নাচে-গানে নগরে পর্দা উঠল পৌষমেলার
প্রকাশ | ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
শীত ঋতু আসলেই বাংলার শহর থেকে গ্রাম সবখানেই জমে ওঠে পিঠাপুলি উৎসব। পাশাপাশি গ্রামে-গঞ্জে জমে ওঠে মেলা, যা বাঙালি সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে রাজধানীতে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী পৌষমেলা। নাচ, গান আর বাঙালি সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় পর্দা উঠেছে এই মেলার।
শুক্রবার সকালে পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে অবস্থিত বুলবুল ললিতকলা একাডেমি (বাফা) প্রাঙ্গণে পৌষমেলা-২০২৪ উদ্বোধন হয়। পৌষমেলা উদ্যাপন পরিষদের আয়োজনে দুই যুগ ধরে চলে আসা এই মেলা দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাফা প্রাঙ্গণে।
বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে শীতে উষ্ণতা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতীকী হিসেবে আইলা জ্বালিয়ে মেলার উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এরপর শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি বলেন, এদেশে বিভিন্ন সময়ে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটেছে। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ইতিহাস বিকৃতির নতুন ধারা চালু হয়েছিল। সেটির বিরুদ্ধে আমরা সাংস্কৃতিক লড়াই করেছি। সেই লড়াই এখনো অব্যাহত আছে। এখন ক্রমাগত ইতিহাসের বিস্তৃতি আমাদের চিন্তিত করে তুলছে। দেশীয় সংস্কৃতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা সচেতন থাকি না, আমাদের সন্তানদের এগুলো জানাই না। এসব থেকে বের হয়ে এসে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে লালন করতে হবে। পৌষ মেলা, বসন্ত উৎসব, বর্ষাবরণ উৎসবসহ যেসব উৎসব যুগ যুগ ধরে এই বাংলায় প্রচলিত ছিল, সেগুলো আমরা ভুলতে বসেছি। সেগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এসব ফিরিয়ে আনতে হবে।
আসাদুজ্জামান নূর আরও বলেন, আমাদের সবার কর্তব্য একদিকে ইতিহাস বিকৃতিকে রুখে দেওয়া, অন্যদিকে ইতিহাসের বিস্তৃতিকে প্রতিরোধ করা। এই পৌষমেলা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি বড় পদক্ষেপ। এভাবেই আমাদের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের বাঙালি জাতীয়বাদের প্রতিষ্ঠা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
পৌষমেলা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, এটি বাঙালির প্রাণের মেলা। আমরা ১৯৭১-এ প্রাণ দিয়েছি বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের জন্য। এমন উৎসব আদিকাল থেকেই আমাদের প্রাণের সঙ্গে মিশে আছে। জাত-পাত ধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষই প্রধান। বারো মাসে তেরো পার্বনের দেশ হিসেবে এটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিত্র। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশ কৃষিকে কেন্দ্র করেই হাজার বছর ধরে টিকে আছে। এটাকে কেন্দ্র করেই নানা ধরনের আচার-অনুষ্ঠান চালু হয়েছে। আমাদের দাদি-নানিরা, মা-চাচীরা আচার-অনুষ্ঠানে যে নকশী পিঠা বানিয়েছে। সেগুলো নিয়ে নারী-পুরুষ সবাই আনন্দ আয়োজনে মেতেছে। গ্রামে গ্রামে মেলার আয়োজন হয়েছে।
এই মেলা আয়োজনের মধ্য দিয়ে একখন্ড বাংলাদেশকে আমরা একত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতি তুলে ধরার মাধ্যমে আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে দেখাতে চাই। সংস্কৃতি আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে। সেটাই আমরা তুলে ধরতে চাই।
বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এবং মেলা উদ্যাপন পরিষদের সমন্বয়ক মানজার চৌধুরী সুইটের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সভাপতি ঝুনা চৌধুরী, মেলা উদ্যাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ ঘোষ, বুলবুল ললিতকলা একাডেমির সভাপতি হাসানুর রহমান বাচ্চু, মেলা কমিটির সভাপতি মানস ঘোষ বাবুরাম প্রমুখ।
এদিকে, মেলা উপলক্ষে বাফা প্রাঙ্গণ সেজেছে নানা সাজে। পিঠা-পুলির স্টল বসেছে পুরো প্রাঙ্গণজুড়েই। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মেলায় ভিড় জমাচ্ছেন পিঠাপ্রেমীরা। শিশু থেকে কিশোর কিংবা যুবক থেকে বৃদ্ধ সবাই ভিড় করছেন মেলায়। পিঠার স্টলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছেন তারা। সন্তানদের হরেক রকমের পিঠার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। ব্যাগ ভর্তি করে পিঠা কিনে নিয়ে ফিরছেন অনেকে। পিঠাপুলি উৎসবে মেতে ওঠে পুরো মেলার মাঠ তিন দিনব্যাপী এই পৌষ মেলায় শুধু পিঠাপুলির সমারোহই নয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন আদি সংস্কৃতিকে। বরেণ্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের অংশগ্রহণে দলীয় সঙ্গীত, একক সঙ্গীত, দলীয় নৃত্য, আবৃতি, ব্রতচারী নৃত্য, বাউল গান, সঙযাত্রা, যাত্রাপালাসহ থাকছে নানা পরিবেশনা। বাংলার আদি সংস্কৃতিকে নতুন করে নবীন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতেই এমন বিশেষ আয়োজন বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
তিন দিনব্যাপী এই পৌষমেলায় প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত থাকবে নানা আয়োজন। ২৮ জানুয়ারি সমাপনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পর্দা নামবে এই মেলার।