বর্তমান বিশ্বে ডিপফেইক ভিডিও অত্যন্ত আলোচিত একটি ইসু্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ডিপফেইকের ব্যবহার ক্রমশই মানুষের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কণ্ঠস্বর নকল, ডোনাল্ড ট্রাম্পের হয়ে টেইলর সুইফটের প্রচারে বিভিন্ন ক্লিপসে ডিপফেইক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ডিপফেইক ভিডিওকে এগুলোর চেয়েও ভয়ংকর উপায়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেলিব্রেটি ও অচেনা শিশুদের ভিডিও নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, অনলাইনে ডিপফেইক ভিডিওগুলোর ৯৮ শতাংশই পর্নোগ্রাফিক এবং এসব ভিডিও দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৯৯ শতাংশই নারী ও অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে।
কিছু ওয়েবসাইট আছে, যাদের কাজই হলো-বিভিন্ন মহিলা অভিনেত্রী, গায়ক, প্রভাবশালী রাজকুমারী এবং রাজনীতিবিদদের নকল যৌন ভিডিও হোস্ট করা। কিছু কোম্পানি এই ওয়েবসাইটগুলোর বিজ্ঞাপন ও প্রিমিয়াম সাবস্ক্রিপশন বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে। গুগলও এই ভিডিওগুলোর ট্র্যাফিক বাড়িয়ে রাখে, আর ভিক্টিমদের এ ক্ষেত্রে কিছুই করার থাকে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েরা এগুলোর শিকার হয়।
ফ্রান্সেস্কা মানি, নিউজার্সির উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি মেয়ে জানায়, 'আমি তখন ক্লাসে। হঠাৎ লাউডস্পিকারে জোরে জোরে নাম ডেকে আমাকে স্কুল অফিসে দেখা করতে বলা হলো। অফিসরুমে যাওয়ার পর সহকারী অধ্যক্ষ এবং একজন কাউন্সিলর আমাকে জানালেন যে এক বা একাধিক পুরুষ সহপাঠী আমার একটি পোশাক পরা ছবি তুলে সেটাকে ছবি হিসেবে এডিট করেছে। একটা নু্যডিফাই প্রোগ্রাম ব্যবহার করে তারা এই কাজ করেছে। আমি ছাড়াও আরও কিছু মেয়ের ছবি নিয়ে তারা এই কাজ করেছে।'
অপমানিত, অসহায় ফ্রান্সেস্কা যখন কাঁদতে কাঁদতে অফিসরুম থেকে বেরিয়ে ক্লাসে ফিরছে, তখন দেখতে পায় হলওয়েতে দাঁড়িয়ে কিছু ছেলেমেয়ে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। আমাকে নিয়ে ওদের এই হাসাহাসি দেখে আমার তখন পাগলের মতো লাগছিল। আমি বাড়ি ফিরে মাকে বললাম, 'মা, আমাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। আমাদের কিছু করতেই হবে।'
এরপর ১৫ বছর বয়সি ফ্রান্সেস্কা ডিপফেইক সমস্যা সম্পর্কে একটা ওয়েবসাইট চালু করে। ওয়েবসাইটের নাম ধরযবববষঢ়.পড়স
একথা সত্যি যে, ছবি এডিট করার বিভিন্ন উপায় আগেও ছিল, কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজটিকে আরও সহজ করে দিয়েছে। যে কোনো ব্যক্তির একটামাত্র ভালো ছবি দিয়ে মাত্র আধাঘণ্টায় তার ৬০ সেকেন্ডের সেক্স ভিডিও বানিয়ে ফেলা সম্ভব। সেই ভিডিওগুলো যে কোনো পর্নোগ্রাফিক সাইটে পোস্ট করা যেতে পারে বা ডিপফেইকের জন্য বিশেষ সাইটগুলোতে পোস্ট করলে সেখান থেকে যে কেউ সেগুলো দেখতে পাবে।
এসব সাইটে নোংরা ভিডিওগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সাজানো থাকে। যেমন-ধর্ষণ (৪৭২টি), কান্না (৬৫৫টি), নিপীড়ন (৮২২) ইত্যাদি। এ ছাড়া ফ্রান্সেস্কাকে টার্গেট করে যেসব ওয়েবসাইট নোংরা ভিডিও করেছে সেগুলোয় বিভিন্ন বিল্ট-ইন অ্যাপ আছে। যেমন, এগুলোয় ঢুকলেই প্রলুব্ধ করার জন্য বিভিন্ন ম্যাসেজ আসবে। লেখা থাকবে- 'এক ক্লিকে পোশাক খুলুন!' আর অবাক ব্যাপার হলো-এগুলোর বিষয়বস্তু প্রধানত নারী। কোনো কোনো এআই তো পুরুষ তৈরি করার সক্ষমতাই রাখে না। এআই নির্মিত শিশুদের যৌন ছবিগুলো নিয়ে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, তাদের ৯৯.৬ শতাংশই মেয়ে এবং তাদের বয়স ছিল ৭-১৩ বছরের মধ্যে।
গ্রাফিবা নামে একটি অনলাইন অ্যানালিটিক্স কোম্পানি আছে যেটি ৩৪টি এমন নু্যডিফাই ওয়েবসাইট শনাক্ত করেছে যেগুলো শুধু সেপ্টেম্বরেই ২৪ মিলিয়ন দর্শক পেয়েছে। যখন ফ্রান্সেস্কাকে টার্গেট করা হয়েছিল তখন পুলিশ, আইনজীবী, কারোর সঙ্গে কথা বলেই কোনো লাভ হয়নি। পুলিশ পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল যে, এ ব্যাপারে তাদের কিছুই করার নেই।
সোফি কম্পটন নামে এক ডকুমেন্টারি নির্মাতা 'অন্য শরীর' নামে একটি মুভি বানিয়েছিলেন। বানাতে গিয়ে তিনি এমন এমন বিষয় অনুধাবন করেছিলেন যে তিনি একটি প্রচারণা ওয়েবসাইট বানিয়েছিলেন। ওয়েবসাইটের নাম ছিলগু ওসধমবগুঈযড়রপব.ড়ৎম। সোফির মতে, এআই দ্বারা নির্মিত ডিপফেইক ভিডিওর এই বিশাল ইন্ডাস্ট্রি মানুষের সম্মতির তোয়াক্কা না করে প্রতিমুহূর্তে সবার সম্মতি লঙ্ঘন করে যাচ্ছে।
অধিকাংশ ভিকটিমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কখনো না কখনো আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন। এই ভিডিওগুলো প্রায়ই সেলিব্রেটি নারীদের টার্গেট করে। একটি ডিপফেইক ওয়েবসাইট এক নারী কংগ্রেস সদস্যের একটি অফিসিয়াল ছবি ডিসপেস্নতে রেখে দিয়েছে, আর তার পাশাপাশি তার ২৮টি নকল যৌন ভিডিও রেখে দিয়েছে। আরও একটি ওয়েবসাইটে গেলে তার ৯০টি এ রকম ভিডিও দেখা যায়। আমি সেই সাইটগুলোর লিংক এখানে দিচ্ছি না। কারণ এতে গুগলে ভিডিওগুলোর ট্র্যাফিক আরও বাড়বে।
এআই দিয়ে কখনো কখনো ছেলেদের ভিডিওও বানানো হয়। সেসব ভিডিও ইন্টারনেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ভিকটিমদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হয়। এসব ঘটনায় কিছু শিশু আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এক ১৪ বছর বয়সি শিশু ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপস্নয়েটেড চিলড্রেনকে জানিয়েছে, 'ছবিগুলো ভয়ংকর রকম বাস্তব লাগে দেখতে।' সে এরকম ভিডিও নির্মাতার হুমকিতে ভয় পেয়ে নিজের ডেবিট কার্ডের তথ্য পাঠিয়ে দিয়েছিল।
দুঃখজনক বিষয় হলো-গুগল এবং অন্যান্য সার্চ ইঞ্জিন বেপরোয়াভাবে অসম্মতিমূলক ডিপফেইকগুলোর ট্র্যাফিক বাড়িয়ে চলেছে। আর এসব দূষিত কোম্পানিগুলোর ব্যবসার দাঁড়িয়েই আছে গুগলের ট্র্যাফিকের ওপর। একটা নির্দিষ্ট সার্চ টার্ম দিয়ে গুগলে সার্চ করে দেখলাম, ১০টা ভিডিও ফলাফলের মধ্যে ৭টাই এলো যৌন ভিডিও। মাইক্রসফটের বিং সার্চ ইঞ্জিনে সার্চ দিয়ে দেখলাম, ১০টা ফলাফলই আসল যৌন ভিডিও। ইয়াহুতে একটাও এলো না।
অথচ, অন্যান্য ক্ষেত্রে সার্চের ফলাফল দিতে গিয়ে গুগল কিন্তু এ রকম ভুল করে না। যেমন ধরুন, আপনি যদি গুগলের কাছে জানতে চান, কীভাবে আত্মহত্যা করব? তাহলে গুগল কিন্তু আপনাকে ধাপে ধাপে আত্মহত্যার নির্দেশনা দিয়ে সাহায্য করবে না। বরঞ্চ আপনাকে প্রথমেই একটা আত্মহত্যা প্রতিরোধী হেল্পলাইনের সন্ধান দেবে। কিংবা যদি জানতে চান, কীভাবে আমার স্ত্রীকে বিষ খাওয়াব, তা হলেও সে এ ধরনের কোনো ধ্বংসাত্মক উপায় আপনাকে জানাবে না। অর্থাৎ গুল যদি চায়, তাহলে সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচয় দিতে পারে। কিন্তু নারী ও মেয়েদের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে গুগল একেবারেই উদাসীন।
ব্রিজ লিউয়ের মতে, 'গুগলকে অবশ্যই এসব সমস্যা সমাধানের বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে। তিনি নিজে প্রতিশোধপরায়ণ পর্নো এবং ডিপফেইকের শিকার হয়েছিলেন। তার মতে, 'গুগলের এসব বন্ধ করার ক্ষমতা রয়েছে।' ২০২২ সালে লিউ এমন এক ম্যাসেজ পেয়েছিলেন যাতে একদম ভেঙে পড়েছিলেন। এক বন্ধু তাকে জানিয়েছিলেন, 'পর্নোহাবে তোমার একটা ভিডিও আছে।' লিউয়ের অজান্তেই একটা ভিডিও ধারণ করা হয়েছিল এবং ডিপফেইক দিয়ে সেটাকে সেক্স ভিডিওতে রূপান্তর করা হয়েছিল। ওয়েবসাইটে সেটার অন্তত ৮২২টা লিঙ্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
লিউ বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। আত্মহত্যা করার জন্য সে একটা উঁচু বিল্ডংয়ের ছাদে উঠেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে লাফ দেয়নি। তার বদলে ফ্রান্সিকার মতো সেও এর প্রতিকার করতে চেয়েছিল। লিউ জানায়, 'আমাদের এভাবে অপমানিত করা হচ্ছে, আর অপরাধীরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে-এর কোনো মানে হয় না।' লিউ এমন একটি এআই তৈরি করেছেন, যার ফলে পর্নোগ্রাফির শিকার ব্যক্তিরা ওয়েবে ছড়িয়ে পড়া নিজেদের ছবিগুলো শনাক্ত করতে পারবেন। সেগুলো সরিয়েও দিতে পারবেন। অ্যাপের পাইলট ভার্সনটি অ্যান্ড্রয়েড এবং অ্যাপলে বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। লিউ তার অ্যাপটিকে পুরোপুরি কার্যকর করার জন্য বিভিন্ন কারিগরি সংস্থার অংশীদারত্ব আশা করছেন।
এ ব্যাপারে গুগলের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েও কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে অনুসন্ধান বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট একটি বিবৃতিতে জানিয়েছেন, 'আমরা বুঝি এ বিষয়টি কতটা যন্ত্রণার। সেজন্য আমরা গুগল অনুসন্ধানে অতিরিক্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করেছি, যার ফলে ডিপফেইকের শিকার ব্যক্তিরা অনুসন্ধান ফলাফল থেকে এই লিঙ্কগুলো সরানোর জন্য আবেদন করতে পারে।' মাইক্রোসফটের একজন মুখপাত্র, ক্যাটলিন রাউলস্টনও অনুরূপ বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের কোম্পানির একটা ওয়েব ফর্ম আছে, সেটা ব্যবহার করে নিজেদের চিত্র অপসারণের অনুরোধ করা যায়।
কিন্তু লিউয়ের মতে, গুগল এবং বিংয়ের মতে প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত। থর্ন নামক একটি প্রতিষ্ঠানের ডাটা সায়েন্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট, রেবেকা পোর্টনফ বলেছেন যে এআই মডেলগুলোকে ইন্টারনেটের বিভিন্ন ছবি ব্যবহার করে এমনভাবে প্রশিক্ষিত করা সম্ভব যার, ফলে এগুলো শিশু যৌন নির্যাতনমূলক ওয়েবসাইটগুলো থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে। এই বিচ্ছিন্নতার ফলে তারা আর এ ধরনের ডিপফেইক ভিডিওগুলো এত সহজে তৈরি করতে পারবে না।
বিভিন্ন দেশে ডিপফেইক ভিডিও নিয়ন্ত্রণের জন্য শক্ত এবং কার্যকরী আইন প্রণয়ন করা দরকার কারণ এসব ডিপফেইক ভিডিও একটা মানুষের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার, সম্পর্ক, পারিবারিক জীবন, সামাজিক পরিচয়ের ওপর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই আমাদের অবশ্যই ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো উচিত এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের উচিত এসব ভিডিও ক্র্যাকডাউন করার জন্য ফলপ্রসূ উপায় সামনে নিয়ে আসা।