প্রাচীন বা মধ্যযুগে যেমন ক্রীতদাস, যুদ্ধবন্দি বা নিচু জাতের মানুষ সমাজে সবচেয়ে বেশি নিষ্পেষণের শিকার হয়েছে- নারীরাও ঠিক তেমনি প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত নিপীড়ন সহ্য করে আসছে। প্রকৃতিগত কারণে যতটা নয় তার থেকে বেশি নারী সামাজিক অবস্থান থেকে বেশি মানসিক চাপে থাকে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসভাবনা নারীকে উঁচু হতে দেয় না। নারীর শরীর ও মনের ওপর চরম নিগ্রহ নিত্যদিনের বিষয়। নারী নির্যাতন আইন প্রভৃতি এত বেশি চর্চিত হয়- কারণ নারীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রাটাও বেশি। গত শতাব্দীর মনস্তাত্ত্বিক গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর মনোভাব, আচরণ প্রকাশভঙ্গি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর ধরন হচ্ছে দাসত্ব, অবদমন ও নিরাপত্তাহীনতায় বেড়ে ওঠা মানুষের মতো। শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও তারা জড়গ্রস্ত।
\হনারী এখন লুপ্ত রত্ন, যাকে বিভিন্নভাবে সংরক্ষণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যখন একটি দেশে নারীদের জন্য সংরক্ষিত কোটা থাকে তখনই বুঝে নিতে কষ্ট হয় না সে দেশে তার অবস্থান। তাদের মানসিক, আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি প্রয়োজন। এর মধ্যে মানসিক বা আত্মিক মুক্তিই পারে তার জন্য বাকিগুলোকে সহজ করে দিতে।
মানুষের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট প্রকৃতিগত বৃদ্ধি ও বিকাশের তাড়না আছে এবং তা শারীরিক ও মানসিক উভয় বিকাশের জন্যই প্রয়োজন। বাইরের কোনো কিছুর প্রভাব বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে যেমন সহায়তা করতে পারে তেমন ব্যাহতও করে। নারীদের ক্ষেত্রে এ বিকাশ দীর্ঘকাল ধরে ব্যাহত হচ্ছে। পুরো সমাজব্যবস্থা নারীদের দেখে এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণে। মা, বোন, স্ত্রী কিংবা শাশুড়ি, দাদি হিসেবে পার করা জীবনের প্রতিটি ধাপে নারীকে পালন করতে হয় আলাদা ভূমিকা। তবে সবগুলো চরিত্রই শিক্ষালাভ করতে পারলে সমাজের জন্য হবে প্রোডাক্টিভ আর যদি তা না পারে তাহলে সমাজে বসেই তারা হয়ে ওঠে বোঝা। নারীও মানুষ, কোনো দেশের অর্ধেক মানুষকে পেছনে ফেলে দেশ এগোতে পারে না। পশ্চিমা দেশগুলোকে লক্ষ্য করলেই আমরা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেখতে পাব। তাই সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই নারীকে এগিয়ে আসতে হবে।
নারীকে নারী হিসেবে পরিচিত করানো এ সমাজের এক ধরনের কৌশল। গায়ের জোর, আগ্রাসী মনোভাব ও হিংস্রতা দ্বারা পুরুষ নারীকে তার অধীন করে রাখতে চায়। কিন্তু একটা সমাজ গড়ে তুলতে নারী ও পুরুষ উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বেগম রোকেয়া এ কথাগুলোই বলার চেষ্টা করেছেন বহু যুগ আগে থেকে। তার মানসিকতা ওই সময়কার তুলনায় অগ্রসর ছিল বলেই আজ বাঙালি নারী স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারছে। কিন্তু বর্তমান সমাজ সে সময়েও যেমন নারীর জন্য অপমানজনক আচরণ করেছে এই সমাজেও তা করছে। নারীকে ছোট থেকে শেখানে হয় মানিয়ে চলা, টিকে থাকার জন্য ছলনা করা, পুরুষতান্ত্রিক মানদন্ডে নিজেকে তৈরি করার জন্য তারা যন্ত্রণাদায়ক যাত্রা পার করছে। এসবই করছে তারা মানসিক সংকটে পড়ে?
বাধ্য, অনুগত হয়ে সুখে বাস করা যায় কিন্তু অধিকার, মুক্তি ও সম্মান পাওয়া যায় না। এ বিষয়গুলো নারীদের বুঝতে হবে। নারী নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি অর্জন করতে হবে। শক্তি ও বুদ্ধির কৌশলগত ব্যবহার শিখতে হবে নারীকে। ক্রমাগত অনুশীলনই পারে নারীকে তার অবস্থান থেকে উন্নততর অবস্থানে পৌঁছাতে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কৃষিবিদ যারা তারা আজ শুধু ধরণির মানব ফসল ফলানোর কাজে নিয়োজিত। এই অবস্থানকে সমুন্নত রেখেই সমাজ গঠনে তাদের আত্মিক উন্নতি প্রয়োজন। দেশ, পৃথিবী শুধু পুরুষের একার নয়। নারীরও তার প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে।
মেরি ওলস্ট্যানক্রাফট বা সিমোন দ্য বোভোয়ার সমাজে নারীর অবস্থানকে ভিন্ন চোখে দেখলেও তা দিয়ে আমি নারীকে বিচার করব না। বরং আমি নারীকে বিচার করছি রোকেয়ার দৃষ্টিতে। যিনি নারীকে মানুষ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। নারীকে উপযুক্ত হতে বলেছেন তিনি। রোকেয়া অসূর্যম্পশ্যা নারীকে আলো দেখাতে চেয়েছেন, শিক্ষার আলো। এই আলো শুধু খালি চোখে নয়, অন্তর্চক্ষু ব্যবহার করে দেখার সময় হয়েছে। নারীর নিজের প্রয়োজনেই নিজেকে এগিয়ে আসতে হবে। ভাঙতে হবে শৃঙ্খল, গড়তে হবে নতুন পৃথিবী।