অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক অবৈতনিক কার্যাবলি এবং ব্যক্তি, তাদের পরিবার এবং সমাজের কল্যাণে অবদান রাখার একটি অপরিহার্য উপাদান। (স্টিগলিৎজ-২০০৭). বাংলাদেশে কিংবা অন্য কোথাও বিনা পারিশ্রমিকে কাজের তিনটি খাত হচ্ছে: (ক) খানা ও পরিবারের সদস্যদের জন্য ঘরের সেবা; (খ) খানা ও পরিবারের সদস্যদের জন্য পরিচর্যা সেবা এবং (গ) নিজ ভোগের জন্য বিনা মজুরিতে উৎপাদনশীল কর্মকান্ড। বাংলাদেশের জিডিপির হিসাবে (ক) এবং (খ) অনুপস্থিত থাকে। তবে ইদানীং (গ) আমলে নেয়া হচ্ছে। প্রথমোক্ত দুই কাজে মূলত নারী জড়িত অথচ তার কাজ বাজারে বিনিময় হয় না বলে জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না। সেজন্যই বোধ হয় নারীর অবদানের অবমূল্যায়ন ঘটছে এবং বিতর্কের সূত্রপাত সেখানেই।
অতি সম্প্রতি একটা উলেস্নখযোগ্য এবং প্রশংসনীয় গবেষণা সম্পাদন করেছেন কয়েকজন গবেষক- বিনায়ক সেন, কাজি ইকবাল, মোহাম্মদ ইউনুস এবং তানিমা আহমেদ। তারা তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফল উপস্থাপন করেছেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত এক কনফারেন্সে। গবেষণার বিষয়টি বহুল আলোচিত-সমালোচিত এবং প্রত্যাশিত- তবে কেন জানি, সমাজ বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপূর্ণ এ কাজে হাত দেননি। কঠিন এ কাজটি হলো গৃহস্থালি বিভিন্ন কাজের, যেমন রান্নাবান্না, শিশু পরিচর্যা এবং অন্যান্য সেবামূলক কর্মকান্ড- যার বিপরীতে নারীর জন্য পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা নেই (আনপেইড) সেসব কর্মকান্ডের টাকার অংকে মূল্য নির্ধারণ করা। অধুনা প্রধানমন্ত্রীও নারীর অবমূল্যায়িত এবং অপরিশোধিত (আনপেইড) কাজ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন হিসেবে অন্তর্ভুক্তির পথ বের করার নির্দেশ দান করেছেন বলে আমরা জানতে পারি।
দুই.
বাজারবহির্ভূত (নন-মার্কেট) বেতন বা মজুরিবিহীন পরিচর্যার কাজকে বাংলায় বলে গৃহস্থালির কাজ বা ঘরের কাজ। একেবারে সাদা চোখে তেমন কিছু মনে না হলেও গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে এরা সামাজিক পুনরুৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা এবং অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ব্যক্তি, পরিবার এবং সার্বিক সমাজ সমৃদ্ধিশালী হওয়ার জন্য সামর্থ্য করার প্রক্রিয়া। ক্লডিয়া গোল্ডিন বলছেন, অর্থনৈতিক অংশগ্রহণে নারী-পুরুষের মধ্যকার মহান সমকেন্দ্রিকতা হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত গৃহস্থালির মজুরিবিহীন কাজের কারণীভূত (ইন্সট্রুমেনটাল) ভূমিকাকে আমলে নেয়া হবে না। মনে রাখা দরকার যে খানা বা সমাজ স্তরে পরিশোধিত/ বেতনভুক্ত কাজে এরাই জ্বালানি জোগায় বা সামর্থ্য করে তোলে। দুর্ভাগ্যবশত এমন গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও অপরিশোধিত পরিচর্যামূলক কিংবা খানার কাজ অবমূল্যায়ন করা হয়; মূলত এ কারণে যে বাজারতাড়িত বিনিময়ের বাইরে এরা সংগঠিত হয়- যাকে 'হারানো বাজার' (মিসিং মার্কেট) হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। এসংক্রান্ত সব অধ্যয়নে এ কাজগুলো বাজারবহির্ভূত (নন-মার্কেট) কর্মকান্ড হিসেবে পরিচিত।
তিন.
খানার এবং পরিচর্যা জগতে বিচরণ করা বাজারবহির্ভূত অপরিশোধিত পদক্ষেপগুলোকে পরিষ্কার অর্থেই 'কাজ' বলে শনাক্ত করা যায় কিন্তু একে সংজ্ঞায়িত করার ক্ষেত্রে ভিন্ন মত রয়েছে। মার্গারেট রিড মনে করেন, কাজ হচ্ছে এমন সক্রিয়তা বা কর্মপরায়ণতা- যা একজন লোক অন্যজনকে দিয়ে সম্পন্ন করাতে আর্থিক মূল্য দিতে প্রস্তুত। স্মরণ রাখা দরকার যে, আলোচিত গবেষকরা তাদের গবেষণা কর্মে এ সংজ্ঞাকেই বেছে নিয়েছেন। এটাকে বলে 'তৃতীয় ব্যক্তি মানদন্ড, যেখানে অনেক মজুরিবিহীন কাজ (যেমন শিশু পরিচর্যা) কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে যদি কারো পরিবর্তে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি ভাড়ায় কাজটি করতে সম্মত থাকেন। অন্যদিকে, অন্য একটা মানদন্ড হলো কাজটি হস্তান্তরযোগ্য লাভ সৃষ্টি করে কিনা এবং উলিস্নখিত দুটো মানদন্ডই পরিচর্যায় মজুরিবিহীন সময় বরাদ্দ কাজ হিসেবে গণ্য হওয়ার দাবি করে।
চার.
গবেষকদের গবেষণায় প্রধান যে প্রশ্ন ছিল তা হলো- বাংলাদেশের শহর ও গ্রামে নারী কর্তৃক সম্পাদিত বাজারবহির্ভূত মজুরিবিহীন কাজের মূল্য নির্ধারণ করা। আর পরিচর্যার কাজ বলতে বোঝায় রান্না, ধোয়ামোছা, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি কাজে শ্রম নিয়োজন এবং তার সঙ্গে শিশু ও বয়স্কদের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে সেবা প্রদান (কেয়ার গিভিং)। খুব সহজে বোঝার জন্য এবং পরিসংখ্যানগত দৃষ্টি দেওয়ার লক্ষ্যে ওই গবেষণায় সমুদয় কাজের মূল্যকে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির অংশ হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে। তবে সাবধানবাণী এই যে- প্রথমত, তারা মজুরিসমেত এবং মজুরিবিহীন সব কর্মকান্ড ধরে জিডিপিতে নারীর মোট অবদান পরিমাপ করেননি এবং দ্বিতীয়ত, মজুরিবিহীন অথচ উৎপাদনশীল কাজের মাধ্যমে, যেমন এরই মধ্যে বিবিএসের হিসেবে অন্তর্ভুক্ত, বাড়িতে বাগান, গবাদি পশু পালন, মাছচাষ এবং বন খাত থেকে উৎসারিত খানার নিজ ভোগের নিমিত্তে পরিচালিত কর্মকান্ড দিয়েও নারীর অবদান বিবেচনায় নেননি।
পাঁচ.
খানা ও পরিচর্যা কাজের মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি এবং এর সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছেন গবেষকরা। নারীর অবদান বের করার একটা উপায় হলো উৎপাদনভিত্তিক পদ্ধতি, যেখানে মজুরিবিহীন কাজটি, যেমন শিশুর দেখাশোনা বা রান্না করা খাবার, বাজার থেকে কিনতে গেলে কত খরচ হতো সেই পরিমাণ বাজার বিকল্প বাজারবহির্ভূত দ্রব্য ও সেবায় নির্দিষ্ট করে দেওয়া। তবে স্বীকার্য যে, মজুরি নেই এমন কিছুর উৎপাদন হিসাব করা কঠিন যেমন শিশু পরিচর্যা। আবার বাজার দামের প্রকৃত তথ্য প্রাপ্তি অন্য এক ঝামেলা।
অন্য একটা পদ্ধতি হলো উপকরণভিত্তিক অভিগমন। সংক্ষেপে বলতে গেলে শ্রমের সুযোগ ব্যয় (অপরচুনিটি কস্ট)-বিকল্প কাজে বর্তমান কর্মে নিয়োজিত সময়ের ঘণ্টাভিত্তিক দাম এবং প্রতিস্থাপন ব্যয় বলতে বোঝায়, একই কাজে অন্য একজনকে ভাড়া করলে যে মজুরি বা আর্থিক প্রণোদনা দিতে হতো তার পরিমাণ (তৃতীয় পক্ষ-মানদন্ড)। কাজের রকমফের বিবেচনা না করে সব কাজের জন্য একই মজুরি ব্যবহার করা (জেনেরেলিসট ওয়েজ আপ্রোচ) এবং দক্ষতাসাপেক্ষে মজুরি (স্পেসিলিস্ট ওয়েজ আপ্রোচ) বিবেচনা করেও আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা যায়।
যা-ই হোক, বাংলাদেশে বিনা মজুরিতে পরিচর্যা কাজের মূল্য নির্ধারণে প্রকৃত তথ্য ঘাটতির মুখে গবেষকরা সাধারণ মজুরি (জেনেরেলিসট ওয়েজ) ব্যবহার করে উপকরণভিত্তিক, প্রতিস্থাপন ব্যয় পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন।
মজুরিবিহীন পরিচর্যা কাজের বার্ষিক আর্থিক দাম পরিচর্যা কাজে প্রত্যেক ব্যক্তির বার্ষিক গড়পড়তা ব্যয়িত ঘণ্টা-ঘণ্টাপ্রতি প্রতিস্থাপন মজুরি ১৫ বছর বা তার ওপর বয়স্ক জনসংখ্যা। গ্রাম ও শহরের জন্য প্রতিস্থাপন মজুরি ধরা হয়েছে যথাক্রমে দৈনিক ৩০০ টাকা (ঘণ্টাপ্রতি ৩৭ দশমিক ৫ টাকা) এবং ৩৫০ টাকা (ঘণ্টাপ্রতি ৪৩ দশমিক ৭৫ টাকা)। অন্যদিকে, পুরুষের জন্য দিনপ্রতি প্রতিস্থাপন মজুরি ধরা হয়েছে যথাক্রমে ৪৫০ টাকা (ঘণ্টায় ৫৬ দশমিক ২৫ টাকা) ও ৩৫০ টাকা। জনসংখ্যার হিসাব এসেছে বিবিএসের তথ্য থেকে।
সামাজিক পুনরুৎপাদন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারী সমাজ অপরিশোধিত (বেতনহীন) বাজারবহির্ভূত খানা এবং পরিচর্যা কর্মকান্ডের মাধ্যমে বিশাল অবদান রেখে চলেছে। এ কাজের দাম গবেষকদের হিসাবে দাঁড়ায় আমাদের জিডিপির প্রায় ১৫ শতাংশ। তুলনার স্বার্থে তুলে ধরতে হয় যে ভারত ও শ্রীলংকায় এ হিস্যা যথাক্রমে ১৪ ও ১৫ শতাংশ (২০২১-২২ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রায় ৪০ লাখ কোটি টাকা)। অপরিশোধিত (বেতনহীন) বাজারবহির্ভূত খানা এবং পরিচর্যা কর্মকান্ডের মাধ্যমে নারীর এ অবদান তার পুরুষ প্রতিপক্ষের চেয়ে তিন গুণ বেশি।
ছয়.
এ গবেষণার নীতিসংক্রান্ত তাৎপর্য ব্যাপক, বিশেষত বেতনবিহীন পরিচর্যা কাজের ধারাবাহিক স্বীকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার আলোকে। তাছাড়া পরিচর্যা কাজে বিনিয়োগ করে নারীর বেতনবিহীন কাজের ভার লাঘব ও পুনর্বিন্যাস করার তাগিদ দেয় এ গবেষণার ফলাফল। শেষোক্ত বিষয়টি বিভিন্ন মাত্রার হতে পারে যেমন: (ক) বেতনবিহীন পরিচর্যাকারীদের জন্য গণস্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং সামাজিক সুরক্ষায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রবেশগম্যতা দেওয়া; (খ) পরিচর্যার বাজার এবং বাজারবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানগুলো, শিশু ও বয়স্ক পরিচর্যাসহ আরো বিস্তৃত করা দরকার, যাতে অপরিশোধিত পরিচর্যাকারীর দায়িত্ব হ্রাস পায় এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের অংশগ্রহণের সুযোগ তারা পান; (গ) প্রযুক্তিতে, বিশেষত রান্নাবান্নায় এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি পরিচর্যা কর্মে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারে এবং (ঘ) সামাজিকভাবে ঘরের কাজ সম্পাদনে পুরুষকে উৎসাহ প্রদান করা দরকার। এতে অপরিশোধিত পরিচর্যা কাজে লিঙ্গসমতা বিরাজ করবে।
বলা বাহুল্য, তথ্য-উপাত্তসংক্রান্ত নানা সীমাবদ্ধতা সাপেক্ষে গবেষকরা একটা খসড়া হিসাব জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন। সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ভবিষ্যতে আরো নিখুঁত এবং অধিকতর নির্ভরশীল হিসাব করা যাবে বলে তাদের ধারণা। কথায় বলে শুরুটাই নাকি আসল, সেই দিক থেকে গবেষকদের প্রাণঢালা অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাই।