মুনিয়ার ৬০ জেলায় ভ্রমণ

ঐতিহ্য, ইতিহাস কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পুরো বাংলাদেশটাই যে সুন্দর, তা ভ্রমণ করলেই যে কারো চোখে ধরা পড়বে। এতটুকু আয়তনের এক দেশেই যে প্রত্যেকটি জেলার মুখের ভাষা, খাবার, পোশাক, জীবনধারায় নানান বৈচিত্র্য, সে ব্যাপারটি বেশ অবাক করেছে তাকে। তবে কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনারও মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে

প্রকাশ | ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

মো. মাসুদ হোসেন
একটি দেশকে পুরোপুরি জানতে হলে সেই দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হবে। আর এ বিষয়গুলো জানা যায় পুরো দেশ ভ্রমণ করার মাধ্যমে। আর এ কাজটিই প্রায় সম্পন্ন করেছেন মুনিয়া সুলতানা। সৃষ্টিকর্তার সাজানো প্রকৃতিপ্রেমী ৩০ বছর বয়সি এই যুবতী শিক্ষাসফর থেকেই শুরু করেন তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। আটটি বিভাগের ৬৪ জেলা নিয়ে গঠিত এই বাংলাদেশের ৬০টি জেলাতেই পা রেখেছেন এমবিএ পাস করা মুনিয়া। তার এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন মো. মাসুদ হোসেন। সুজলা-সুফলা, সবুজ-শ্যামলে ঘেরা আমাদের এই বাংলাদেশ। অপরূপ সৌন্দর্যের রানি এই দেশে রয়েছে পাহাড়-সমুদ্র আর অরণ্যের এক অনন্য মেলবন্ধন। যা অনায়াসে সবার নজর কাড়ে বিশ্বের বৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, অসংখ্য নদনদী, পাহাড়বেষ্টিত হ্রদ, ময়নামতি, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড়, মুঘল সাম্রাজ্য কিংবা বাংলার জমিদারদের প্রাচীন কীর্তি- যা অসংখ্য পর্যটকদের আকর্ষণ। দেশের সমৃদ্ধ ইতিহাস আর ঐতিহ্য, প্রাচীনত্বের গর্বিত নিদর্শন ক্রমেই মানুষের মধ্যে ভ্রমণের আকর্ষণ সৃষ্টি করছে। বাংলার এই অপরূপ সৌন্দর্যকে অবলোকন করতেই একজন প্রকৃতিপ্রেমীর নাম মুনিয়া সুলতানা। তিন ভাইবোনের মধ্যে ছোট মুনিয়া বাবা-মায়ের আদরের সন্তান হওয়ায় তার আবদার কখনোই ফেলে দেননি তারা। উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম- এই চারটি জেলা ব্যতীত দেশের ষাট জেলার মাটিতে পা রাখার সৌভাগ্য হয়েছে তার। ঢাকার হাতিরঝিল এলাকার বাসিন্দা মৃত আলী আহমেদের ছোট মেয়ে মুনিয়া সুলতানার ভ্রমণযাত্রা শুরু হয় স্কুলের শিক্ষাসফর থেকে। তখন থেকেই প্রেমে পড়ে যান সৃষ্টিকর্তার অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশের। ভালোলাগা থেকে প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যাওয়া এই নারী পর্যটক পুরো দেশ ঘুরে দেখার সংকল্প করে ফেলেন তখনই। প্রথমে শিক্ষাসফর হলেও পরবর্তী সময়ে বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী কিংবা অচেনা কোনো ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে যোগ দেন মুনিয়া সুলতানা। ঢাকার একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরি করা এই নারী পর্যটক ২০০৭ সালে স্কুল থেকে গাজীপুরের সখিপুরে ঘুরতে যান। সর্বশেষ চলতি বছরের গত ৮ নভেম্বর গিয়েছেন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। শত বাধা পেরিয়ে উদ্দেশ্যহীন এই ভ্রমণে পেয়েছেন দেশের পথে পথে নানারকম নতুন অভিজ্ঞতা। অবশ্য, কোনো কিছুকেই তিনি বাধা মনে করেন না। সমাজে অনেকেরই ধারণা, মেয়ে মাত্রই দুর্বল, সাহস নেই, বিপদে পড়লে অন্য কাউকেই এগিয়ে আসতে হবে উদ্ধার করতে, তাই ভ্রমণ করতে পারবে না। এ ধরনের কোনো কথাকেই মনে স্থান দেননি মুনিয়া। তার মতে, এই বাধাগুলো মনে স্থান দিলেই তা চেপে বসতে থাকে। এই মানসিক বাধাগুলোকে উতরে যাওয়ার মতো সাহস মনে রাখলে যে কোনো বাধাই তুচ্ছ করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তার এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় তিনি বলেন, অধিকাংশ জেলা নিয়ে তেমন কোনো নির্দিষ্ট পস্ন্যান না থাকলেও কিছু জায়গার ব্যাপারে আগে থেকেই আগ্রহ ছিল। তিনি বলেন, প্রকৃতিপ্রেম হচ্ছে হৃদয়কে উদার হতে শেখায়। ধৈর্য ধারণ ও কষ্টসহিষ্ণু হয় নিয়মিত ভ্রমণকারীদের মধ্যে। পাহাড়, সমুদ্র কিংবা সবুজ খোলা আকাশের মধ্যে বিচরণ ভুলিয়ে দেয় জীবনের যত চিন্তা। প্রকৃতিপ্রেম জীবনের শ্রেষ্ঠপ্রেম- যা স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য বাড়িয়ে দেয়। সব বাজে নেশা দূর করা সম্ভব এই ভ্রমণের মাধ্যমে। ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে, নিজের দেশ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে জানার এবং উপলব্ধি করার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে নিজ দেশে ভ্রমণ। তবে গন্তব্য যাই হোক, ভ্রমণটাকেই বেশি উপভোগ করেছেন তিনি। তার ভাষায়- 'গন্তব্যের চেয়েও যে জার্নিটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই কথা সব সময় বইয়েই পড়েছি। কিন্তু নিজে অভিজ্ঞতা পেয়ে বুঝেছি, এর থেকে সত্যি আর কিছুই হতে পারে না।' অনেকেরই ধারণা, বাংলাদেশে দেখার বেশি কিছু নেই। মুনিয়াও এক সময় এমনটাই ভাবতেন। তবে ভ্রমণে বেরিয়ে এই ভুল ভেঙেছে তার। ঐতিহ্য, ইতিহাস কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পুরো বাংলাদেশটাই যে সুন্দর, তা ভ্রমণ করলেই যে কারো চোখে ধরা পড়বে। এতটুকু আয়তনের এক দেশেই যে প্রত্যেকটি জেলার মুখের ভাষা, খাবার, পোশাক, জীবনধারায় নানান বৈচিত্র্য, সে ব্যাপারটি বেশ অবাক করেছে তাকে। তবে কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনারও মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম ভ্রমণ থেকে নিজ গন্তব্যে ফেরার পথে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়ে হারাতে হয়েছে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি। আর স্মরণীয় ঘটনার মধ্যে বান্দরবানের আমিয়াক্ষুমে খাড়া দেবতা পাহাড় বেয়ে ওঠানামা ছিল খুবই অন্যরকম এক ভয়াল অভিজ্ঞতা। যেখানে তার টিমের ছেলে সফরসঙ্গীরাও পিছপা হয়েছে। সেখানে তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়েও নেটওয়ার্কবিহীনভাবে জঙ্গলে রাত কাটিয়েছেন। দেশের সমুদ্র বন্দরগুলোতে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত চলা ওই সময় দুর্গম এই স্থানটিতে ছিল মুনিয়ার ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা।