ভাষা শহীদ দিবস আসলেই আগের রাতে প্রতিবেশি হিন্দু বাড়ি থেকে বিভিন্ন রকমের ফুল ছিঁড়ে আনতে যেতাম। গ্রামের সবাই দাদা ডাকত। উপেন্দ্র দাদার বাড়িতে আমাদের যাতায়াত ছিল। মূলত ফুল চুরির রেকি করতে সারা গাঁয়ে টইটই করে হাঁটতাম। ক্লান্তিহীন এই দৌড়ঝাঁপ সে সময় বেশ আমুদে ছিল আমাদের। আহ্ আমাদের শৈশব, কখন যে পার করে এসেছি!
ফুল ছিঁড়তে গেলে কেউ টের পেত কিনা জানি না। তবে খুব গোপনে চলত আমাদের কর্মযজ্ঞ। আমাদের বাড়ির সব ছেলেপুলে এই কাজ করতাম। শহীদ মিনার বানিয়ে ফুলে সাজিয়ে পুষ্পার্ঘ্য দিব এই কথা মনে রেখে আমরাও ফুল গাছ লাগিয়ে বাগান বানিয়ে ফেলতাম। তখন অবশ্য অন্যের ফুল ছিঁড়তে হতো না। আমরা নিজেরাই প্রভাতফেরি করতাম। খালি পায়ে মৃদুস্বরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি... গাইতাম আর ধীরলয়ে হেঁটে এসে ফুল আর সবুজ লতাপাতায় শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে শেষ হতো। এখনো মনে পড়লে কেমন যেন একটা অনুভূতির রেশ বয়ে চলে। শরীর শীতল হয়ে যায়।
সেই আমরাই আবার প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে আগে দেশাত্মবোধক গান গাইতাম উচ্চস্বরে। তখন কত গানের কলি মুখস্থ করতাম। শুধু রাতে গাইব বলে। মনের ভেতর থেকে দেশের প্রতি কি ভীষণ মায়া। এই মায়ার টান অন্য কিছুতে আসে না। বহু চেষ্টা করেও আনতে পারি না। আমরা দেশকে ভালোবাসি। ভাষা শহীদদের অমর ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষাকে ভালোবাসি।
এখনো গাছে গাছে ফুল ফোটে। পাখিরা গায়। প্রভাতফেরি হয় শিশিরসিক্ত সকালে। খালি পায়ে হেঁটে ফুল দিয়ে বানানো মাল্য প্রদান করি। আমাদের শহীদ মিনার আছে। আমাদের শহীদ দিবস আছে। আমাদের ভাই হারানো মায়ের মুখের বুলি আছে। আমরা বাংলায় কথা বলি।
তবে আমাদের ছেলেবেলায় স্কুলে শহীদ মিনার ছিল না। বাঁশের কাঠামোতে রঙিন কাগজ দিয়ে সাজিয়ে তুলতাম। আর তাতেই পুষ্পস্তবক অর্পণ। তবে তারও কিছুদিন পর শহীদ মিনার গড়ে তোলা হয়েছে ইট-সিমেন্ট আর রড দিয়ে ঢালাই করে। এতে করে স্থায়ী সমাধান হলেও শৈশব কৈশোরের সেই বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো শহীদ মিনার, যা বাড়ির উঠোনের একপাশে বানানো হতো তার আনন্দ কি আর পাওয়া যায়! প্রভাতফেরির সেই আমেজ কি আর আসে? ঘুম জড়ানো চোখে খালি পায়ে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রম্নয়ারি' সেই গান যে সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে দিত সে অনুভূতির অনুভব আজও অমলিন!
এখন বাজারে ফুল কিনতে পাওয়া যায়। হরেক রকম হরেক রঙ। আবার পস্নাস্টিকের ফুল দিয়েও সেই কাজটি অনেকটা দায়সারা পালন করা হয়! আহা আমাদের আবেগ, অনুভূতি ভোঁতা হয়েছে সেই কবে! এখনো স্বপ্ন দেখি বাড়ির উঠোনজুড়ে সারি সারি ফুল বাতাসে দোল খাচ্ছে! আমাদের সেই বয়সের কচিকাঁচার দল সেই ফুল কুড়িয়ে আনন্দের আতিশয্যে মেতে উঠবে।