বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

পরিবেশবান্ধব উপায়ে বায়ুদূষণ কমাতে আধুনিক প্রযুক্তি

মো. সজীবুর রহমান
  ০৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
পরিবেশবান্ধব উপায়ে বায়ুদূষণ কমাতে আধুনিক প্রযুক্তি

সম্প্রতি বায়ু গুণমান সূচকের (অছও) প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী ঢাকা শহর বায়ুদূষণের দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ঢাকা শহরের বায়ু এখানে বসবাসরত মানুষের জন্য অস্বাস্থ্যকর ও অত্যন্ত বিপজ্জনক। বর্তমানে ঢাকার বায়ুদূষণ কমানোর জন্য নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেগুলোর কার্যকারিতা খুবই কম। একদিকে দিন দিন বেড়েই চলেছে ঢাকার জনসংখ্যা ও যানবাহন, অন্যদিকে ঢাকা সিটির মধ্যে নেই গাছ লাগানোর পর্যাপ্ত জায়গা। এ সমস্যার সমাধান দিতে পারে সার্বিয়ান প্রযুক্তিতে উদ্ভাবিত স্বাভাবিক গাছের বিকল্প 'তরল গাছ' বা (খরয়ঁরফ ঞৎবব)। এই নতুন প্রযুক্তি কম খরচে, পরিবেশবান্ধব উপায়ে বায়ুদূষণ কমাতে পারে স্বাভাবিক গাছের তুলনায় ১০ থেকে ৫০ গুণ বেশি।

মূলত ২০২০ সালে বায়ুদূষণের দিক থেকে সার্বিয়া পৃথিবীর মধ্যে ২৮তম স্থানে ছিল। দেশটির বায়ুদূষণের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি থাকায় সার্বিয়ান বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক বায়ুদূষণ কমানোর জন্য একটি বায়োলজিক্যাল রিয়েক্টর তৈরি করেন। যেখানে প্রায় ছয়শ' লিটার পানি ও মাইক্রোঅ্যালগি (শৈবাল) সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বিক্রিয়া করে বাতাস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে এবং বিশুদ্ধ অক্সিজেন বাতাসে ত্যাগ করে। এই প্রযুক্তির নাম দেওয়া হয় 'তরল গাছ' বা (খরয়ঁরফ ঞৎবব), যার বিশেষ সুবিধা হলো বায়ু পরিশোধনে এটি একটি প্রাপ্ত বয়স্ক গাছের তুলনায় ১০ থেকে ৫০ গুণ বেশি কার্যকর। এছাড়াও রিয়েক্টরটি যেকোনো রাস্তায় বা ভবনের ছাদে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।

রিয়েক্টরটিতে প্রতি দেড় মাসে, নতুন পানি এবং খনিজ ঢালা হয় শৈবালের বৃদ্ধি ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। তাছাড়াও এই পানি পরবর্তীতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও শৈবালগুলো পরবর্তীতে সার বা কম্পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এটি গরম বা ঠান্ডা যেকোনো আবহাওয়ায় কাজ করতে পারে।

সার্বিয়ান রাস্তায় বায়ুদূষণ রোধসহ আরও বিভিন্ন কাজে ব্যবহার রিয়েক্টরটি করা হয় যেমন, এটি একটি বেঞ্চ হিসেবেও কাজ করে, এতে মোবাইল ফোনের জন্য চার্জার রয়েছে, সেইসাথে একটি সোলার প্যানেল রয়েছে, যাতে করে বেঞ্চে রাতের বেলায় আলো থাকে।

গবেষক দলের প্রধান ড. ইভান স্পাসোজেভিকের মতে, তারা বায়ুদূষণ রোধে এককোষী মিঠা পানির শৈবাল ব্যবহার করেছে, যা সার্বিয়ার পুকুর এবং জলাশয়ে বিদ্যমান। এই প্রজাতির শৈবাল স্বাভাবিকভাবে পানিতে বৃদ্ধি হতে পারে এবং উচ্চ এবং নিম্ন তাপমাত্রার প্রতিরোধী তাই সিস্টেমটির বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হয় না। শৈবালগুলো পরবর্তীতে সার বা কম্পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়াও কলকারখানার বর্জ্য পানি ও বায়ু পরিশোধনের জন্য তারা মূলত এই শৈবাল ব্যবহার করেছেন।

তাদের এই প্রযুক্তির মূল লক্ষ্য বন বা বৃক্ষ রোপণের পরিকল্পনা প্রতিস্থাপন করা নয় বরং এই ব্যবস্থাটি ব্যবহার করে সেই সব শহুরে পকেটগুলো পূরণ করা যেখানে গাছ লাগানোর জন্য কোনো জায়গা নেই। তীব্র দূষণের পরিস্থিতিতে, যেমন বেলগ্রেডে, অনেক গাছ বাঁচতে পারে না, আবার চারা গাছের রক্ষণাবেক্ষণ করাও অনেক ঝামেলার এবং বড় হতেও অনেক সময় লাগে। সে তুলনায় এই নতুন প্রযুক্তি কম সময়ে ও খরচে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বায়ুদূষণ কমাতে পারে।

আমরা সবাই জানি, একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছ বছরে প্রায় ১৫০ কেজি কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে কিন্তু একটি মাত্র যাত্রীবাহী বাস বছরে ৪.৬ মেট্রিক টন কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে।

সেই ক্ষেত্রে আমাদের ঢাকা শহরে কথা কল্পনা করলে বায়ুদূষণ কমাতে আমাদের কী পরিমাণ গাছ লাগানো উচিত বা দরকার সেটা আমরা সবাই ধারণা করতে পারছি। কিন্তু আমাদের আসলেই কি এই পরিমাণ ফাঁকা জায়গা আছে? উত্তরটা আমাদের সবারই জানা আছে। এই অবস্থায় আমাদের ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ রোধের একমাত্র উপায় হতে পারে সার্বিয়ান এই তরল গাছ। পার্কের বসার বেঞ্চের সমান এই প্রযুক্তিটি ১০ বছর বয়সি দুটি গাছ বা ২০০ স্কয়ার মিটার ঘাসের সমপরিমাণ বায়ু পরিশোধন করতে পারে। পাশাপাশি প্রযুক্তিটি পরিবেশবান্ধব ও অর্থ সাশ্রয়ী, দেখাশোনা বা মেকানিক্যাল খরচও খুব কম। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন মেগা সিটিগুলোতে বায়ুদূষণ রোধের জন্য এই প্রযুক্তি বসানোর কার্যক্রম চলছে।

ভবিষ্যতে আমাদের ঢাকা শহরের বায়ুদূষণ রোধের জন্য এটি একটি কার্যকরী ব্যবস্থা হতে পারে। যদিও এই প্রযুক্তিকে কখনই গাছের বিকল্প হিসেবে কল্পনা করা যায় না। এটি শুধুমাত্র আমাদের পরিবেশের কিছুটা দূষিত বায়ুকে পরিশোধন করে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়াতে পারে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকাসহ অন্যান্য দূষিত শহরের বায়ু দূষণরোধে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের পরিবেশের জন্য গাছের ভূমিকা অনন্য। তাই এই ধরনের প্রযুক্তির পাশাপাশি পরিবেশ বাঁচাতে গাছ লাগানোর কোনো বিকল্প নেই। আসুন আমরা সবাই মিলে পরিবেশ বাঁচাতে কাজ করি, বেশি বেশি বৃক্ষ রোপণ করি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে