কু ঝিক ঝিক... কু ঝিক ঝিক... কু...ঝিক ঝিক...
বাজনা তুলে যশোরের রেলগেট থেকে আঁকাবাকা রেলের লোহার পাটি ধরে বাতাসের বেগে ছুটে চলেছে ট্রেনটি ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনের উদ্দেশ্যে। সেই ট্রেনের ছোট্ট একটা বগিতে মা- লতার কোলে শুয়ে আছে দুই বছরের মেয়ে পুষ্প। পাঁচ বছরের ছেলে বকুল। মায়ের পাশে শুকনো মুখে মাকে ধরে বসে আছে বকুল।
লতার দুটি চোখেমুখে কেবলই হতাশার ছাপ। জানালা দিয়ে ঝড়ের বেগে বাতাস আসছে।তবুও ঘামছে লতা। বারবার শাড়ির আঁচল দিয়ে লতা চোখ মুখের সে ঘাম মুছছে। নানান দুঃশ্চিন্তা তার মনের মধ্যে আর মাথায় ভর করছে। কি করবে! যদি শহরে গিয়ে লতা ওদের বাবাকে খুঁজে না পাই? পুষ্পের জন্মের পর, সংসারে প্রচন্ড অভাব দেখা দিলে লতার স্বামী কথা। উপার্জনের জন্য বউ ছেলেমেয়েকে রেখে ঢাকায় চলে যায়। সেখানে গিয়ে রিকসা চালিয়ে প্রতি মাসে কমবেশি টাকা পাঠাতো সংসার খরচের জন্য।
সেই টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোনো রকম ডালভাতে চলছিল লতার সংসারটি। মাঝেমধ্যে মোবাইলে কথা হতো ছেলেমেয়ে আর লতার সঙ্গে লতার স্বামী কথার।
এরমধ্যে একবার বাড়িতেও এসেছিল কথা। ছেলেমেয়ের জন্য কিছু খেলনা। বউ লতার জন্য একটা টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। আর সংসারের জন্য টুকিটাকি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে। দুই-একদিন বাড়ি থেকে আবার শহরে চলে যায় লতার স্বামী কথা। যাওয়ার সপ্তাহ খানিক পর কথা একবার মোবাইল করেছিল বাড়িতে বউ লতার কাছে। তারপর গত ছয় মাস আর স্বামীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি লতা। তার দেওয়া নাম্বারে কল করলে বলে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। নম্বরটি এই মুহূর্তে বন্ধ রয়েছে। হতাশ হয়ে মোবাইল মুখো তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে লতা। সে নিঃশ্বাসে কতো যে কষ্ট লুকানো তা- বুঝি কেবল সৃষ্টিকর্তাই জানে।
লতা তার ছোট ছোট দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে পরের বাড়ি বাড়ি কাজ করে এই ছয় মাস খেয়ে না খেয়ে অর্ধাহারে অনাহারে খুব কষ্টে কালযাপন করেছিল। অবশেষে সে তার স্বামীর খোঁজে শহরে যাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে। লতার শেষ সম্বল বাড়ির কয়েকটা পোষা হাঁস-মুরগি। সেসব বিক্রি করে শহরে যাওয়ার খরচ গুছিয়ে কোলের সন্তানদের নিয়ে ট্রেনে উঠেছে। সে তার স্বামীর মুখে শুনেছে তার স্বামী কথা গুলশান বনানীর কোলঘেঁষে যে কড়াইল বস্তিটি রয়েছে সেখানেই সে থাকে। অন্য মনস্ক হয়ে এইসব ভাবছিল লতা। হঠাৎ! ছেলে বকুলের ডাকে সম্বিত ফিরে পেল লতা। বকুল বলল... মা, আমার না... খুব ক্ষিদে লাগছে। লতা বকুলের মাথায় মায়ার হাতটি বুলিয়ে। সঙ্গে রাখা ব্যাগ থেকে জলের বোতল আর টুপলা থেকে কিছু শুকনো চিড়ে বের করল। তারপর জলের বোতল বকুলের হাতে দিয়ে বলল... এই নে বাবা বকুল, চিড়ে আর পানি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ কর।
ঢাকায় তোদের আব্বুর কাছে গেলে দেখবি। তখন তোদের আব্বু তোদের দেখে কতো কিছু কিনে আনবে। তখন মাছ গোস্তো দিয়ে পেট ভরে খেতে পারবি। বকুল বলল... সত্যি মা? তখন পেট ভরে খেতে পারব? লতা বলল... হঁ্যা বাবা, তখন পেট ভরে খেতে পারবি। বকুল হাসি মুখে মায়ের হাত থেকে চিড়ে খেয়ে জল খেল। তার ঘণ্টাখানেক পর ট্রেনটি পৌঁছালো ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনে। সবার মতো লতা মেয়ে পুষ্পকে কোলে নিয়ে বকুলের হাত ধরে ট্রেন থেকে নিচে নামল। তারপর বনানীর কড়াইল বস্তির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। সেখানে পৌঁছে অনেকের কাছে তার স্বামী কথাকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু কেউ কথার সন্ধান দিতে পারল না। সন্ধ্যাও ঘনিয়ে আসছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে লতা এখন কোথায় যাবে। দু'চোখে যেন অন্ধকার দেখছে লতা। অবশেষে নুর নামের একজনকে জিজ্ঞাসা করতে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল... আপনি কি হন কথার? লতা বলল.. সে আমার স্বামী। আর বকুল-পুষ্পকে দেখিয়ে বলল... এ দুটো আমাদের ছেলেমেয়ে। নুরের দুটি চোখে জল। লতা বলল... আপনার চোখে জল কেন? কি, কি হয়েছে কথার? কিছু বলুন? নুর কাঁদতে কাঁদতে বলল... কথা আর বেঁচে নেই। বোন। লতা বলল... কি... কি... বললেন? না... না...না, এ হতে পারে না। আমার স্বামী কথা আমাকে ছেড়ে। ছেলেমেয়েকে ছেড়ে... না... না... আপনি মিথ্যে বলছেন। তারপর ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। নুর বলল... হ বোন আমরা একসঙ্গেই রিকশা চালাইতাম। তারপর কল্পনায় বলল... সেদিন রাতে ও আমার আগেই বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিল। পথে হঠাৎ! এক্সিডেন্ট করে। এমনভাবে পরিবহণের চাকায় পিষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, চেনার উপায় ছিল না। আর আমিও ওর বাড়ির ঠিকানা জানতাম না।
আর তাই ওর লাশ আপনাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয়নি। লতা নির্বিকার, পাথর হয়ে গেছে যেন। নুর বলল... এত রাতে বাচ্চা দুটো নিয়ে কোথায় যাবেন বোন? তার চেয়ে আমার সঙ্গে চলুন। লতা বলল... না ভাই। আমরা রাতের
ট্রেন ধরেই গ্রামে চলে যাব। অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও লতা গেল না। অবশেষে নুর চলে গেল। লতা বাচ্চা দুটো নিয়ে হাঁটতে লাগল... কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ মাথা চক্কর দিয়ে পড়ে। গেল লতা রোডের পাশে। বকুল-পুষ্প কাঁদছে তাদের মাকে ধরে। বিধির লীলাখেলা যে বোঝা বড় দায়। একটু পরেই তাদের মা-ও চলে গেল চিরদিনের জন্য বকুল-পুষ্পকে ছেড়ে। আশপাশের লোকজন বকুল-পুষ্পের কান্নাকাটির শব্দ শুনে এক-দুই জন করে রাস্তার আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলো। কেউ কেউ বলতে লাগল আহারে এখন এই বাচ্চা দুটোর উপায় কি হবে? দশের কাছ থেকে টাকা তুলে দাফন করা হলো লতার লাশ। বকুল দুই বছরের ছোট বোন পুষ্পকে নিয়ে পথে পথে ঠোকর খেতে লাগল। কোনো দোকানে খাবার চাইতে গেলে কেউ আবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে দূর দূর করে বের করে দেয়। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মানুষের বাসী এঁটোঘাটা আর ডাস্টবিনের দুর্গন্ধময় পঁচা আবর্জনাপূর্ণ খাবার খেয়ে। আজ বকুল-পুষ্পের জীবন কাটে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীতে বকুল-পুষ্প পড়ে থাকে এখন ছিঁড়া ছুটো ময়লা জামাকপড়ে ফুটপাতের এক কোণে। ওরা জানে না ওদের দেশের বাড়ি কোথায়? ওরা দু'ভাই বোন সমাজের মানুষের চোখে এখন যে ফুটপাতের টোকাই শিশু। এই শীতের রাতে হিম শিশির ঝরা খোলা আকাশের নিচে। গরম কাপড়ের অভাবে বড় যে দুর্বিষহ জীবন কাটে এখন বকুল পুষ্পের।