ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
প্রকাশ | ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
হাবিবুর রনি ও মুসাদ্দিকুল ইসলাম তানভীর
সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে, কুমিলস্নার বুড়িচং উপজেলার ছোট্ট গ্রাম বাকশীমূল। বর্ষায় বন্যায় ভেসে যাওয়া বাড়িঘর, ক্ষতিগ্রস্ত খামার এবং ভাঙা স্বপ্ন নিয়ে এখানে চলছে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। কৃষকরা মুখে মুখে একে অন্যকে বলছেন, 'কীভাবে আবার শুরু করা যায়?' তাদের সেই নতুন শুরুর গল্পে আশার আলো হয়ে এসেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পিএইচডি শিক্ষার্থীদের একটি দল।
ঠিক একই সময় লক্ষ্ণীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার কৃষকরাও ঘুরে দাঁড়ানোর আশায় বিভোর। তাদের এই ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে শামিল হয়েছে 'এগ্রি স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স বাংলাদেশ' সংগঠনের বাকৃবির শিক্ষার্থীরা। বীজধানের প্রত্যাশায় সারা দিন অপেক্ষা করাও যেন হার মেনে যায় শেষ বেলার হাসিতে।
বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া, ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন পুনর্গঠনের এই মহাযজ্ঞে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে বাকৃবি শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসেছে কৃষকের মাঠে, হাতে তুলে নিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ঘুরে দাঁড়ানোর হাতিয়ার- বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল, উন্নত ঘাসের বীজ, সার, কীটনাশক আর পশুচিকিৎসার সেবা। শুধু ত্রাণ নয়, তারা তৈরি করেছে এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, যেন কৃষকরা এই ক্ষতি কাটিয়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারেন। তাইতো তারা একেকটি টিম হয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন দেশের একেকটি জেলায়। ছড়িয়ে দিয়েছেন মানবতা।
বীজধানে নতুন স্বপ্নের বুনন
'আজ গ্রামে আসছেন বাকৃবির শিক্ষার্থীরা।' ঠিক এই কথাটা শোনার পর মুহূর্তেই সারা গ্রামে ছড়িয়ে যায়। কুমিলস্না থেকে নোয়াখালী, ফেনী থেকে লক্ষ্ণীপুর, যেখানেই গিয়েছেন বাকৃবি শিক্ষার্থীরা, সকাল থেকেই শুরু হয়ছে অন্যরকম প্রাণচাঞ্চল্য। উদ্দেশ্য কৃষকদের মাঝে বীজদান বিতরণ করে নতুন স্বপ্নের বীজ বপন করা। কয়েক ধাপে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ২০০, কুমিলস্নার দেবিদ্বারে ৫০ এবং ফেনীর সোনাগাজীতে ৫০, লক্ষ্ণীপুরের কমলনগরে ৪০, রায়পুরে ৪০ এবং রামগঞ্জে ২০ জন কৃষকের প্রত্যেককে ২০ শতাংশ জমির জন্য বিনা ধান-১৭ বীজধানের চারা, সার ও কীটনাশক দেওয়া হয় এগ্রি স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। আর বুড়িচংয়ের বাকশীমূল গ্রামে বাকৃবির পিএইচডি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের ক্যাম্পেইনে ২০০ খামারিকে উন্নত অস্ট্রেলিয়ান সুইট জাম্বু হাইব্রিড ঘাসের বীজ এবং পাকচুং ঘাসের কাটিং সরবরাহ করা হয়। তাদের প্রতিশ্রম্নতি এই ঘাস একবার রোপণ করলে তা ৪ থেকে ৫ বছর উৎপাদন দেবে। এমনকি ৩ বিঘা জমিতে একটি প্যাকেটের বীজ দিয়েই চারা উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
গবাদি পশুর জন্য স্বাস্থ্যসেবা
কুমিলস্নায় পিএইচডি শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পেইনে ২০০টি গরুকে লাম্পি স্কিন রোগের টিকা দেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞ পশু চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গরু ও ছাগলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ওষুধ সরবরাহ এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শও দেওয়া হয়। বাকৃবির ভেটেরিনারি অনুষদের বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীদের অন্য আরেকটি ক্যাম্প পরিচালিত হয় শেরপুরে। এ সময় ৩০০ জন খামারির পশুদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিতরণ করা হয়। ক্যাম্পে প্রায় ১০০টি গরুকে তড়কা ও বাদলা রোগের ভ্যাকসিন এবং ৫০টি ছাগলকে পিপিআর ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়। তাদের এই উদ্যোগ যেন আশ্রয়হীন খামারিদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করে।
ছাগল ও মুরগি, নতুন জীবনের হাতিয়ার
শেরপুরে বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য ৭২ জন অসহায় নারীকে বিনামূল্যে অধিক ডিম ও মাংস উৎপাদনশীল ফাওমি, রড আইল্যান্ড রেড জাতের মুরগি দেওয়া হয়। প্রতিজনকে ৪টি করে মুরগি এবং ১?টি করে মোরগসহ মোট ৩৬০টি মোরগ-মুরগি বিতরণ করা হয়। এদিকে পিএইডি শিক্ষার্থীদের কর্মসূচির আরেকটি বিশেষ দিক ছিল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১১টি দরিদ্র পরিবারের মাঝে বস্ন্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিতরণ। এর মধ্য দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আবার নতুন করে নিজেদের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে পারবে। এ সময় গিয়াস উদ্দিন নামে এক কৃষক এই ছাগল পেয়ে আবেগে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, 'ছাগল পাইয়া আমি অনেক খুশি। স্যারদের আলস্নাহ ভালো করুক। উনারা আমাদের জন্য একটা সিঁড়ি তৈরি করে দিয়ে গেলেন, যাতে এই ছাগল পালার মাধ্যমে আমরা ওই সিঁড়ি বাইয়া উঠবার পারি।'