বস্ন্যাক হোলের জন্ম-মৃতু্য রহস্য

বস্ন্যাক হোল মহাজাগতিক দেহে অত্যন্ত তীব্র মাধ্যাকর্ষণ থাকে, যা থেকে কিছুই, এমনকি আলোও পালাতে পারে না। একটি বৃহদাকার নক্ষত্রের মৃতু্যতে একটি বস্ন্যাক হোল তৈরি হতে পারে। যখন এ ধরনের একটি নক্ষত্র তার কেন্দ্রের শেষে অভ্যন্তরীণ থার্মোনিউক্লিয়ার জ্বালানি নিঃশেষ করে ফেলে জীবন, করোটি অস্থির হয়ে ওঠে এবং মহাকর্ষীয়ভাবে নিজের ওপর ভেতরের দিকে ধসে পড়ে এবং তারার বাইরের স্তরগুলো উড়িয়ে দেওয়া হয়। চারদিক থেকে পতিত হওয়া উপাদানের চূর্ণ ওজন মৃত নক্ষত্রটিকে শূন্য আয়তনের একটি বিন্দুতে সংকুচিত করে এবং অসীম ঘনত্ব সৃষ্টি করে।

প্রকাশ | ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

সাগর আহমেদ
আমাদের পৃথিবীতে, জলে, স্থলে, পাতালে এবং মহাশুন্যে রয়েছে নানান বিস্ময়। গ্রহ, উপগ্রহ, ধুমকেতু, নীহারিকা, পালসার, ছায়াপথ, নান ধরনের মহাজাগতিক রশ্মি, উল্কা এবং আরও অনেক কিছু আছে আমাদের মহাকাশে। এর মধ্যে বস্ন্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর পৃথিবীর কোটি কোটি বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের কাছে এক মহা বিস্ময় হয়ে আছে। মহা বিজ্ঞানী আইনস্টাইন সর্ব প্রথম বস্ন্যাক হোলের থিয়োরি উত্থাপন করেন, এর আগে বস্ন্যাক হোলের অস্তিত্ব কারও জানা ছিল না। ৯ নভেম্বর, ২০২৪। বিশাল গ্যালাক্সি গ৮৭-এর কেন্দ্রে বস্ন্যাক হোল, পৃথিবী থেকে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন আলোকবর্ষ, ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (ঊঐঞ) দ্বারা চিত্রিত। বস্ন্যাক হোল সূর্যের চেয়ে ৬.৫ বিলিয়ন গুণ বেশি বিশাল। একটি সুপারম্যাসিভ বস্ন্যাক হোলে রিং থাকে। রিংটি একদিকে উজ্জ্বল কারণ বস্ন্যাক হোলটি ঘুরছে এবং এভাবে বস্ন্যাক হোলের দিকের উপাদানগুলো পৃথিবীর দিকে ঘুরছে তার নির্গমন ডপলার প্রভাব দ্বারা বৃদ্ধি পেয়েছে। বস্ন্যাক হোলের ছায়া ঘটনা দিগন্তের থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ গুণ বড়। বস্ন্যাক হোল মহাজাগতিক দেহে অত্যন্ত তীব্র মাধ্যাকর্ষণ থাকে, যা থেকে কিছুই, এমনকি আলোও পালাতে পারে না। একটি বৃহদাকার নক্ষত্রের মৃতু্যতে একটি বস্ন্যাক হোল তৈরি হতে পারে। যখন এ ধরনের একটি নক্ষত্র তার কেন্দ্রের শেষে অভ্যন্তরীণ থার্মোনিউক্লিয়ার জ্বালানি নিঃশেষ করে ফেলে জীবন, কোরটি অস্থির হয়ে ওঠে এবং মহাকর্ষীয়ভাবে নিজের ওপর ভেতরের দিকে ধসে পড়ে এবং তারার বাইরের স্তরগুলো উড়িয়ে দেওয়া হয়। চারদিক থেকে পতিত হওয়া উপাদানের চূর্ণ ওজন মৃত নক্ষত্রটিকে শূন্য আয়তনের একটি বিন্দুতে সংকুচিত করে এবং অসীম ঘনত্ব সৃষ্টি করে। বস্ন্যাক হোল আসলে একই ভর রেখে বস্তুর এমন একটি সংকোচন, যার ফলে বস্তুর ভর ও মধ্যাকর্ষণ ঠিক থাকে, কিন্তু বস্তুটি অনেক বেশি ছোট হয়ে যায়। ঘঅঝঅ অ্যানিমেশন : সবচেয়ে বড় বস্ন্যাক হোলকে আকার দেওয়া একটি অ্যানিমেশনের কথা ভাবা যাক, যা ১০টি সুপারসাইজড বস্ন্যাক হোল দেখায়, যা তাদের ছায়াপথের মাপ দ্বারা পরিমাপ করা মিল্কিওয়ে এবং গ৮৭ সহ তাদের হোস্ট গ্যালাক্সিতে কেন্দ্রের স্তর দখল করে। বস্ন্যাক হোলের অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচন করে দেখা যায়, বিশাল নক্ষত্রের মৃতু্য হলে বস্ন্যাক হোল তৈরি হয়। তারা যে তীব্র মাধ্যাকর্ষণ শক্তি প্রয়োগ করে, তা কিছুই পালাতে দেয় না, না কোনো অতি বৃহৎ ও ভারী বস্তু, না এমনকি আলো। বস্ন্যাক প্রবাহিত হওয়ার সময় অতি ধীর হয়ে যায়। বস্ন্যাক হোলের গঠনের বিশদ বিবরণ আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব থেকে গণনা করা হয়। একতা একটি বস্ন্যাক হোলের কেন্দ্র গঠন করে এবং বস্তুর 'পৃষ্ঠ' দ্বারা লুকানো থাকে। ভেতরের এস্কেপ বেগ (অর্থাৎ, মহাজাগতিক বস্তুর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র থেকে পালানোর জন্য পদার্থের জন্য প্রয়োজনীয় বেগ) আলোর গতিকে ছাড়িয়ে যায়, যাতে আলোর রশ্মিও মহাকাশে পালাতে পারে না। দিগন্তের ব্যাসার্ধকে বলা হয়শোয়ার্জচাইল্ড ব্যাসার্ধ, জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল শোয়ার্জচাইল্ডের পরে, যিনি ১৯১৬ সালে ধসে পড়া নাক্ষত্রিক দেহের অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, যা কোনো বিকিরণ নির্গত করে না। শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধের আকার ভেঙে যাওয়া তারার ভরের সমানুপাতিক। সূর্যের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ভরসহ একটি বস্ন্যাক হোলের জন্য, ব্যাসার্ধ হবে ৩০ কিমি (১৮.৬ মাইল)। বস্ন্যাক হোল সব সময়ই অদৃশ্য। কিন্তু বস্ন্যাক হোলের অস্তিত্বকে এর ভর ও ঘনত্ব দ্বারা অনুভব করা যায়। শুধুমাত্র সবচেয়ে বৃহদাকার নক্ষত্রসমূহ- যাদের তিনটিরও বেশি সৌর ভর- তাদের জীবনের শেষে বস্ন্যাক হোলে পরিণত হয়। স্বল্প পরিমাণে ভরসহ তারাগুলো কম সংকুচিত দেহে বিবর্তিত হয়, হয় সাদা বামন বা নিউট্রন তারা। ১ জুলাই ২০০২ : সৌর এবং হেলিওস্ফিয়ারিক অবজারভেটরি (ঝঙঐঙ) উপগ্রহ পৃথিবীর ব্যাসের ৩০ গুণেরও বেশি একটি বিশাল সৌর বিস্ফোরণ প্রকাশ করে। সূর্যের পৃষ্ঠের ওপর একটি চৌম্বক ক্ষেত্রের একটি লুপ গরম গ্যাস আটকে দিলে অগ্নু্যৎপাতের সৃষ্টি হয়। বস্ন্যাক হোল সাধারণত তাদের ছোট আকার এবং তারা কোনো আলো নির্গত না হওয়ার কারণে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তাদের কাছের বস্তুর ওপর তাদের বিশাল মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের প্রভাব দ্বারা 'পর্যবেক্ষণ করা' যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি বস্ন্যাকহোল একটি বাইনারি স্টার সিস্টেমের সদস্য হয়, তবে তার সঙ্গী থেকে এটিতে প্রবাহিত পদার্থটি তীব্রভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং এরপর বস্ন্যাক হোল চিরতরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগে প্রচুর পরিমাণে এক্স-রে বিকিরণ করে। বাইনারি এক্স-রে সিস্টেমের একটি উপাদান নক্ষত্র-ঈুমহঁং ঢ-১ রং ধ নষধপশ যড়ষব. উরংপড়াবৎবফ রহ ১৯৭১। মিনি বস্ন্যাক হোল, আরও বিশাল বৈচিত্র্যের মতো, হকিং বিকিরণের মাধ্যমে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভর হারায় এবং অদৃশ্য হয়ে যায়। যদি মহাবিশ্বের কিছু তত্ত্ব যা অতিরিক্ত মাত্রার প্রয়োজন হয়, তা সঠিক হয় লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক মিনি বস্ন্যাক হোল তৈরি করতে পারে। একটি বস্ন্যাক হোলের ভর সাধারণ ও স্বাভাবিক নক্ষত্রের চেয়ে ৬.৫ বিলিয়ন গুণ বেশি। আরো জানার বিষয় হলো প্রতিটি বস্ন্যাক হোলের চারদিকে ডাস্ক ডিস্ক থাকে। বস্ন্যাক হোল মহাজাগতিক ক্ষতিকর রশ্মিগুলোকে ধ্বংস করায় তা পৃথিবীতে ক্ষতিগ্রস্ত রশ্মির বিকিরণ বহুলাংশে ঠেকিয়ে দেয়। ফলে বস্ন্যাক হোলের এই তৎপরতা মানব জাতির জন্য কল্যাণকর হিসেবে বিবেচিত হয়। বস্ন্যাক হোল আসলে কী? এটি নিয়েও জিজ্ঞাসার শেষ নেই। বস্ন্যাক হোল হলো- নাক্ষত্রিক মৃতু্যজনিত কারণে সৃষ্ট মহাকর্ষ শক্তির এক বিশাল আঁধার বা ভান্ডার। অর্থাৎ মহাকাশে সূর্যসহ যেসব নক্ষত্র আছে, তাদের মৃতু্য বা ধ্বংস প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই বস্ন্যাক হোলের জন্ম রহস্যের সূচনা হয়। এই বস্ন্যাক হোল আবার বিভিন্ন আকৃতির আছে। সবচেয়ে বড়গুলোকে সুপার ম্যাসিভ বস্ন্যাক হোল বলা হয়। বস্ন্যাক হোলের জন্ম রহস্য জানতে হলে আগে মহাবিশ্বের বিভিন্ন সৌরজগতের ধ্বংস, সৃষ্টি ও গতিবিধি জানতে হবে। যেমন- ধরুন আমাদের সৌরজগত মিল্কিওয়ে ছায়াপথের একটি মাঝারি সাইজের নক্ষত্র। এই নক্ষত্রপুঞ্জে আরও অনেক ছোট ও বড় নক্ষত্র রয়েছে। আবার ছায়াপথ বা নক্ষত্রপুঞ্জের সংখ্যারও শেষ নেই। এক কথায় মহাকাশ প্রায় অসীম। আমাদের সূর্যের আয়ুস্কাল প্রায় ১০০০ কোটি বছর। এটি এর আয়ুস্কালের অর্ধেক পার করেছে। আরও ৫০০ কোটি বছর এটি সারভাইভ করতে পারবে বলে ধারণা করা যায়। এ রকম সব নক্ষত্রের নির্দিষ্ট আয়ুস্কাল আছে। একটি নক্ষত্রের আয়ুস্কাল নির্ভর করে এর ভেতরে অবস্থিত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাসের মজুতের ওপর। যখন কোনো নক্ষত্র বা সূর্যের হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস পুড়ে পুড়ে আলো ও তাপ উৎপন্ন করতে করতে নিঃশ্বেস হয়ে যায়, তখন এটি লাল হয়ে থালার মতো গোল এবং বিশাল আকার ধারণ করে। একে তখন বলে রেড জায়্যান্ট বা রক্তিম দানব। এই রক্তিম দানবের অবশিষ্ট হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে গেলে পুরো নক্ষত্রটি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে সাদা রং ধারণ করে এবং বাইরের আস্তরণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ সময় এর মধ্যাকর্ষণ শক্তি ধীরে ধীরে খুব কেন্দ্রীভূত হয়ে যায়। তখন এর নাম হয় হোয়াইট ডোয়ারফ বা শ্বেত বামন। এই শ্বেত বামনে পুঞ্জীভূত অস্বাভাবিক ও বিপুল পরিমাণের ভর ও মহাকর্ষ শক্তি প্রবল ঝঞ্জায় বিস্ফোরিত হয়। এর ফলেই একটি বিশাল শুন্যস্থান সৃষ্টি হয় যা অতুলনীয় পরিমাণ মহাকর্ষীয় শক্তি সম্পন্ন। এই প্রবল ভরের, প্রচন্ড মহাকর্ষীয় শক্তি সম্পন্ন এলাকা, গর্ত বা স্থানকেই বস্ন্যাক হোল বলে। পৃথিবীতে বিজ্ঞানীরা ১৯৭১ সালে প্রথম বস্ন্যাক হোলটিকে চিহ্নিত করেন এবং এর নাম দেন সাইনাস এক্স -১। আর মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় বস্ন্যাক হোলের নাম আ্যবেল১২০৪। আমাদের ছায়াপথ মিল্কিওয়ের ঠিক মাঝখানে একটি সুপার ম্যাসিভ বস্ন্যাক হোল আছে, এর ভর ৪.৩ বিলিয়ন কেজি। এই বস্ন্যাক হোলের কাছাকাছি একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল আছে, যেটিকে অতিক্রম করলে কোনো বস্তু আর ফিরে যেতে পারে না। সেটি বস্ন্যাক হোলের গহ্বরে চিরদিনের মতো হারিয়ে যায়। বস্ন্যাক হোল এমনকি আলোকেও খেয়ে ফেলে। আরও মজার ব্যাপার হলো- বস্ন্যাক হোল অন্য নক্ষত্রদেরও খেয়ে ফেলতে পারে। এভাবেই যা কিছু সামনে পায়, তা অধিগ্রহণের মাধ্যমে এটি বড় হয়। আর একারণেই বলা হয়ে থাকে, বস্ন্যাক হোলের আকার দিন দিন বেড়েই চলছে এবং এটি কোনো দিনই ধ্বংস হয়ে যাবে না। তবে এ বিষয়ে ভিন্ন মতও আছে। বিশ্ব বিখ্যাত পদার্থবিদ স্টিফেন হকিংসের মতে, বস্ন্যাক হোল থেকে আলোক কনা বা ফোটন কনা নির্গত হয়। এই কনা নির্গত হতে হতে একদিন বস্ন্যাক হোল মহাশুন্যে মিলিয়ে যাবে, এর অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে- এটাই স্টিফেন হকিং বিশ্বাস করেন। যদিও এই মতের সঙ্গে অনেক বিজ্ঞানী একমত নন, তবুও এটিই বস্ন্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের সম্ভাব্য ধ্বংসের কাহিনী। যদিও বস্ন্যাক হোল সম্পর্কে আমাদের জানার আরও অনেক কিছুই বাকি আছে, আমরা মানব জাতির সদস্যরা সেগুলো জানতে নিশ্চয়ই চেষ্টা চালিয়ে যাব।