বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

অবন্তিকার মৃতু্য ও আমরা

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
অবন্তিকার মৃতু্য ও আমরা

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফাইরুজ অবন্তিকা মৃতু্যতে উত্তাল জবির ক্যাম্পাস। ফাইরুজ অবন্তিকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তার এই মৃতু্যর জন্য দায়ীকে? আমরা সাধারণভাবে অভিযুক্ত হিসেবে দেখতে পাচ্ছি যে, অবন্তিকার মৃতু্যর জন্য দায়ী সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও তার সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী। প্রশ্ন হলো, সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়হান সিদ্দিকী কোন শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে অবন্তিকাকে মৃতু্যর মুখে ঠেলে দিল? এই নেপথ্য শক্তির যোগানদাতা কারা? নেপথ্য শক্তির ঘাঁটি ভাঙতে না পারলে জন্ম নেবে আরও অসংখ্য দাঁতালো হিংস্র শূকর দ্বীন ইসলাম ও রায়হান সিদ্দিকীদের। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ সূত্রে দেখা গেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, 'তারা কর্তৃপক্ষের কাছে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ কর্তৃপক্ষের কাছে করে কোনো প্রতিকার পায়নি। অবান্তির ওপর এই যৌন নির্যাতনটি চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে, তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো সাহায্য না পেয়ে শেষমেষ আত্মহননের পথটি বেছে নেন। আর কতকাল এই দাঁতালো শূকুরদের হিংস্‌্র থাবায় ঝরবে অবান্তিদের প্রাণ। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের যৌন হয়রানির শিকার হওয়াটা নতুন কোন ঘটনা না। প্রতি বছরই দেশের কোনো না কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতে যৌন হয়রানির শিকার হন ছাত্রীরা। শিক্ষকরা কেন তার ছাত্রীকে কন্যাসম ভাবতে পারে না। কেন ঘটে এসব কুৎসিত জঘন্য ঘটনা। কারণ এসব ঘটনার কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতে দেয়া যায় না। তাই দিন দিন মাথা চারা দিয়ে উঠছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদেন যৌন নির্যতানের ঘটনা। পপুলেশান কাউন্সিলের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৭৬ শতাংশ নারী শিক্ষর্থী যৌন হয়রানির শিকার হন শিক্ষালয়ে বা শিক্ষালয়ের যাওয়ার রাস্তায়। গনসাক্ষরতা অভিযান নামক একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৫০ শতাংশ পুরুষ শিক্ষককের নৈতিক আদর্শটা নিয়ে রয়েছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। এই শিক্ষকরাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ দান করে। নারী শিক্ষার্থীর নিজ শিক্ষালয়ে নিরাপত্তাটা কোথায়? রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ি উপজেলার রিশিকুল ইউনিয়নের একটি ঘটনা- বেশ কয়েক বছর আগে একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের যৌন নিগ্রহের শিকার হয়ে, একজন শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়তে বাধ্য হয়। ওই শিক্ষকটি এতই প্রভাবশালী যে, তার ভয়ে কেউ প্রতিবাদটুকু করতে পারেনি। ময়মনসিংহ জেলার বর্তমানে সরকারিকরণ করা একটি কলেজ। এই কলেজের একজন শিক্ষক কর্তৃক বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে যৌন হেনস্তা হয়েছে, এই বিষয় নিয়ে সালিশ দরবারও হয়েছে বলে শুনা গেছে, তারপরও দেখা গেছে ওই শিক্ষকটি বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। সারাদেশের শিক্ষা প্রতষ্ঠিানের নারী নিগ্রহের চিত্রটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। নারীদের হিজাবাস্তীর্ণ করে রেখেও রক্ষা করা যাচ্ছে না যৌন লোভী পুরুষদের যৌন থাবার করাল গ্রাস থেকে। অথচ এই যৌন লোভী দাঁতালো শূকর শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয় না। অপরদিকে, নারীকে পড়ানো হয় হিজাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে রয়েছে ছাত্রী নিগ্রহের অভিযোগ। সম্প্রতি এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের লিখিত অভিযোগ দেন একই বিভাগের একজন নারী শিক্ষার্থী। ওই নারী শিক্ষার্থী তার অভিযোগে উলেস্নখ করেন যে, ড. জুনাইদ তাকে যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যতান করছে। জুনাইদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন করেন এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থী কর্তৃক প্রক্টরের কাছে করা আবেদনটি প্রক্টর পাঠিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে; তারপর কি ঘটলো তার সুস্পষ্টতা পাওয়া যায়নি। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের মতো ঘটনা ঘটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়ন বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেছিলেন একজন শিক্ষার্থী। তবে আন্দোলন ও চাপের মুখে ওই শিক্ষককে চাকরিচু্যত করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। চাকরিচু্যতটাই একমাত্র শাস্তি হতে পারে যৌন নির্যাতনের? দেশের প্রচলিত আইনে ধর্ষণের দায়ে শিক্ষকের ফাঁসি দেয়া উচিত ছিল। আর এই ফাঁসির মতো দন্ডারোপ হয় না বলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাস হয়ে উঠেছে যৌন হয়রানির অভয়ারণ্য। সম্প্রতি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মোশারফ হোসেন হলে ঘটে যৌন নির্যাতনের বীভৎস ঘটনা। এই হলটিতে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছায়ায় থাকা কিছু কুলাঙ্গার। যতদূর জানা গেছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি নানা অপরাধের জন্য প্রসিদ্ধ। মাদক দ্রব্যসহ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের আশ্রয় স্থল হয়ে উঠেছে এই ক্যাম্পাসটি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবান্তির মৃতু্যর ঘটনাটি কতটা জঘন্য ও কুৎসিত তা মাপার কোনো সূচক আমার জানা নেই। শিক্ষক দ্বীন ইসলাম ও ছাত্র রায়হান সিদ্দকী মিলে তৈরি করা সিন্ডিকেটের হাতে যৌন হয়রানি শিকার হয়ে আত্ম্নহননের পথ বেছে নেন অবান্তি। একজন শিক্ষক যে, তার ছাত্রের সঙ্গে এক হয়ে নিজের ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করতে পারে, এমন ঘটনাটি সহজভাবে ঘটালেন শিক্ষক দ্বীন ইসলাম। দেশের শিক্ষাঙ্গনের ইতিহাসে এ ধরনের কুৎসিত জঘন্যতম ঘটনাটি বিরল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। নিজের ফেসবুকে ফাইরুজ অবন্তিকা লিখে গেছেন 'এটা সুইসাইড না এটা মার্ডার। ট্যাকনিকেল মার্ডার।' শোনা যাচ্ছে, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি সার্বিক বিষয়টি তদন্ত করবেন। দিন যাবে তার ঘটনাটি হয়তো সাগর-রুনীর মার্ডারের মতো রূপ নেবে। রাজপথে চলবে বেশ কদিন বিক্ষোভ মানববন্ধন, হবে সভা সমাবেশ। অবন্তিকার হত্যাকে কন্দ্রে করে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে কেউ কেউ সুশীলে পরিণত হবেন। নিশিকথকরা টেলিভিশনের পর্দায় তর্কের ঝড় তুলবেন। তারপর সব মলিন হয়ে যাবে। দিন কয়েক পরে আবার আরেক অবন্তিকার জীবনাবসান ঘটবে। আবার সরব হবে সবাই, রাজপথ হবে উত্তাল, নিশিকথকরা তর্কের ঝড় তুলে বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে টক শোতে আসা হাজিরার সম্মানীটা নিতে পারবেন। কিন্তু নারী নিগ্রহ রোধ হবে না। নারীর নিগ্রহ ও যৌন হয়রানি রোধ করতে হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দরকার। এই শাস্তি মৃতু্যদন্ড বা যাবতজীবন সাজার মাঝে শুধু সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। তার পাশাপাশি নতুন করে আইন করতে হবে। যে আইনে থাকবে অস্ত্রপাচারের মাধ্যমে নারী নিগ্রহকারীর বিশেষ অঙ্গটি কেটে ফেলা, দ্বিতীয়ত, কঠিন অস্ত্রোপচার করে নারী নিগ্রহকারীর মুখমন্ডলে বিশেষ করে কপালে এবং দুই গালে লিখে দিতে হবে ধর্ষক শব্দটি। তৃতীয়ত, বুকে, দুই বাহুতেও অস্ত্রোপচার করে লিখতে হবে ধর্ষক শব্দটি। এই অস্ত্রোপচারটি এমনভাবে করতে হবে যে, যাতে এটা মুছে না যায়। এই দন্ডে দন্ডিত ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট থানায় এসে মাসে একবার দেখাতে হবে তার শরীরে অংকিত শব্দটি বিদ্যমান আছে। এ ধরনের শাস্তি দিতে পারলে তা সমাজে দৃষ্টান্তরূপ লাভ করবে। এই ভয়ে কেউ নারীকে যৌন হয়ারানি বা শ্লীলতাহানির চেষ্টা করবে না। হিজাবে আচ্ছাদিত করে রাখলে কি এই পশুদের হাত থেকে নারী রক্ষা করা যাবে? কুমিলস্নায় হত্যার শিকার তনুও হিজাব পরতেন, হিজাব কি তনুকে রক্ষা করতে পেরেছে? আগে নরপিশাচদের ব্যবস্থা নেয়া দরকার। নারীকে ঘরবন্দি করলে নারী রক্ষা পাবে না, এ কথাটা মনে রাখতে হবে। ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার না করা পর্যন্ত নারীরা সমাজে নিরাপদ না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে