বিয়ে বিভ্রাট

প্রকাশ | ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

হালিমা আক্তার হানি
বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন- যা দুটি মানুষের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এটি কেবল দুটি ব্যক্তির নয়, বরং দুটি পরিবারের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে। বিয়ে সামাজিক, ধর্মীয় এবং নৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি পারস্পরিক ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং সম্মানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। বিয়ের মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার বিস্তার ঘটে। এটি মানবজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি- যা জীবনযাপনকে স্থিতিশীল ও অর্থবহ করে তোলে। তাই বিয়ে কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি জীবনের দায়িত্বশীলতার অঙ্গীকার এবং সুখী জীবনের সূচক। বর্তমানে বাংলাদেশে চাকরিজীবী পুরুষদের ছোট মেয়েদের বিয়ে করার প্রবণতা একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধরনের বিয়ের মাধ্যমে মেয়েটির জীবন ভয়াবহ প্রভাবের মুখে পড়ে। প্রথমত, ছোট মেয়েরা শারীরিক ও মানসিকভাবে দাম্পত্য জীবনের জন্য প্রস্তুত নয়। অল্প বয়সে বিয়ের কারণে তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে এবং মাতৃত্বজনিত জটিলতায় ভুগতে হয়। দ্বিতীয়ত, এই পরিস্থিতি তাদের শিক্ষাজীবনকে স্থায়ীভাবে ব্যাহত করে, ফলে, তারা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ হারায়। মানসিক পরিপক্বতার অভাবে তারা দাম্পত্য জীবনের চ্যালেঞ্জ সামলাতে ব্যর্থ হয়- যা প্রায়ই মানসিক চাপ, অবজ্ঞা এবং নির্যাতনের দিকে নিয়ে যায়। বর্তমানে যৌতুক প্রথার তীব্রতা লক্ষ্য করা যায়। যদিও আগে এবং এখন যৌতুক চাওয়ার ধরনে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগে সরাসরি দাবিদাওয়া চেয়ে নেওয়া হতো আর তা পূরণ করার ক্ষমতা মেয়েদের পরিবারের না থাকলে তার কুপ্রভাব পড়তো সেই অসহায় নারীটির অপর। যার ফলস্বরূপ দেখা যায়, নারী নির্যাতন, একাধিক বিয়ে, ডিভোর্স, নারীর আত্মহত্যার প্রবণতা ইত্যাদি। বর্তমানে চাওয়ার ধরনের পরিবর্তন হলেও বাকি সবকিছু এক রকম আছে। এ ক্ষেত্রে মেয়েটির পরিবারও অনেকাংশে দায়ী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবার সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক লাভ বা ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে মেয়েটিকে এই বিয়েতে বাধ্য করে। তারা বুঝতে ব্যর্থ হয় যে, এই সিদ্ধান্ত মেয়েটির স্বপ্ন, সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিচ্ছে। পরিবার যদি মেয়েদের শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিত এবং তাদের সঠিক বয়সে বিয়ের সুযোগ দিত, তবে তারা সমাজে আরও শক্ত অবস্থান নিতে পারত। এই ধরনের ঘটনা কেবল একটি মেয়ের জীবনকেই নষ্টই করে না, বরং সমাজে বাল্যবিয়ে ও নারীর প্রতি অসম্মানের সংস্কৃতিকে আরও প্রলম্বিত করে। তাই পরিবারগুলোর উচিত সচেতনতা বৃদ্ধি করে মেয়েদের অধিকার ও সম্ভাবনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। বাংলাদেশে বিয়ের ক্ষেত্রে বর্ণবাদ একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। গায়ের রং, শারীরিক গঠন বা বাহ্যিক সৌন্দর্যের ভিত্তিতে মেয়েদের বিয়ের যোগ্যতা নির্ধারণ করা একটি অমানবিক মানসিকতার প্রকাশ। এর ফলে, মেয়েদের ওপর ক্রমাগত মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। পরিবার, সমাজ এবং পাত্রপক্ষের চাপে মেয়েরা নিজেদের গায়ের রং ফর্সা করতে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রসাধনী ব্যবহার করে- যা তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এয়াড়া, এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি মেয়েদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে, তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতার বীজবপন করে এবং অনেক সময় মানসিক রোগের দিকে ঠেলে দেয়। এই বর্ণবাদ কেবল মেয়েদের নয়, পুরো সমাজের জন্য একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে, নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা এবং পারস্পরিক সম্মানের ধারণা দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিবারগুলো কন্যার বৈষয়িক গুণাবলি বা শিক্ষার পরিবর্তে তার বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। বর্ণবাদী চিন্তা মেয়েদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে বিঘ্নিত করে এবং তাদের জীবনকে এক অসহনীয় প্রতিযোগিতার মধ্যে ফেলে দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে বিয়ের ক্ষেত্রে নারীদের করুণ অবস্থার জন্য দারিদ্র্যতা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী বিকৃত মানসিকতাও। অনেক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার অজুহাতে মেয়েদের অল্প বয়সে বা অসম বিয়ে বাধ্য করা হয়। তবে এই পরিস্থিতি কেবল দারিদ্র্যের ফল নয়; এটি একটি বিকৃত মানসিকতার প্রতিফলন। সমাজে নারীদের শুধুমাত্র ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখার প্রবণতা এবং তাদের শিক্ষার গুরুত্ব অবহেলা করার মানসিকতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। নারীদের গায়ের রং, বাহ্যিক সৌন্দর্য বা যৌতুকের ভিত্তিতে বিবাহযোগ্য বিবেচনা করা হয়- যা তাদের আত্মসম্মানবোধকে আঘাত করে। বিকৃত মানসিকতার কারণে পরিবার ও সমাজ নারীদের নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে। অনেক সময় পরিবার নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বা অর্থনৈতিক লাভের জন্য মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়। এর ফলে, নারীরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, স্বপ্নভঙ্গের শিকার হয় এবং অনিচ্ছায় একটি অসম সুখের জীবনে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়।