'আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে
ব'সে থাকি; কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো
... পৃথিবীর কোন পথে : নরম ধানের গন্ধ- কলমীর ঘ্রাণ,
হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুঁটিদের
মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চালধোয়া ভিজে হাত- শীত হাতখান,
ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা- এরি মাঝে বাংলার প্রাণ :
আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের।'
(আকাশে সাতটি তাঁরা)
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় মাটিমুখী গন্ধ আছে। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পুনরাবৃত্ত বিষয়গুলো হচ্ছে প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয়- গাছ, পাখি, জল, নদী, ফুল ও ফল ইত্যাদি। সাম্প্রতিক সময়ে তুলনামূলক সাহিত্য আলোচনায় একটি শাখা যোগ হয়েছে, তা হয়েছে ইকোক্রিটিসিজম। জল, নদী, গাছগাছালি, পশুপাখি ইত্যাদি নিয়েই আলোচনা। পরিবেশ দূষণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের অধঃপতন সর্বাধিক আলোচিত বিষয়ের একটি। পরিবেশবাদী ও বাস্তুসংস্থানের চেতনা জীবনানন্দ দাশের কবিতায় আমরা প্রচুর দেখি। সাহিত্য ও পরিবেশের মধ্যে পরিবেশবাদী অনুশীলনের প্রতিশ্রম্নতির চেতনা-প্রবাহ চালিত করাই ইকোক্রিটিসিজম সাহিত্যের মূল লক্ষ্য। জীবনানন্দ দাশের বুদ্ধিভিত্তিক উপস্থাপনের কৌশল জনপ্রিয় ও এ শাখার উদাহরণকে সমৃদ্ধ ও জীবন্ত করেছে।
স্থানীয় ফলমুল-পাখি-বৃক্ষরাজির সঙ্গে জলরাশি, আকাশ-বাতাস নিয়েই চমৎকার সব বাস্তুসংস্থান-চিত্র এঁকেছেন। তার কল্পনার বাড়ি ঠিক এক একটি বাস্তুসংস্থান। বাস্তুসংস্থানের সর্বোস্তরে তিনি থাকতে চেয়েছেন। 'কোনো শৃঙ্খল যাতে ভেঙে না যায়' তার চাওয়া সেটাই। জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির মধ্যে স্বাধীন সত্তার অস্তিত্ব পরোক্ষ করেছেন। 'বিকালে বাতাসে ধানের গন্ধ', 'বটফলগন্ধ-মাখা ঘাস' ও 'সোনালি রোদ' প্রেমের মতো লাগে বলে প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে রেখে দিয়েছেন। বাদুড়, অপরাজিতা, ঝিঁঝি, অশত্থ, বট, দাঁড়কাক, শালিধান, শালিক, বিভিন্ন নদী-বিল-জল, কুকুর, বিড়াল, ঘাস, বোলতা, চালতা, হিজল, পুকুরের জল, শঙ্খচিল, কুয়াশা, শঙ্খ, অঘ্রান, হেমন্ত, শীত, গাংচিল, বাঙালি নারী-প্রেমিকা, জোনাকি, ফেনসা ভাত, আমমুকুলের গন্ধ, জামরুল, সুপারি, হাঁস, ফড়িং, কাশ, বাসমতী, শাদা মেঘ, নীল আকাশ, মরা নদী, চর, নদীর স্রোত, পাহাড়, কাক, খেত, ধান, গুবরে পোকা, ধূসর সন্ধ্যা, পেঁচা, স্থানীয় বিভিন্ন ফুল-ফল, ফিঙে, মৌমাছি, খোঁপা, বউ-কথা-কউ পাখি, পানের বাটা, থোড়, কাঁচপোকা, কল্কাপাড় আঁচল, বিনুনি, মউরীর গন্ধ, ক্ষীর, বেজি, নাটাফল, লিচুর পাতা, আনারসি শাড়ি, কড়ির মালা, ঝাউগাছ, লক্ষ্ণীপেঁচা, ইঁদুর, কাঁঠাল পাতা, করমচাপলস্নব, বাঁকা চাঁদ, খড়ের চাল, বাদুড়, শ্যামাপোকার দল, সাপমাসী, চালধোয়া গন্ধ, জ্যোৎস্না, চালতা, গাভী, গাজন খেলা/গান, কার্তিকের বিভিন্ন রূপ, চড়ুই, দেউল, খিলান, নোনাফল, আতাবন, চিল, ঘুঘু ইত্যাদি প্রাত্যহিক রূপসী বাংলার উপাদানের পুনরাবৃত্তি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় লক্ষ্য করা যায়। এসব উপাদান তো প্রকৃতির, এসব তো রূপসী বাংলার নিজস্ব বিষয়াদি। প্রকৃতির এসব বিষয়াদি নিয়েই গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র বাস্তুসংস্থান, ইকো-ভিলেজ (আর্থ-সাংস্কৃতিক বন্ধন), এবং 'পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন'-সহ প্রাকৃতিক বিভিন্ন ইতিবাচক ধারণা।
জীবনানন্দ দাশের 'হলুদ পাতার ভিড়ে বসে শিশিরের পালক ঘষে ঘষে', 'পাহাড় নদীর পারে অন্ধকারে', 'গোধূলির অস্পষ্ট আকাশ', আলেয়ার বাষ্প, বিকালবেলার ধূসরতা, 'বাতাসে ঝিঁঝির গন্ধ', 'পুরনো পেঁচার', বেতের লতার নিচে চড়ুয়ের ডিম, ঘাস রোদ মাছরাঙা, 'আমি চলে যাব বলে/ চালতা ফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের নরম জলে', 'চারিদিকে আম-জাম-কাঁঠালের স্তূপ, ফণিমনসার ঝোঁপ ও শটিবন', 'অশ্বত্থের ডালে সন্ধ্যার হাওয়া লাগে', 'হলুদ রঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছে, এলোমেলো অঘ্রাণের খড় (দুজন/বনলতা সেন), চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে' ইত্যাদি এই বাংলারই প্রতিচ্ছবি, প্রতিরূপ। নীলিমা হয়ে ওঠে কবির কল্পলোক। দূর হিঙুল মেঘ, রাঙাচাঁদের নিচে রূপসী ধরণি, ঘাসের বুকে ঝিলমিল শিশিরের জলে খুঁজে পাওয়া এমন নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা করেছেন কবিতায়। জীবনানন্দ পড়ার প্রধান কারণ এই শেকড়। শেকড়ের সঙ্গে কবিতার এই সংযোগ তাকে অমরত্ব দিয়েছে। আরও কিছু উদাহরণ
(১) 'যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে
অপরাজিতার মতো নীল হয়ে...
...ধানসিঁড়ির সঙ্গে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব ব'য়ে
সেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে,
\হসেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি প'রে কোন এক সুন্দরীর শব'
চন্দন চিতায় চড়ে
[যতদিন বেঁচে আছি/রূপসী বাংলা]
(২) 'ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে
শিয়রে বৈশাখ মেঘ- শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড়
নদীর ওপার থেকে চেয়ে রবে- কোনো এক শঙ্খবালিকার ধূসর রূপের কথা মনে হবে'
[ঘুমায়ে পড়িব আমি/রূপসী বাংলা]
(৩) 'পাড়াগাঁর দু'প্রহর ভালোবাসি- রৌদ্রে যেন গন্ধ লেগে আছে স্বপনের; কোন গল্প, কি কাহিনী, কি স্বপ্ন বাঁধিয়াছে ঘর
আমার হৃদয়ে, আহা, কেউ তাহা জানে নাকো- কেবল প্রান্তর
জানে তাহা,'
[পাড়াগাঁর দু'প্রহর/রূপসী বাংলা]
(৪) 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ
খুঁজিতে যাই না আর:'
[বাংলার মুখ আমি/রূপসী বাংলা]
ইকোটু্যরিজম ও মাটিমুখী জীবনানন্দ দাশের কবিতার প্রধান ধারা। গ্রামীণ পরিবেশ, স্বদেশীয় উপাদান নিয়ে তার শব্দভান্ডার। অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ তার কবিতাবলি- যেন জীবন্ত, প্রবাহিত জীবনধারা, বাস্তুসংস্থান। মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত হয়েছে সময়কে ধারণ করে, যথার্থ উপলব্ধি ও সচেতনতার মাধ্যমে। এটি ছাড়া পাঠকের কাছে সহজে পৌঁছানো সম্ভব না। উপমা ও চিত্রকল্প ব্যবহারে নিখুঁত ও যথার্থতা পাঠকসমাজকে মুগ্ধ করে। নতুন ও নিজস্ব কাব্যশৈলী সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। প্রকৃতি ও প্রকৃতিগন্ধী উপাদানে চিত্র, চিত্রকল্প বা কবিতার কাঠামো নির্মিত হয়েছে। সবকিছুতেই অপূর্ব বাংলা- জল, গাছগাছালি, খেত, প্রান্তর নিয়েই রূপসী বাংলার চিত্র। সুন্দর প্রকৃতির জন্য সতত নিবেদিত প্রাণ। সতর্ক পাঠকের কাছে ধরা দেয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন। যথার্থ সচেতন তিনি। তিনি বারবার এই বাংলাতেই ফিরতে চান-
'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে'
[আবার আসিব ফিরে/রূপসী বাংলা]