বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা

নারীর শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী প্রতি পাঁচজন নারীর প্রায় একজন অস্থিরতা নয়তো অবসাদে ভুগছেন। নারীর অবসাদগ্রস্ততা ও বিষণ্নতার মূলে রয়েছে পারিবারিক কলহ, যৌতুক প্রথা, শৈশবকালীন মানসিক আঘাত এবং সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্য। এক গবেষণা বলছে, নারীর মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যার বিষয়টি আজও সমাজে সমাদৃত নয়- কারণ বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে লজ্জা, নিন্দা বা কলঙ্ক। ফলে নারীরা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা গোপন করে যান। পাশাপাশি রয়েছে অপ্রতুল মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা
অধ্যাপক ফারহানা জামান
  ২০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
নারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা

গেস্নাবাল জেন্ডার গ্যাপ-২০২৩ এর রিপোর্ট অনুযায়ী, জেন্ডার সমতা অর্জনে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের স্থান প্রথম এবং সারাবিশ্বে ৫৯তম। জেন্ডার সমতায়নে উলেস্নখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করলেও নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, নারী শিক্ষা এবং নারীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীরা আজও নানাভাবে পিছিয়ে। বিগত ৩০ বছর ধরে দেশটির প্রধান নারী হওয়া সত্ত্বেও মন্ত্রিপরিষদে নারীর প্রতিনিধিত্ব মাত্র ১০ শতাংশ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা বৃদ্ধি পেলেও ব্যানবেইজের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী উচ্চশিক্ষায় বিশেষ করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষায় নারীরা রয়েছেন পিছিয়ে। গত পাঁচ বছরে কর্মক্ষেত্রে নারীর অবদান ৩৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪২.৬৮ শতাংশ হলেও এখনো নারী জনগোষ্ঠীর এক বৃহৎ অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। বিবিএস'র ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে মাতৃমৃতু্যর হার ১৬৮- যা কিনা এক বছরে অর্থাৎ ২০২২ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১৫৩। মাতৃমৃতু্য হার কমিয়ে আনলেও নারীদের স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে দেশটি রয়েছে পিছিয়ে। ২০২১ সালে প্রকাশিত হলো, রাহমান এবং হামিদুজ্জামানের গবেষণাকর্মের ফলাফল অনুযায়ী সুস্বাস্থ্যের মাপকাঠিতে দক্ষিণ এশিয়ায় তথা সারাবিশ্বে বয়স্ক নারীদের অবস্থান সর্বনিম্নে। আক্তার ও তার কলিগরা ২০২৩ সালের গবেষণায় বলছেন, বয়স্ক নারীরা যারা স্বামী ও সন্তানের সঙ্গে বসবাস করছেন, অথবা যারা একান্নবর্তী পরিবারে বসবাস করছেন, তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার চাহিদা তুলনামূলক হারে বেশি। অন্যদিকে, যেসব বয়স্ক নারীরা বিধবা অথবা পরিত্যক্ত, কিংবা বিভিন্ন কারণে একাকী জীবনযাপন করছেন, তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার চাহিদা বেশ কম। সিলেট জেলার তিনটি গ্রামে একটি জরিপ পরিচালনা করে দেখা গেছে, দরিদ্র বয়স্ক নারীরা অসুস্থতাকে বৃদ্ধ বয়সের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে গ্রহণ করে নেন। তাছাড়া তারা নিজেদের স্বাস্থ্য সমস্যাকে উপেক্ষা করে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ছোটখাটো জ্বর বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যায় তারা নিজেদের মতো করে নানা রকমের অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। তাদের অনেকে মনে করেন জ্বরের ক্ষেত্রে আম অথবা পানপাতা অনেক উপকারী।

শুধু বয়স্ক নারীরা নয়, প্রজনন বয়সি নারীদের মধ্যেও নিজেদের স্বাস্থ্যের প্রতি এক ধরনের উদাসীনতা, অবহেলা কিংবা অসচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। ২০১৭-১৮ সালের এক জরিপে দেখা গিয়েছে ৬০ শতাংশ নারী কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা সম্পর্কে অবগত থাকা সত্ত্ব্বেও মাত্র ১৬ শতাংশ নারী স্বাস্থ্যসমস্যায় এসব কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা গ্রহণ করে থাকেন। গবেষণায়প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, অশিক্ষা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। যে সমস্ত নারীরা শিক্ষিত এবং বাইরে কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের মধ্যে সচেতনতার মাত্রা বেশি লক্ষণীয়। অনিক এবং একদল গবেষক ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, নারীর ক্ষমতায়ন প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ক্ষমতায়িত নারীদের মধ্যে গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের হার বেশি পরিলক্ষিত হয়। নারীদের আর্থসামাজিক অবস্থাও এর পেছনে অনেকাংশে দায়ী। সামান্য আয়ের খানিক অংশ তারা নিজেদের স্বাস্থ্যসুরক্ষায় ব্যয় করাকে অপচয় মনে করেন।

নারীর প্রতি সহিংসতা গর্ভাবস্থায় শিশুমৃতু্যর ঝুঁকি বাড়ায়। ২০২৩ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, যে সমস্ত নারীরা তাদের স্বামীর দ্বারা নানাভাবে সহিংসতার স্বীকার হন তাদের ক্ষেত্রে শিশুমৃতু্য হার অনেক বেশি। অন্যদিকে, যে সমস্ত নারীরা এই সমস্ত সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, তাদের শারীরিক স্বাস্থ্য অনেক ভালো থাকে এবং শিশুর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। ভিন্ন এক গবেষণা বলছে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নারীর স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের মাত্রাকে বাড়িয়ে তোলে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অনেক নারী সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে হয় বঞ্চিত। সেসব ক্ষেত্রে তারা তাদের ভালোমন্দের বিষয়টি পরিবারের সদস্যদের ওপর ন্যস্ত করে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যারা সঠিক সময়ে তার স্বাস্থ্য সমস্যার মাত্রা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। ফলে ঘটে যায় নানা ধরনের বিপর্যয়। পরিবারের সদস্যদের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতাও নারীদের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে থাকে।

গৃহস্থালির কাজে অধিকাংশ নারীরাই নিজেদের অপরিহার্য বলে মনে করেন। নারী নিজেকে সংসারের সঙ্গে এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেন- তারা মনে করেন, তাদের ছাড়া সংসার অচল। ফলে তারা সংসারের সবার অসুবিধার দিক বিবেচনা করে নিজেদের স্বাস্থ্য সমস্যাকে লুকিয়ে রাখেন। করোনাকালীন এক বিধবা নারী তার দুই প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে বাসায় একা রেখে যাওয়ার ভয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে বিরত থাকেন। পরবর্তী সময়ে তার যকৃতের ৭০ শতাংশ সংক্রামিত হয়ে পড়লে মেয়েদের ফেলে রেখেই তিনি হাসপাতালে ছুটে যান। অনেক পুরুষ আবার স্ত্রীর ঘন ঘন অসুস্থ হওয়াকে ভালো দৃষ্টিতে দেখেন না। একটা অসুস্থ মেয়েকে গছিয়ে দিয়েছে বলে অনেক নারী নানা সময়ে টিপ্পনীর শিকার হন। এই সমস্ত কটুকথা থেকে মুক্ত থাকতে অনেক নারী তার স্বাস্থ্যসমস্যা গোপন করেন।

নারীর শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যা দিনে দিনে প্রকট আকার ধারণ করেছে। ২ মার্চের পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী প্রতি পাঁচজন নারীর প্রায় একজন অস্থিরতা নয়তো অবসাদে ভুগছেন। নারীর অবসাদগ্রস্ততা ও বিষণ্নতার মূলে রয়েছে পারিবারিক কলহ, যৌতুক প্রথা, শৈশবকালীন মানসিক আঘাত এবং সামাজিক ও পারিবারিক বৈষম্য। এক গবেষণা বলছে, নারীর মানসিক স্বাস্থ্যসমস্যার বিষয়টি আজও সমাজে সমাদৃত নয়- কারণ বিষয়টির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে লজ্জা, নিন্দা বা কলঙ্ক। ফলে নারীরা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা গোপন করে যান। পাশাপাশি রয়েছে অপ্রতুল মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নারীকে তার স্বাস্থ্যসমস্যার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে জানাতে হবে। হেলথ বিলিফ মডেল অনুযায়ী, কেউ যদি তার স্বাস্থ্যহানির ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করতে পারে এবং একই সঙ্গে স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়ার উপকারিতা বুঝতে পারে, তবে অবশ্যই সে নিজের প্রতি যত্নশীল হবে। আগামী ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস- যার এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় নারীর আগ্রতিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ সুনিশ্চিতকরণ। তবে যদি নারীর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা না যায় নারীর উন্নয়নে বিনিয়োগ কোনো সুফল বয়ে আনতে পারবে না। তাই সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা বৃদ্ধিকরণ ও তাতে নারীর অধিকার সুনিশ্চিতকরণের পাশাপাশি নারীকে তার স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারে যত্নশীল হওয়ার জন্য সচেতনতামূলক কর্মকান্ড বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। যে নারী তার পরিবারের কথা ভেবে নিজের স্বাস্থ্যের অবহেলা করে থাকেন, সেই নারীকে বুঝতে হবে, তিনি সুস্থ, তবেই তার পরিবার সুস্থ। তাই বিনিয়োগ হোক নারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায়, বিনিয়োগ হোক নারীর উন্নয়নে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে