সম্প্রতি ম্যাসাচুসেটস অ্যামহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জুন ইয়াও এবং তার সহকর্মীরা এমন এক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় 'হাইগ্রো-ইলেকট্রিসিটি'। বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী নিকোলা টেসলা চেয়েছিলেন, ঝড়ো আকাশে মেঘের মধ্যে যেভাবে বিদু্যৎ জমা হয়- সেই প্রক্রিয়া ব্যবহার করে তিনি বাতাসের আর্দ্রতা থেকে বিদু্যৎ উৎপাদন করবেন। টেসলার মৃতু্যর কয়েক দশক পর এখন তার চিন্তা বাস্তবে রূপ পেতে যাচ্ছে। অনেক গবেষক বাতাসে ভাসমান পানির অণু থেকে বৈদু্যতিক চার্জ বের করে নেওয়ার নতুন উপায় আবিষ্কার করছে। পানির অণুগুলো নিজেদের মধ্যে অতিক্ষুদ্র পরিমাণে চার্জ বিনিময় করে। বিজ্ঞানীরা ঠিক সেটাকেই নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন। আমাদের চারপাশে সবসময়ই নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস ভেসে বেড়াচ্ছে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, তারা একটা ছোট কম্পিউটার বা সেন্সরকে শক্তি যোগানোর মতো যথেষ্ট বিদু্যৎ তৈরি করতে পারবেন।
এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থেকে সৃষ্টি হওয়া অতিক্ষুদ্র প্রোটিন তার বাতাস থেকে বিদু্যৎ নিয়ে জমিয়ে রাখতে পারে। এ বস্তুটির মধ্যে অতিসূক্ষ্ণ গর্ত আছে, যা ভাসমান পানির অণু আটকে রাখতে পারে। প্রোটিন-কণার ঘষা লাগলে পানির অণু থেকে চার্জ নির্গত হয়। মেঘের মধ্যে ঠিক এ ব্যাপারটাই ঘটে- যদিও তা অনেক বড় আকারে ঘটে থাকে। ঝড়ো আকাশে জমা মেঘে বিপরীতধর্মী বৈদু্যতিক চার্জ জমা হয়, যা এক পর্যায়ে বজ্রপাতের আকারে নির্গত হয়ে থাকে। পানির অণু চলাচলকে প্রভাবিত করতে পারলে এবং চার্জের পার্থক্য সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করতে পারলে বিদু্যৎ উৎপাদন করা সম্ভব। ডিভাইসটি পৃথিবীর যে কোনো জায়গাতেই কাজ করতে পারবে। ইয়াও এবং তার সহকর্মীরা ২০২৩ সালের মে মাসে একটা কাঠামো তৈরি করেন, যা অতিক্ষুদ্র গর্তে ভরা এবং কয়েক রকমের পদার্থ দিয়ে তৈরি। তারা ব্যবহার করেন গ্রাফিন অক্সাইডের কণা, পলিমার এবং কাঠ থেকে পাওয়া আঁশজাতীয় সেলুলোজ 'ন্যানোফাইবার'। এতে তারা ধারণা করেন, কাঠামোটাই আসল ব্যাপার; কী উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে তা নয়। এসব পরীক্ষার জন্য ডিভাইসটি ছিল মানুষের একগাছা চুলের চেয়েও সরু। আর তাতে যে বিদু্যৎ উৎপন্ন হয়, তার পরিমাণও অত্যন্ত কম- এক ভোল্টের একটা ছোট ভগ্নাংশ মাত্র। এ জিনিসটাই আরও বড় আকারে করলে হয়তো বেশ কয়েক ভোল্ট পর্যন্ত বিদু্যৎ পাওয়া যেতে পারে। হয়তো এমন কোনো তরল পদার্থও এতে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা শুধু একটা সারফেসে ছিটিয়ে দিলেই তাৎক্ষণিকভাবে বিদু্যতের একটা উৎসে পরিণত হতে পারে।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের প্রকৌশলী রেশমা রাও বলেন, এটা খুবই উত্তেজনাকর। তবে এটা ভাবা বাস্তবানুগ হবে না যে, এই প্রযুক্তি দিয়ে পুরো একটা বাড়ি বা বা গাড়ির মতো জিনিসের জন্য বিদু্যৎ পাওয়া যাবে। বাতাসের আর্দ্রতা থেকে যেটুকু বিদু্যৎ পাওয়া যাবে, তা দিয়ে হয়তো সেন্সর বা ছোট ইলেকট্রনিক ডিভাইস চালানো সম্ভব হতে পারে। ব্যাপারটা প্রথম নজরে আসে ১৮৪০ সালে ব্রিটেনের উত্তরাঞ্চলীয় শহর নিউক্যাসলে। সেখানকার একটি কয়লাখনির ট্রেনের চালক তার হাতে একটা অদ্ভুত শিরশিরে অনূভূতি টের পেলেন। এরপর তিনি খেয়াল করলেন, তার হাতের আঙুল আর ইঞ্জিনের লিভারের মধ্যে ক্ষুদ্র একটা বৈদু্যতিক স্ফুলিঙ্গ লাফিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। যে বিজ্ঞানীরা ঘটনাটার অনুসন্ধান করেছিলেন, তারা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে আসেন- স্টিম ইঞ্জিনের বাষ্প যখন বয়লারের ধাতুর সংস্পর্শে আসছে, তখন তাতে একটা বৈদু্যতিক চার্জ জমা হচ্ছে। আর্দ্র বাতাসকে জ্বালানির উৎস হিসেবে ব্যবহারের লক্ষ্যে আরও একটি গবেষণা চালাচ্ছে পর্তুগালের একটি দল। এর অর্থায়ন করছে 'ক্যাচার' নামে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের এক প্রকল্প। কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন লিসবন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী সভিৎলানা লু্যবচিক এবং তার ছেলে আন্দ্রিই। তারা একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করছেন, যা ২০২৪-এর শেষ নাগাদ সম্পন্ন হবে। তারা কাজে লাগাচ্ছেন জিরকোনিয়াম অক্সাইডের তৈরি ১ দশমিক ৬ ইঞ্চি ব্যাসের একটি চাকতি, যা আর্দ্র বাতাস থেকে পানির অণু আটকে ফেলতে পারে এবং তাকে ক্ষুদ্র একটি চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত করতে পারে। এর ফলে যে চার্জ তৈরি হয় তা দেড় ভোল্ট বিদু্যৎ সরবরাহ করতে পারে। এ রকম দু'টি চাকতি দিয়ে একটি এলইডি লাইট জ্বালানো সম্ভব। তিনি বলেন, এই জিরকোনিয়াম অক্সাইডের চাকতি আরও বেশি জোড়া দিলে আরও বিদু্যৎ উৎপাদন করা সম্ভব।
হাইগ্রো-ইলেকট্রিক্যাল পদ্ধতিগুলো নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। এটা কীভাবে কাজ করে, তার মূল নীতিগুলো নিয়ে আরও অনুসন্ধান দরকার। এরপর আছে প্রযুক্তিটির বাণিজ্যিক ব্যবহারের প্রশ্ন। কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সারাহ জর্ডনের মতে, এসব প্রযুক্তিকে একদিকে যেমন যথেষ্ট বিদু্যৎ উৎপাদন করতে হবে- খরচের দিক থেকেও অন্য নবায়নযোগ্য প্রযুক্তিগুলোর সঙ্গে পালস্না দিতে হবে। সৌর বিদু্যৎ ও বায়ুচালিত বিদু্যৎ এর মধ্যেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আগামী দশকগুলোতে এগুলোর গুরুত্ব হয়তো আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু তার পরও হাইগ্রো-ইলেকট্রিসিটি থেকে যে বিদু্যতের নতুন উৎস বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, তা সত্যিই আশার কথা। ভাসমান পানির কণা থেকে বিদু্যৎ উৎপন্ন হলে তা আমাদের জন্য একটি মাইলফলক হবে, এ কথা বেশ জোর দিয়েই বলা যায়।