বার্ড ফ্লু সাধারণভাবে ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় একটি রোগ। এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা নামক ভাইরাসের সংক্রমণে এই রোগ হয়। বার্ড ফ্লুকে, বার্ড ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং এভিয়ান ফ্লু নামেও ডাকা হয়। বার্ড ফ্লু ভাইরাসের নাম এইচ ফাইভ এন ওয়ান (ঐ৫ঘ১)। ভাইরাসবাহিত এই রোগটি পাখিদের সংক্রমিত করে। পাখিরা খুব দ্রম্নত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যেতে পারে বলে এই রোগ দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়তে পারে। আবার প্রকৃতিতে স্বাধীনভাবে বিচরণ করা পাখির মাধ্যমে এই রোগ সহজেই গৃহপালিত পাখিতে সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত পশুপাখির প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে অথবা বর্জ্য থেকে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে অন্য ব্যক্তির মধ্যে, আক্রান্ত পাখির ডিম বা মাংস সঠিকভাবে সিদ্ধ করে না খেলে বার্ড ফ্লু হতে পারে।
শীত মৌসুমে বাংলাদেশে বার্ড-ফ্লুর সংক্রমণ ঘটে বেশি। ২০০৬ সালে প্রথম এই ফ্লুর সংক্রমণ হয়। তখন খামারির সংখ্যা ছিল দেড় লাখেরও বেশি। ২০০৭-২০০৯ সালে দেশে অত্যন্ত ব্যাপক হারে ফ্লুর সংক্রমণ ঘটে। এর জীবাণু বার্ড ফ্লু আক্রান্ত হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য পাখির মল, রক্ত ও শ্বাসনালিতে বাস করে। এই রোগ পাশাপাশি একই জাতের, একই বয়সের মুরগির থাকে, তাহলে এই রোগ খুব দ্রম্নত ছড়ায় এবং ভাইরাসটাও তত দ্রম্নত আরও ভয়ংকররূপে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। মানুষ ঘটনাচক্রে এই রোগে আক্রান্ত হয়। এই রোগটি সাধারণত শুরু হয় জ্বর-সর্দি-কাশির মাধ্যমে এবং পরে তা মারাত্মক নিউমোনিয়ার রূপ ধারণ করে, যার পরিণতি হচ্ছে মৃতু্য।
শনাক্তকরণ
বার্ড ফ্লু নির্ণয়ের ক্ষেত্রে, রক্তে এই ভাইরাসের এন্টিবডি পিসিআর পদ্ধতি দেখে ভাইরাসটি শনাক্ত করা যায়। সাধারণত ভাইরাস কালচার বা ভাইরাস এনটিজেন, আর এনএআরটিপিসিআর দিয়ে নাক ও মুখগহ্বর থেকে লালার নমুনা নিয়ে এই রোগ নির্ণয় করা হয়ে থাকে।
লক্ষণ
সাধারণত সংক্রমণের ১-৩ দিন পর সাধারণ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই রোগীর ঠান্ডার লক্ষণ প্রকাশ পায় যেমন- জ্বর, গা-ব্যথা, গা ম্যাজম্যাজ করা, ঠান্ডা লাগা, হাঁচি, কাশি, মাথাব্যথা, মাংসপেশি ব্যথা, বমি, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি। বার্ড ফ্লুর লক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে খুব সামান্য হতে পারে আবার অনেক ক্ষেত্রে অত্যন্ত তীব্র হতে পারে, যেখানে মৃতু্যঝুঁকি বেড়ে যায়। পরে অবস্থা জটিল হলে অনেক ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের সংক্রমণ বা এনসেফালাইটিস, হৃৎপিন্ডের সংক্রমণ বা মায়োকার্ডাটাই, মাংসপেশিতে সংক্রমণ বা মায়োসাইটিস ইত্যাদি হতে পারে। বার্ড ফ্লু হলো ইনফ্লুয়েঞ্জার তীব্র একটি রূপ।
\হপ্রতিরোধে করণীয়-
১. খালি হাতে অসুস্থ বা অস্বাভাবিক মৃতু্য হয়েছে- এমন হাঁস বা মুরগি বা অন্যান্য পাখি ধরা বা নাড়াচাড়া করা যাবে না।
২. বাড়িতে রোগে আক্রান্ত হাঁস-মুরগি জবাই করা বা পালক ছাড়ানো অথবা নাড়াচাড়া করা যাবে না।
৩. রোগে আক্রান্ত হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য পাখি ধরাছোঁয়া ও সেগুলো নিয়ে খেলাধুলা করা থেকে শিশুদের বিরত রাখতে হবে।
৪. আক্রান্ত পাখিদের বিষ্ঠায় অতিরিক্ত পরিমাণে এই ভাইরাস পাওয়া যায়। তাই যারা ঘরে পাখি পালন করেন, তাদের ঘরে পাখির বিষ্ঠার মাধ্যমে শিশু ও বড়দের মধ্যে জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই হাঁস, মুরগি বা পশুপাখি ধরার পর ভালো করে সাবান বা ছাই এবং পানি দিয়ে দুই হাত ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
৫. হাঁস, মুরগি বা পশুপাখির ঘরে কাজ করার ক্ষেত্রে, কাপড় দিয়ে নাক ও মুখ ভালোভাবে ঢেকে নিতে হবে। পশুপাখি নাড়াচাড়ার পর হাত না ধুয়ে চোখ, নাক বা মুখ স্পর্শ করা যাবে না।
৬. হাঁস, মুরগির মাংস ভালোভাবে সিদ্ধ করে রান্না করতে হবে। আধা সিদ্ধ মাংস, ডিম বা মাংসের তৈরি খাবার খেলে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
৭. বার্ড ফ্লু আক্রান্ত এলাকা অর্থাৎ যেখানে এই রোগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে- এমন স্থানে বা এর আশপাশে যারা বাস করেন, তাদের হাঁস, মুরগি বা অন্যান্য পাখি ক্রয়-বিক্রয় বা জবাই করার স্থান থেকে দূরে থাকতে হবে।
৮. রোগে আক্রান্ত হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য পাখির মল সার অথবা মাছের খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে না।
৯. মৃত হাঁস, মুরগি এবং পাখি মাটিতে পুঁতে ফেলার সময় অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
১০. হাঁস, মুরগি বা অন্যান্য পাখি ধরার পর যদি কেউ জ্বর, সর্দি কিংবা কাশি জাতীয় কোনো রোগে ভোগেন, তাহলে দ্রম্নত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে এবং অবশ্যই রোগে আক্রান্ত বা মৃত হাঁস, মুরগির সংস্পর্শে আসার বিষয়টি চিকিৎসককে জানাতে হবে।
১১. যদি কোথাও হঠাৎ হাঁস-মুরগি বা অন্যান্য পাখি অস্বাভাবিক হারে মারা যায়, তবে সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ড কমিশনার অথবা উপজেলা পশুসম্পদ দপ্তরে জানাতে হবে। মৃত হাঁস-মুরগি এবং পাখি মাটিতে পুঁতে ফেলার সময় অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।