বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২

ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা মূলত নারী

নন্দিনী ডেস্ক
  ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা মূলত নারী
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা মূলত নারী

অর্থনীতির মূল খাতে বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণ আশির দশকের শেষভাগে তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। নারী সর্বদাই এ দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে এসেছে। তৈরি পোশাক খাত ছাড়াও অন্যান্য খাতে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপক এবং তা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি কৃষিতেও তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কৃষিক্ষেত্রে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে হ্রাস পেয়েছে সেখানে নারীর অংশগ্রহণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে লক্ষণীয়ভাবে। সেখানে জাতীয় আয়ে নারীর অবদান অতি নগণ্য। এর মূল কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পায় সেগুলো হলো- উৎপাদনশীল পরিমন্ডলের সিংহভাগ ক্ষেত্রে নারীকে অনুৎপাদনশীল ও কেবল ভোগকারী হিসেবে চিহ্নিত করা। উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে, যেমন- কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণকে যথাযথভাবে জাতীয় পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত না করা, নারীর গৃহস্থালির কাজ অর্থনৈতিক কাজ হিসেবে গণ্য না করা।

এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে ও গৃহস্থালির কাজে নারীর সমন্বিত অংশগ্রহণকে একটি পরিমাপযোগ্য একক মানদন্ডে আনা তুলনামূলক পরিসংখ্যান পদ্ধতির অভাব।

আবহমানকাল ধরেই বাংলাদেশে কুটির শিল্পে নারীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। চুন তৈরি, ঠোঙা তৈরি, বাঁশ ও বেতশিল্প, তাঁত বোনা, জাল বোনা, ছোবড়া শিল্প, মাদুর বোনা শিল্প ইত্যাদিতে নারীর উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া, নকশিকাঁথা তৈরি, কাচ, মোম, শোলা ইত্যাদি দিয়ে বিভিন্ন শৌখিনসামগ্রী তৈরির শিল্পে, বস্নক বাটিক, টাই ডাই ইত্যাদি শিল্পে প্রায় এককভাবে নারীরা অবদান রেখে যাচ্ছেন। নব্বইয়ের দশক থেকে 'বুটিক' শিল্পের মাধ্যমে যে নবজাগরণ এসেছে তাতে কুটির শিল্পে নারীর সম্পৃক্ততা বেড়েছে বহুগুণে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কুটির শিল্পে নারীর কাজগুলোকে নারীর গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ফেলা হয়। ফলে, কুটির শিল্পে নারীর এ বিস্তৃত অংশগ্রহণ একদিকে যেমন জাতীয় পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয় সামান্যই; অন্যদিকে, জাতীয় আয়েও নারীর এ অবদান স্বীকৃতি পায় সামান্যই। শিক্ষা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি নানা ধরনের নারীবান্ধব কর্মসূচির ফলে কুটির শিল্প খাতে নিয়োজিত নারীদের অনেকেই আনুষ্ঠানিক খাতে উদ্যোগ নিচ্ছেন। কুটির শিল্পে নিয়োজিত অনেক নারী তাদের ব্যবসায়িক সাফল্যের কারণে কারখানা বর্ধিত করে ক্ষুদ্র শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। তবে বাংলাদেশে বড় নারী উদ্যোক্তাদের যাত্রাটা শুরু হয়েছে মূলত পারিবারিকভাবে বিশেষ করে বাবার ব্যবসার হাল ধরে কিংবা স্বামীর অংশীদার হয়ে উদ্যোক্তা সম্প্রসারণ হয়েছে। তবে নারী উদ্যোক্তা বৃদ্ধি পেয়েছে মূলত ছোট ও ক্ষুদ্র ব্যবসাকে ঘিরে। আর সাম্প্রতিক কালে ই-কমার্স বা অনলাইনভিত্তিক নারী উদ্যোক্তা নতুনভাবে পথ দেখাচ্ছে। অনলাইনে এখন বস্ত্র, গয়না, সাংসারিক পণ্য, শিশুখাদ্য, প্রসাধনসামগ্রী থেকে শুরু করে শিক্ষণীয় বিষয়গুলোও যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে গান শেখা, গিটার শেখা, আর্ট, কেয়ার গিভার, স্বাস্থ্যসেবাসহ যাবতীয় বিষয় এখন অনলাইনে শেখানো হয়। এসবও এক ধরনের উপার্জনের মাধ্যম। এই অনলাইন মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতিই সবচেয়ে বেশি। দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী হলেও অর্থনীতিতে নারীদের অবদান খুব বেশি পরিশীলিত হয়নি। অনানুষ্ঠানিক খাতে নারীদের অবদান প্রায় ৯২ শতাংশ। তবে দেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে একজন নারী শুধু চাকরি নয়, বরং নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেন। আর বর্তমানে নারীরা সেই দিকটিই বেছে নিচ্ছেন। পৃথিবীর মাত্র ২ শতাংশ নারীর কাছে তাদের ব্যবসা পরিচালনার মূলধন থাকে। বাংলাদেশে পরিস্থিতি কেমন তা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি নারী শিল্পোদ্যোক্তাদের বার্ষিক ঋণ চাহিদার ৬০ শতাংশই পূরণ করতে পারছে না ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। যদিও নারী উদ্যোক্তাদের ব্যাংক ঋণ পাওয়া সহজ করতে জামানত ছাড়াই ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে এখনো কার্যকর উদ্যোগে পিছিয়ে রয়েছে ব্যাংক খাত। নারীদের উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে অর্থায়নের উৎস হিসেবে ব্যাংকের অবদান মাত্র ২৩ শতাংশ। সেখানে অর্ধেকের বেশি আসছে উচ্চ সুদের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) ঋণ। এছাড়া, পরিবার ও ব্যক্তিনির্ভরতার মাধ্যমে আসছে অর্থায়নের বড় অংশ। ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রেই এ ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস ও ঝুঁকিপূর্ণ অর্থায়ন টেকসই হতে বাধাগ্রস্ত করছে।

এমন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেই নারী উদ্যোক্তারা এগিয়ে চলেছেন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক শুমারির তথ্যমতে, এক দশকের ব্যবধানে নারী প্রধান অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

২০০৩ সালে মোট অর্থনৈতিক ইউনিটের মাত্র ৩ শতাংশ নারী প্রতিষ্ঠান প্রধান হলেও ২০১৩ সালে তা ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে তা ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। সুযোগ-সুবিধা ও নীতি সহায়তা পেলে নারীপ্রধান অর্থনৈতিক ইউনিটের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। বাজেটে করমুক্ত লেনদেনের বা আয়ের এ সীমা বাড়ানোর ফলে নারীদের কিছুটা হলেও সহযোগিতা হবে।

তবে নারীদের জন্য আরো বেশি সুবিধা বাড়ানোর সুপারিশ করেছেন নারী উদ্যোক্তারা। নারী উদ্যোক্তাদের মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হিসেবে কৃষি ও মৎস্য খাত ছাড়াও খাদ্য

প্রক্রিয়াজাত, পর্যটন, ফ্যাশন ও সৌন্দর্য পণ্য, স্বাস্থ্য বিষয়ক পণ্য এবং অনলাইন ব্যবসায় বেশি আগ্রহ রয়েছে। পাশাপাশি গার্মেন্টস ও অ্যাকসেসরিজ, বিউটি পার্লার, টেইলারিং, রিটেইল শপ, আইটি, ইলেকট্রনিকস, সফটওয়্যার, পাটজাত পণ্য ও হ্যান্ডিক্রাফটস খাতে নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে।

নারীরা ব্যবসা পরিচালনা ক্ষেত্রে এখনো বেশ প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছেন। দেশের নারী উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি। অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাড়াতে হলে নারী শ্রমশক্তিকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কাজে নিয়োজনের পথ সুগম করতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণকারী নারীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় বিশেষ হেল্প ডেস্ক থাকলেও সেগুলোতে হালনাগাদ তথ্য তেমন পাওয়া যায় না। আর্থিক সুবিধার পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের পরিচালনগত অসুবিধাগুলো অপসারণ করতে হবে। আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও সুযোগ-সুবিধা ও পরিবারের প্রয়োজনেই প্রতিবন্ধকতাকে মোকাবিলা করেই উদ্যোক্তা হচ্ছেন নারী। তবে কোভিড-১৯ মহামারি পরিস্থিাতি নারীদের জন্য নতুনভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে। তবে ই-কমার্সভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য নারীরা বেশ প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে।

প্রথমত ডেলিভারি সিস্টেম ও পরিবহণ সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে নারীদের। গ্রাম ও উপজেলা পর্যায়ে এ দুটি ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে নারীদের আরো বেশি উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। পাশাপাশি ইন্টারনেট সুবিধা আরো সাশ্রয়ী ও ভোক্তাবান্ধব করা প্রয়োজন। অর্থায়ন ও সনদায়ন প্রক্রিয়ায় নারীরা যেন অংশগ্রহণ করতে পারে সে ব্যবস্থাটা আরও সহজ করা দরকার। নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে