেই গণমাধ্যমে কিছু বলতে চাই না। একটা কথা বলে নিতে চাই আমাদের খেলোয়াড় সীমাবদ্ধতা আছে। অপশনগুলো আমরা সবাই জানি। সেখানে আমরা প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা চিন্তা করেই আমরা দলটা করব।'