বহুমাত্রিক দিলারা হাশেম
দিলারা হাশেম ১৯৩৬ সালের ২৬ আগস্ট যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। মৃতু্যবরণ করেন ২০২২ সালের ১৯ মার্চ। দিলারা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পা রাখেন। ১৯৫৬ সালে সেখান থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে দিলারা হাশেম যোগ দেন তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে। সেখানেই একজন ব্রডকাস্টার হিসেবে তার কর্মজীবনের শুরু।
প্রকাশ | ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও বেতার ব্যক্তিত্ব ছিলেন দিলারা হাশেম। সাফল্য পায়ে পায়ে ধরা দিয়েছে তার জীবনে। আবার অপ্রাপ্তির বেদনাও কম ছিল না। ভয়েস অব আমেরিকা খ্যাত দিলারা আমেরিকায় কাটিয়েছেন জীবনের প্রায় অনেকটা সময়। তবু তিনি এ দেশের সাহিত্য অঙ্গনে যে কাজ করে গেছেন এক কথায় বলা যায় তা তুলনারহিত। দিলারা হাশেম ১৯৩৬ সালের ২৬ আগস্ট যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। মৃতু্যবরণ করেন ২০২২ সালের ১৯ মার্চ। দিলারা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পা রাখেন। ১৯৫৬ সালে সেখান থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ও মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে দিলারা হাশেম যোগ দেন তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে। সেখানেই একজন ব্রডকাস্টার হিসেবে তার কর্মজীবনের শুরু। তিনি তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তানের করাচি থেকে দীর্ঘদিন নিয়মিত বাংলা সংবাদ পাঠ করতেন। পরে তিনি ঢাকা বেতার ও টেলিভিশনেও সংবাদ পাঠ করেছেন। আরো পরে তিনি পাড়ি জমান আমেরিকায়, যোগ দেন ভয়েস অব আমেরিকায়। সেই সময়ে বিবিসি আর ভয়েস অব আমেরিকা জনপ্রিয় মিডিয়া ছিল। ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগে কাজ করেন, ২০১১ সালে অবসর নেন। এরপর বসবাস করছিলেন সে দেশেই। তিনি ১৯৮২ সালে ভয়েস অব আমেরিকায় পূর্ণকালীন ব্রডকাস্টার হিসেবে জোগদান করেন। তার আগে বেশ কয়েক বছর তিনি ভয়েস অব আমেরিকায় খন্ডকালীন রেডিও ব্রডকাস্টার হিসেবে কাজ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে তিনি বিবিসি লন্ডনেও মাঝে মাঝে বাংলা সংবাদ পাঠ করতেন। ১৯৭২ সালে তিনি প্রথমে কিছু দিন বিবিসির হয়ে কাজ করেন। পরে চলে যান ভয়েস অব আমেরিকায়। পেশাগত জীবনের পাশাপাশি তিনি সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার প্রায় ১০ বছর পর বের হয় তার প্রথম উপন্যাস 'ঘর মন জানালা'। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত হয় বইটি এবং অল্প সময়ে বেশ জনপ্রিয়তা ও পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে এটি একই নামে চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়। বইটি চীনা ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এটির প্রধান চরিত্র নাজমা নামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তার জীবন সংগ্রাম এতে বিধৃত। দিলারা হাশেমের কাহিনী, বর্ণন, ভাষা, রসবোধ পাঠককে আপস্নুত করেছে। দিলারা হাশেমের রচিত অন্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে- একদা এবং অনন্ত, স্তব্ধতার কানে কানে, আমলকীর মৌ, বাদামি বিকেলের গল্প, কাকতালীয়, মুরাল, শঙ্খ করাত, অনুক্ত পদাবলি, সদর অন্দর, সেতু। তার লেখা শেষ রাতের সংলাপ : টুইন টাওয়ার ও মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস সমগ্রও প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে 'আমলকীর মৌ' বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই লেখা একটি উপন্যাস। ১৯৭৮-এ প্রকাশিত এ উপন্যাসটি রাজনৈতিকভাবে চরম অস্থিরতার মধ্যে রচিত হলেও এটি ঠিক রাজনৈতিক উপন্যাস নয়। দিলারা সচেতনভাবেই ওই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে এড়িয়ে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনকে উপজীব্য করে তুলেছেন এই উপন্যাসে। সমালোচকদের মতে, যুদ্ধের মীমাংসা হতে এখনো বাকি, যুদ্ধটা নারী-স্বাধীনতার যুদ্ধ, এটা তিনি বুঝাতে চেয়েছেন। একটা সদ্যস্বাধীন দেশের স্বাধীন কিছু চরিত্র উপস্থিত করে দিলারা দেখালেন যে, পুরুষকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থায় যেমন নারীরা জিম্মি, জিম্মি তেমন পুরুষরাও। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সারা তার যোগ্যতাবলে যোগ্য মানুষের মতো আচরণ করেছে। প্রচলিত সমাজকে ভেঙে নতুন করে গড়তে চেয়েছে। সম্পূর্ণ না পারলেও সমাজের কিছু মানুষকে অন্তত সে বোঝাতে পেরেছে, এভাবেও নারীরা বেঁচে থাকতে পারে। সারা অস্তিত্বসচেতন নারী। দিলারা হাশেমের কয়েকটি গল্প গ্রন্থও রয়েছে। এ গুলো হচ্ছে- হলদে পাখির কান্না, সিন্ধু পাড়ের কান্না, ও নায়ক। তার একমাত্র কাব্যগ্রন্থের নাম ফেরারি। দিলারা হাশেম তার সাহিত্যের স্বীকৃতি হিসেবে মর্যাদাবান বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৬), শঙ্খচিল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪), উত্তর শিকাগো 'কালচারাল অ্যান্ড লিটারারি ইঙ্ক' সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৭), অলক্ত পুরস্কার (২০০৪), মুক্তধারা জিএফবি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৯) ও অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়াও বহু সম্মাননায় ভূষিত হন তিনি। এগুলো তার সাফল্যের প্রকৃতি। সাহিত্যিক হিসেবে দিলারা হাশেম তার ব্যতিক্রমী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ২০১১ সালে ভয়েস অব আমেরিকা থেকে অবসর গ্রহণকালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন অনেক কথা। তিনি বলেছেন, 'যা কিছু করতে পারিনি এই দীর্ঘ জীবনে, কিন্তু করতে চেয়েছি, সেগুলোই এখন আঁকড়ে ধরব।' বিদায়ী সাক্ষাৎকারে তিনি কিছু উজ্জ্বল মুহূর্ত স্মরণ করে বলেন, 'এই কাজে পূর্ণ সময়ের জন্য যোগ দেওয়ার পর আমার প্রথম দায়িত্ব হয়েছিল দুটি সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান করার। আমেরিকার জীবনধারা ও কান্ট্রি মিউজিকের আসর। তো এই দুটো অনুষ্ঠান করার জন্য আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি। ... তার সাক্ষাৎকারভিত্তিক সেই অনুষ্ঠান ভয়েস আমেরিকার পুরস্কার পেয়েছে। এতদিন যা করতে পারেননি এবার সেদিকে মন দেবেন এমনটা বলেছিলেন তিনি। অর্থাৎ অনেক কিছু করতে না পারার বেদনাবোধ তার মধ্যে ছিল। সৈয়দ ওয়ালিউলস্নার পর দিলারা হাশেমই ছিলেন প্রথম বাঙালি সাহিত্যিক যিনি বিদেশে অবস্থানকালে উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৭৬ সালে পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার। সাহিত্যিক হিসেবে দিলারা হাশেম তার বিরল ও ব্যতিক্রমী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তার লেখার মাধ্যমে।