মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

জেনেটিক মেমোরি ও আমাদের স্মৃতি নির্মাণ

জেনেটিক মেমোরি বলে আরেক ধরনের স্মৃতি নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন গবেষণা করছেন। এই স্মৃতির অস্তিত্বের বিষয়ে তারা একমত হলেও, কীভাবে এই স্মৃতি কাজ করে, তা সুস্পষ্ট করতে আরও সময়ের প্রয়োজন হবে। জেনেটিক মেমোরিকে মনোবিজ্ঞানীরা সেই ধরনের স্মৃতি বলছেন, যে স্মৃতি নির্মাণে ইন্দ্রিয় অনুভূতির কোনো ইনপুট নেই। জন্মের পর শিশুর মধ্যে ভাষাসহ বেশ কিছু স্মৃতি প্রোথিত থাকে। এই স্মৃতি জেগে ওঠে পরিবেশ থেকে ইনপুট এলে। জেনেটিক মেমোরিকে এক ধরনের বায়োলজিক্যাল মেমোরিও বলা যেতে পারে।
তানভীর আমিন
  ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
জেনেটিক মেমোরি ও আমাদের স্মৃতি নির্মাণ

স্মৃতি-বিষয়ক ধারণার অন্যতম অর্জন হিসেবে কার্যকর স্মৃতিকে (ড়িৎশরহম সবসড়ৎু) অনেক বিজ্ঞানী দেখে থাকেন। মস্তিষ্ক কোনো স্মৃতিকেই হারিয়ে ফেলে না। সচেতন মনে হোক, আর অবচেতন মনেই হোক মস্তিষ্ক প্রতিটি স্মৃতিকে ধরে রাখে। অবচেতন স্মৃতিগুলোকে ধরে রাখে পরিবর্তিত প্রোটিনের মাধ্যমে। এরপর আমরা যদি স্মৃতির অন্য বিভাজনকেও বিবেচনায় নেই যেমন- সেনসরি মেমোরি, জেনেটিক মেমোরি প্রভৃতি সব স্মৃতিকেই মস্তিষ্ক ব্যবহার করার উদ্দেশে কার্যকর স্মৃতিতে রূপান্তর করতে পারে। কার্যকর স্মৃতির কেন্দ্রীয় পরিচালনা (ঈবহঃৎধষ ঊীবপঁঃরড়হ) হয়ে থাকে উচ্চতর মস্তিষ্কে বা সেরেব্রাল কর্টেক্সে। মূল পরিচালনাটা হয় ফ্রন্টলি লোপে একেবারে সামনে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে। প্রিফ্রন্টলি কটেক্সের কাজ পরিচালনায় সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করে সেরেব্রাল কর্টেক্সের অন্যান্য লোব বা অংশ অর্থাৎ টেমপোরাল লোব, প্যারেইটলি লোব এবং অক্সিপিটাল লোব। কার্যকর স্মৃতিকে কাজে লাগিয়ে যে ঈবহঃৎধষ ঊীবপঁঃরড়হ তা আসলে পুরনো স্মৃতিকে ঝালিয়ে নেওয়া, নতুন স্মৃতি তৈরি করার অন্যতম ধাপ। স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিকে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে পরিণত করার জন্য হিপোকাসপাম আসলে ঈবহঃৎধষ বীবপঁঃরড়হ-এর সহযোগিতা নেয়। তবে ঘুমের মধ্যে যখন হিপোক্সসপাস স্বল্পস্থায়ী স্মৃতিকে দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে পরিণত করে তখন ঈবহঃৎধষ ঊীবপঁঃরড়হ ঢ়বৎপবহঃং-এর সাহায্য নেয় কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ-সংক্রান্ত গবেষণা এখনো চলমান। আম্পি ডালা ইমোশনাল মেমোরি তৈরির সময় ঈবহঃৎধষ ঊীবপঁঃরড়হ-এর সাহায্য নেয়।

ঈবহঃৎধষ ঊীবপঁঃরড়হ-কে অনেক বিজ্ঞানী সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগের ধাপ হিসেবে বলে থাকেন। এই ধাপকে তারা বলার চেষ্টা করছেন চিন্তনের ধাপ বা পরিকল্পনার ধাপ। ঈবহঃৎধষ ঊীবপঁঃরড়হ-এর মাধ্যমে চিন্তন বা পরিকল্পনা করে মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বা প্রতিক্রিয়া দেখায়। কিছু কিছু প্রতিক্রিয়া যেগুলো অবচেতনভাবে হয় মানে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয় সেগুলো প্রিফ্রন্টলি কর্টেক্সে ঈবহঃৎধষ ঊীবপঁঃরড়হ-এর প্রয়োজন পড়ে না। মধ্য মস্তিষ্ক থেকে স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই সেগুলো সংঘটিত হয়।

ঈবহঃৎধষ ঊীবপঁঃরড়হ-এর সময় একটি একক স্নায়ু প্রতিনিধি আসতে পারে, আবার স্নায়ু দলের মাধ্যমে গঠিত টপোগ্রাফিক্যাল উপস্থাপনা বা লুপ (ঞড়ঢ়ড়মৎধঢ়যরপধষ ঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ ড়হ ষড়ড়ঢ়)-এর প্রতিনিধি আসতে পারে। এই প্রতিনিধি এসে গঠন করে কেন্দ্রীয় টপোগ্রাফিক্যাল উপস্থাপনা (ঈবহঃৎধষ :ড়ঢ়ড়মৎধঢ়যরপধষ ঢ়ৎবংবহঃধঃরড়হ)। এই কেন্দ্রীয় টপোগ্রাফিক্যাল উপস্থাপনাই হচ্ছে মানুষের (অন্য অনেক জীবেরও) মানসিক কার্যক্রমের ভিত্তি। এটা যেহেতু মানসিক কার্যক্রমের ভিত্তি, তাই এটা চিন্তনের ভিত্তি। এটা পরিকল্পনার ভিত্তি। এটা ব্যক্তিত্বেরও ভিত্তি। একজন ব্যক্তি কীরূপ হবে, তা নির্ভর করে সে তার অভিজ্ঞতাকে কীভাবে ঈবহঃৎধষ ঊীবপঁঃরড়হ করে। সে কীভাবে ঈবহঃৎধষ ঊীবপঁঃরড়হ করে, তা তার কেন্দ্রীয় স্নায়ুবিক উপস্থাপনা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়। প্রতিটি মুহূর্তের জন্য, আবার প্রতিটি বিষয়ের জন্য কেন্দ্রীয় স্নায়ুবিক উপস্থাপনা তৈরি হয়। তাই একজন মানুষ তার সারা জীবনে অসংখ্য কেন্দ্রীয় স্নায়ুবিক উপস্থাপনা করে। এই কেন্দ্রীয় স্নায়ুবিক উপস্থাপনাগুলোও মস্তিষ্কের মেমোরি সিস্টেম স্মৃতি গঠন বা সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধরে রাখে। দেখা যায়, পুরনো কেন্দ্রীয় উপস্থাপনাকে স্মৃতি থেকে ধরে নিয়ে এসে নতুন উপস্থাপনা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

পুরনো যে স্মৃতিকে কেন্দ্রীয় স্নায়ুবিক উপস্থাপনায় নিয়ে এসে ঈবহঃৎধষ ঊীবপঁঃরড়হ করা হয়, সে স্মৃতিকেই বলা হয় কার্যকর স্মৃতি (ড়িৎশরহম সবসড়ৎু)। পুরনো সেনসরি বা মটর স্মৃতিকে যখন কার্যকর স্মৃতিতে পরিণত করা হয় তখন বলা হয় অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে, আর পুরনো কেন্দ্রীয় উপস্থাপনার স্মৃতিকে যখন কার্যকর স্মৃতিতে পরিণত করা হয় তখন বলা হয় চিন্তন বা পরিকল্পনাকে কাজে লাগানো হচ্ছে।

মানুষের ভাষাগত স্মৃতিতে চিন্তন বা পরিকল্পনা সম্পর্কিত স্মৃতিই বেশি। কারণ, ভাষার উপাদানগুলোকে (ধ্বনি, শব্দ, বাক্য প্রভৃতি) কাজে লাগিয়ে চিন্তন বা পরিকল্পনা মানুষ বেশি করে। তাই সেই প্রসেসড তথ্য (চৎড়পবংংবফ ওহভড়ৎসধঃরড়হ) ভাষা অঞ্চলের স্মৃতিভান্ডারে জমা থাকে। প্রয়োজন পড়লে সেই স্মৃতিভান্ডার থেকে নিয়ে আসা হয়। ভাষা অঞ্চল এমন একটি অঞ্চল যে অঞ্চল নিমের মতো করে অন্যান্য যে কোনো ধরনের তথ্য যেমন- দৃশ্যসহ সব সেনসরি তথ্য, মটরগত তথ্য, আবেগীয় তথ্য, স্থান-কালের তথ্য সংরক্ষণ এবং বীবপঁঃরড়হ করতে পারে। ভাষা মানুষের একটি অন্যতম স্নায়ুবিক অর্জন।

জেনেটিক মেমোরি বলে বিশেষ এক ধরনের স্মৃতি নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন গবেষণা করছেন। এই স্মৃতির অস্তিত্বের বিষয়ে তারা একমত হলেও, কীভাবে এই স্মৃতি কাজ করে তা সুস্পষ্ট করতে আরও সময়ের প্রয়োজন হবে। জেনেটিক মেমোরিকে মনোবিজ্ঞানীরা সেই ধরনের স্মৃতি বলছেন যে, স্মৃতি নির্মাণে ইন্দ্রিয় অনুভূতির কোনো ইনপুট নেই। জন্মের পর শিশুর মধ্যে ভাষাসহ বেশ কিছু স্মৃতি প্রোথিত থাকে। এই স্মৃতি জেগে ওঠে পরিবেশ থেকে ইনপুট এলে। জেনেটিক মেমোরিকে এক ধরনের বায়োলজিক্যাল মেমোরিও বলা যেতে পারে।

যা হোক, স্মৃতি ও শিক্ষার সঙ্গে জড়িত আরেকটি বিষয় খুবই চিত্তাকর্ষক। তা হলো টপোগ্রাফিক্যাল উপস্থাপনার সঙ্গে স্মৃতি ও শিক্ষাকে জড়িত করে ফেলা। প্রতিটি ইন্দ্রিয় এমনকি মটর অঞ্চলে স্নায়ুগুলোর একটি বিশেষ উপস্থাপনা তৈরি হয়। একেক এলাকায় একেকটি উপস্থাপনা। এই উপস্থাপনাগুলোর প্রতিচ্ছবি আবার মস্তিষ্কের কেন্দ্রীয় পরিচালনা অঞ্চল প্রিফ্রন্টলি কর্টেক্সে সব উপস্থাপনার সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় টপোগ্রাফিক্যাল উপস্থাপনা হয়। এই উপস্থাপনাকে বলা যেতে পারে মানসিক প্রক্রিয়ার কেন্দ্রীয় একটি জায়গা। যেখানে চিন্তন ঘটে, ঘটে পরিকল্পনা আর সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো উচ্চতর কগনিটিভ কার্যক্রম। প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের এই জায়গাটি চিন্তন পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি স্মৃতি নির্মাণের সঙ্গেও রয়েছে এ উপস্থাপনার যোগসূত্র। এই উপস্থাপনায় অন্যান্য অঞ্চলের উপস্থাপনা এবং তথ্য আসে কার্যকর স্মৃতি হিসেবে। কী কী কার্যকর স্মৃতি একটি কেন্দ্রীয় উপস্থাপনায় কোনো মুহূর্তে আসতে তা নির্ভর করে পরিস্থিতি, পরিবেশ এবং মনোযোগের ওপর। বলা যায়, প্রিফ্রন্টলি কর্টেক্সে কেন্দ্রীয় টপোগ্রাফিক্যাল উপস্থাপনার মাধ্যমে সচেতন দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঘটে থাকে।

স্মৃতির বংশগতি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দুটি জিনের দিকে বিশেষভাবে মনোযোগী হয়েছেন। জিন দুটি হচ্ছে এপিওই (অচঙঊ) এপিলিপ্রোটিন ই জিন ও কিবরা জিন।

দুটি জিনই প্রোটিন সম্পর্কিত কার্যক্রমে সক্রিয় থেকে ভূমিকা রাখে স্মৃতি প্রক্রিয়ায়। অর্থাৎ স্নায়ুকে স্মৃতি সংরক্ষণ এবং স্মৃতি ব্যবহারে পারদর্শী করতে একটি জিন গ্রম্নপ কাজ করে। সে জিন গ্রম্নপের অন্যতম সদস্য হচ্ছে এপিওই ও কিবরা জিন। স্মৃতি সম্পর্কিত রোগ যেমন- অ্যালকোইমায়মসহ নানারকম রোগ সেগুলো ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছে- এপিওই, কিবরা প্রভৃতি জিনের ত্রম্নটির মাধ্যমে।

আমরা স্মৃতি নির্মাণ প্রক্রিয়ার সহযোগিতা নিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করি। স্মৃতির রয়েছে নানাবিধ রকমসকম। প্রথমেই চলে আসে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে তথ্য মানুষ গ্রহণ করে, সে তথ্যের স্মৃতি। এই স্মৃতিকে বলা হয় সেনসরি মেমোরি (ঝবহংড়ৎু গবসড়ৎু), অল্প কয়েক সেকেন্ডের এই মেমোরি। এই মেমোরি পরে স্বল্পস্থায়ী স্মৃতি ও দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি প্রক্রিয়ার অংশ হয়ে যায়।

স্বল্পস্থায়ী স্মৃতি হচ্ছে, তাই যা অল্প কিছু সময় মনে থাকে। যে স্মৃতি নির্মাণে নতুন কোনো জিনের প্রয়োজন পড়ে না। দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি হচ্ছে, সে স্মৃতি যে স্মৃতি অনেকক্ষণ মনে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে সারা জীবন মনে থাকে। এই স্মৃতি নির্মাণ প্রক্রিয়ার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই স্মৃতি নির্মাণের সময় মস্তিষ্কে নতুন জিন সক্রিয় হয়।

জেনেটিক মেমোরি বলে আরেক ধরনের স্মৃতি নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন গবেষণা করছেন। এই স্মৃতির অস্তিত্বের বিষয়ে তারা একমত হলেও, কীভাবে এই স্মৃতি কাজ করে, তা সুস্পষ্ট করতে আরও সময়ের প্রয়োজন হবে। জেনেটিক মেমোরিকে মনোবিজ্ঞানীরা সেই ধরনের স্মৃতি বলছেন, যে স্মৃতি নির্মাণে ইন্দ্রিয় অনুভূতির কোনো ইনপুট নেই। জন্মের পর শিশুর মধ্যে ভাষাসহ বেশ কিছু স্মৃতি প্রোথিত থাকে। এই স্মৃতি জেগে ওঠে পরিবেশ থেকে ইনপুট এলে। জেনেটিক মেমোরিকে এক ধরনের বায়োলজিক্যাল মেমোরিও বলা যেতে পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে