বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২

কেউ আসেনি সেদিন

জোবায়ের রাজু
  ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
কেউ আসেনি সেদিন
কেউ আসেনি সেদিন

সেলিম খন্দকার একজন বরন্য কথাসাহিত্যিক ও স্বনামধন্য লেখক। ছাত্র জীবনে প্রফেসর হওয়ার শখ থাকলেও হয়ে গেছেন লেখক। ছোটবেলা থেকে টুকটাক লেখার অভ্যাস ছিল। কিন্তু বাস্তব জীবনে সেটা যে জীবিকা হয়ে উঠবে, তা কে জানতো। তবে ছোটবেলায় সেলিম খন্দকারের মা মালেকা বেগম ছেলের টুকটাক লেখা গোপনে পড়ে তখনই প্রতিভা দেখেছেন। সে প্রতিভাই আজ সেলিম খন্দকারকে এই অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। টিভিতে প্রায়ই তার লেখা নাটক প্রচারিত হয়, কলাম লেখার জন্য সম্পাদকের কল রিসিভ করেন, মাসের ত্রিশ দিনই বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায় ডুবে থাকা সেলিম খন্দকার প্রতিবার বইমেলা এলে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেন। হাঁপিয়ে না উঠা ছাড়া উপায়ও তো নেই। বিভিন্ন প্রকাশকরা যেভাবে গল্প উপন্যাস রিখে দেয়ার চাপ দিচ্ছেন, তাতে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। রাত জেগে এভাবে লেখালেখির টেবিলে নিজেকে সমর্পন করে রাখায় মাঝে মাঝে বিরক্ত হয় সেলিম খন্দকারের স্ত্রী নাসরিন। অবশ্য লেখক জীবনের এই এতটা বছর স্ত্রীর সাপোর্ট না পেলে আজ এভাবে নাম পরিচিতি পেতেন না সেলিম খন্দকার।

একটা সময় ছিল, যখন সেলিম খন্দকারের মনে হত তার লেখার এক নাম্বার ভক্ত হচ্ছে তার তিন মেয়ে রোদেলা, নীলা আর নিঝুম। কিন্তু পরে কনার সাথে পরিচয় হবার পর সেলিম খন্দকার বুঝতে পারলেন তার লেখার সেরা পাঠক হচ্ছে মিরপুরের কনা নামের এই তরুণী মেয়েটি।

বেশ ক'বছর আগে এক পড়ন্ত বিকেলে সেলিম খন্দকারের ফোনে কল আসে।

-হ্যালো আমি সেলিম খন্দকারকে চাইছি।

-জ্বী বলছি।

-মাই গড। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমি আপনার সাথে কথা বলছি। জানেন অনকে খোঁজাখোঁজির পর এক রিলেটিভের কাছে আপনার নাম্বার পেয়েছি।

এভাবে দুজনের প্রথম পরিচয়। প্রথমে ব্যাপারটা খুব একটা পাত্তা দিলেন না সেলিম খন্দকার। আজকাল অনেকেই তো কল করে। ভক্ত, শুভাকাঙ্খি, হাবিজাবি এসব বলে এক সময় অচেনা হয়ে উঠে। কিন্তু মাঝে মাঝে কনার কল পয়ে এবং তার কথা শোনে সেলিম খন্দকার বুঝতে পারে এই মেয়ে তার লেখার দুর্দান্ত পাঠক। কনা যেভাবে খুটিয়ে খুটিয়ে তার লেখার ব্যাখ্যা করে-নিখাদ শুভাকাঙ্খি ছাড়া এমনটি আর কেউ করতে পারবে না।

সবচেয়ে সেদিনই সেলিম খন্দকার জানতে পারে কনা তার সেরা পাঠক। সেদিন ছিল পনের জুন। সেলিম খন্দকারের জন্মদিন। কনা সাত সকালে ম্যাসেস পাঠায় সেলিম খন্দকারের ফোনে। তারপর সোয়া বারটার দিকে কল দেয় লেখককে।

-স্যার, জন্মদিনে আপনাকে ম্যাসেজের মাধ্যমে উইশ করেছি।

-আজ আমার জন্মদিন, এটা জানলে কি করে? আমার জন্মদিনের কথা তো কেউ জানে না। এমন কি আমার বইয়ের লেখক পরিচিতিতে সেটা উলেস্নখও নেই।

-অনেক বছর আগে এক দৈনিকে জন্মদিন সম্পর্কে কলাম লিখেছেন। সেখানে নিজের জন্মদিনের কথা বলেছেন। আমার মনে আছে এখনো।

-ওরে বাবা। তাই নাকি? তো ম্যাসেজের রিপস্নাই দিইনি বলে রাগ করেছে।?

-কিছুটা!

-শোনো মেয়ে, সকালে অবশ্য মোবাইলে টংটাং আওয়াজ হয়েছে। সেটা সম্ভবত ম্যাসেস। আমি বুড়ো মানুষ। ম্যাসেজ ট্যাসেজ এসব বুঝি নাকি!

সেদিনই সেলিম খন্দকার জানলেন কনার দৌড় কতখানি। তারপর নিরবে সময় বয়ে যাওয়া। ক'দিন পরপরই কনা ফোন করে প্রিয় লেখককে। সেলিম খন্দকার জানতে পারেন- তার কোন বই কনার বেশি প্রিয়, কোন বই কম প্রিয়। তার লেখা কি কি উপন্যাস আছে কনার কাছে। সব।

২.

সেবার একুশে গ্রন্থমেলা আসি আসি করছে। সেলিম খন্দকার একদিন কনাকে ডাকলেন বইমেলায় দেখা করার জন্য। এক নাম্বার শুভাকাঙ্খিকে দেখতে কেন জানি ইচ্ছে হল সেলিম খন্দকারের। সেদিন ছিল একুশে বইমেলার সতের তারিখ। সকালে সেলিম খন্দকারের ফোনে কনার কল।

-স্যার আমি আজ বিকেলে বই মেলায় আসতে চাই। আপনি থাকবেন তো। এবার রংধনু প্রকাশনী থেকে আপনার বেশ কিছু বই এসেছে। আশা করি সেগুলি কিনবো এবং আপনার অটোগ্রাফ নেব। রংধনু স্টলে আপনাকে পাব তো?

-হ্যাঁ।

-জানেন স্যার, আমি আপনার সাথে ছবি তুলবো বলে আমার বান্ধবী সেতুর কাছ থেকে তার বিদেশী ক্যামেরাটা ধার এনেছি। এবং..।

-এবং কি?

-এবং নিউ মার্কেট থেকে আপনার জন্য একটি খয়েরি কালার পানজাবি কিনেছি গিফট করবো বলে। 'বেদনা' উপন্যাসে আপনি বারবার খয়েরি পানজাবির কথা লিখেছেন। আচ্ছা খয়েরি পাঞ্জাবি কি আপনার খুব প্রিয়?

-একদম রাইট।

বিকেল বেলা। রংধনু স্টলে বসে আছেন সেলিম খন্দকার। এক ঘন্টা আগে কনা রওনা দিয়েছে বলে সেলিম খন্দকারকে জানালো। একে একে ভক্তরা তার বই কিনে অটোগ্রাফ নিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ ছবি তুলছে। সেলিম খন্দকার সানন্দে পোজ দিচ্ছেন। তিনি মনে মনে কনার অপেক্ষায় আছেন। তার তীক্ষ্ন চোখ কনাকে খুঁজছে। বাইরে কত মেয়ে এসেছে মেলায়। সেলিম খন্দকার মনে মনে চাইছেন সেখান থেকে একটা মেয়ে এসে পরিচিত গলায় তাকে বলুক-'এই যে স্যার, আমি কনা।'

সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়। কনা আসে না। সেলিম খন্দকার কল দেন কনাকে। নাম্বার বন্ধ। একি! কনা তার সাথে প্রতারনা করছে না তো। সেকি আসবে? বইমেলা হচ্ছে বাংলা একাডেমিতে। নাকি কনা দূরের মিরপুর থেকে আসতে লেট হচ্ছে।

মেলা প্রায় শেষ হচ্ছে। কনা আর আসে না। সেলিম খন্দকার কল দেন আবার। নাম্বার বন্ধ। আজ আসতে না পারলে মেয়েটার তো উচিত ছিল একটা কল করে জানিয়ে দেয়া।

৩. ছয়মাস পরের ঘটনা। এই ছয়মাসে একবারও কনার কল আসেনি সেলিম খন্দকারের ফোনে। একদিন সেলিম খন্দকার মোবাইল ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ চোখে পড়ে কনার সেইভ করা নাম্বার। কল দেন। রিংও হয়।

-হ্যালো কে বলছেন?

-আমি রিক্তা বলছি। কাকে চান?

-কনাকে। একটু কনাকে দেন তো!

-ইয়ে মানে। আপনি? আপনার পরিচয়?

-পিস্নজ কোন প্রশ্ন না করে কনাকে দেন না।

-আমি কনার বোন। কনা তো মারা গেছে।

-হোয়াট?

-ছয়মাস আগে মিরপুর থেকে বইমেলায় যাবার পথে কনা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়। এই নাম্বারটি তখন কনার কাছে ছিল এবং হারিয়ে গেছে। ক'দিন আগে আমি কাস্টমার কেয়ার থেকে নাম্বারটা উঠালাম।

ঘটনায় বাকরুগ্ধ হয়ে গেলেন সেলিম খন্দকার। মুখে কোন কথা আসছে না। ওপার থেকে রিক্তার হাঁকডাক- 'হ্যালো, আপনার পরিচয়? পিস্নজ কথা বলেন। আপনি কনার ক্লাসমেট নাকি? হ্যালো কথা বলছেন না কেন?'

সেলিম খন্দকার অচেতনের মত মোবাইল কানে দিয়ে বসে আছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে