বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২

স্বপ্নভঙ্গ

শামীম খান যুবরাজ
  ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
স্বপ্নভঙ্গ
স্বপ্নভঙ্গ

সেই ছোট্ট মেয়েটিকে রেখে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন অসচ্ছল পরিবারের কর্তা কাশেম আলী। অসুখের সংসারে সুখের পিদিম জ্বালানোর সংগ্রামে লড়তে থাকলেন তিনি। কফিলের সবজিবাগানে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেলেন প্রায় বছরখানেক। কিন্তু পেলেন না ন্যায্য পারিশ্রমিক। সচ্ছলতা বুঝি আর ফিরবে না কাশেম আলীর পরিবারে! ভিসাও নবায়ন করেননি কাশেম আলীর কফিল আরবদেশি ভদ্রলোকটি!

কাশেম আলী এখন এ দেশে অবৈধ অবস্থানকারী, কাগজপত্রবিহীন শ্রমিক। ঘুরেন-ফিরেন, কাজ পেলে করেন। যা পান তা দিয়ে ভালোই সংসার চলে যায় কাশেম আলীর। কফিলকে দিতে হয় না কোনো মাসিক টাকা, কারণ তিনি কফিল থেকে পালিয়ে গেছেন এক বছরের মাথায়। এখন তিনি স্বাধীন, পুলিশের গাড়ি এড়িয়ে চলেন সাধ্যমতো। যতদিন রিজিক থাকে এ দেশে ততদিন থাকতে পারবেন কাশেম আলী- এটা তিনি মনের মধ্যে পুষে রেখেই চলাফেরা করেন।

আজ ১১ বছর পার হয়ে গেল। কোনোরকমে সংসার চালিয়ে জীবন সংগ্রামে টিকে আছেন কাশেম আলী। ইদানীং একটি ফসলের ক্ষেত চুক্তিতে নিয়ে নিজেই চাষবাস করে যাচ্ছেন। কামাই-রুজি ভালোই হচ্ছে মোটামুটি। ফসল উঠেছে, বিক্রি হচ্ছে প্রতিদিন। টাকাগুলো জমিয়ে নিজের কাছেই রাখছেন, বাসায় রাখছেন না এক টাকাও। এটি কাশেম আলীর পুরনো অভ্যাস, যদি ধরা খেয়ে যান পুলিশের কাছে তাহলে তো আর বাসায় ফেরা হবে না- সরাসরি দেশে পাঠিয়ে দেবে। এই আশঙ্কায় সব সময় টাকাকড়ি সঙ্গে রাখেন তিনি।

মেয়ের বয়স এখন ১৯। বিয়ে ঠিক হয়েছে দূর আত্মীয়ের ছেলের সঙ্গে। কাশেম আলী মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমিয়ে রাখছেন। কিছুদিনের মধ্যেই বড় অংকের টাকা পাঠাবেন, ধুমধাম করে বিয়ে হবে মেয়ের- ভাবতেই খুশিতে ভরে ওঠে কাশের আলীর মন।

আজও সন্ধ্যা হয়ে গেলে ক্ষেতের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরছেন কাশেম আলী। নির্জন সড়কে একটি জিএমসি গাড়ি এসে থামল কাশেম আলীর পথরোধ করে। গাড়ি থেকে নেমে এলো একজন। কাশেম আলীর পরনের সব পোশাকের পকেট হাতড়াতে লাগল আরবের এই লোকটি, গাড়ির মধ্যে পুলিশের ওয়াকিটকির শব্দ বেজে চলছে। কাশেম আলী ভেবেই নিল পুলিশের তলস্নাশি এটি। পুরনো আকামার কার্ড বের করে দিতে চাইল কাশেম আলী। লোকটি বলল, আকামা নয়, আমি ড্রাগ তালাশ করছি; তোর কাছ থেকে। কোথায় রেখেছিস বের কর।

পকেট হাতড়ানোর একপর্যায়ে লোকটির হাত গিয়ে পড়ল জ্যাকেটের ভেতরের পকেটে রাখা টাকার বান্ডিলে। বান্ডিল নিয়ে কাশেম আলীকে সজোরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে চলে যায় আরবদেশি পুলিশের ছদ্মবেশী এই ডাকাত।

মুহূর্তেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় কাশেম আলীর। চোখে অন্ধকার দেখেন তিনি। লোকটি চলে যাওয়ার পরেই কাশেম আলী বুঝতে পারেন- এই লোকটি ছিল একজন ছিনতাইকারী, পুলিশ নয়। ছিনতাইকারীরা মোবাইলে ওয়াকিটকির শব্দ রেকর্ড করে রেখে টার্গেটে পৌঁছে সেটি চালু করে দেয়, যাতে যে কেউ বুঝে নিতে পারে সে পুলিশের লোক।

কাশেম আলীর হাত ও পায়ের চামড়া থেকে পাথরের আঘাতে বের হয়ে আসে রক্ত, ব্যথায় কুকিয়ে ওঠেন তিনি। সংবিৎ ফিরে পেয়ে পুলিশে ফোন দেবেন কিনা ভাবলেন। পরক্ষণেই সরে এলেন এমন চিন্তা থেকে। পুলিশকে ফোন করে কোনো প্রতিকার পাওয়া যাবে না। নিজেরও বৈধ কাগজপত্র নেই। এমতাবস্থায় কিছুই যে করার নেই কাশেম আলীর- সহসা বুঝতে পারেন তিনি। দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অমূল্য অর্জন মুহূর্তেই হারিয়ে ফেললেন তিনি। কীভাবে মেয়ের বিয়ে দেবেন, কোথায় পাবেন লক্ষাধিক টাকা।

সন্ধ্যার অন্ধকার আরও ঘনীভূত হতে লাগল, আবিরের লালিমা বাবলা গাছের ঘন কাঁটায় বিদ্ধ হতে হতে কালো রং ধারণ করল। কাশেম আলীর চিন্তার রং আরও বেশি হতাশার কালোয় ডুবে যেতে থাকল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে