প্রবাদ :হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল উত্তরাধিকার

প্রকাশ | ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০

অমল বড়ুয়া
প্রবাদ প্রতিটি ভাষার অমূল্য সম্পদ। বাঙালির হাজার বছরের সংস্কৃতি তথা সামগ্রিক জীবনাচরণে প্রবাদ সমৃদ্ধ একটি ধারা হিসেবে বিবেচিত। প্রবাদের মাধ্যমে বাঙালির জীবন, ধর্ম, সংস্কৃতি, আচার, বিশ্বাস ও রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। লোকসংস্কৃতি বা লোকসাহিত্য বা মৌখিক সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় শাখা হলো প্রবাদ। 'প্র' মানে 'বিশিষ্ট' এবং 'বাদ' বা 'বচন' মানে 'কথা'; অর্থাৎ বিশিষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ কথা। সংসদ অভিধানমতে প্রবাদ হচ্ছে, 'পরম্পরাগত বাক্য, জনশ্রম্নতি, প্রবচন, অপবাদ বা নিন্দা'। প্রবাদের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো 'ঢ়ৎড়াবৎন'। প্রবাদ অবশ্যই বাক্য, অর্থাৎ ক্রিয়াপদযুক্ত; আর সত্যপ্রচার বা পরামর্শদান তার অন্যতম উদ্দেশ্য। প্রবাদ সংক্ষিপ্ত ও সংহত। প্রবাদ প্রখর সমাজদৃষ্টি ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হয়। বাচ্যার্থ সামনে এলেও ব্যঞ্জনার্থই প্রকৃত অর্থ। অর্থাৎ প্রবাদ ব্যঞ্জনার্থে ব্যবহৃত হয়। স্বল্প পরিসরের মধ্যে ভাবের প্রকাশ প্রবাদের একটা প্রধান গুণ। লোকপরম্পরাগত বিশেষ উক্তি বা কথন হলো প্রবাদ। শুধু বাংলা বা ইংরেজি নয়, সব ভাষাতেই রয়েছে প্রবাদের প্রাচুর্য। তারা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে, সতেজ রেখেছে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফলে সৃষ্ট কোনো বাক্য থেকে প্রবাদ বাক্যের জন্ম। অর্থাৎ মানবসমাজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতালব্ধ জীবন সত্যের স্মারক কোনো জনপ্রিয় সংক্ষিপ্ত উক্তিই হলো প্রবাদ। প্রবাদ বাক্য গোষ্ঠী মানুষের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার দ্বারা রচিত। গোষ্ঠীগত রচনা তাই অঞ্চল ভেদে ভাষা ও শব্দ বদলে যেতে পারে প্রবাদ বাক্যে। প্রবাদকে বলা যায়, লোকসমাজের অভিজ্ঞতার নির্যাস। একক কোনো ব্যক্তি এর রচয়িতা হিসেবে দাবি করতে পারে না। 'প্রবাদে' দু'চারটে শব্দের মধ্যে দিয়ে বক্তব্য এলেও তা অনেক গ্রহণযোগ্য এবং হৃদয়গ্রাহী হয়। প্রবাদের মধ্যে থাকে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা আর মানবিক আবেদন। তার সহজ প্রকাশভঙ্গি আর সরল ও সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনায় তা হৃদয়কে ছুঁয়ে যায়। প্রবাদের সংক্ষিপ্ত বাক্যে একটি জাতির নানান বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে থাকে। প্রবাদের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে আর এই বৈশিষ্ট্যগুলো হলো- অর্থব্যঞ্জনা : প্রবাদের অর্থ গভীর ও তাৎপর্যময়। এর তীক্ষ্ন অর্থভেদী মন্তব্য শ্রোতা ও পাঠককে সহজে সচকিত করে তোলে। এর শব্দার্থ নয়, রূপক অর্থই গুরুত্বপূর্ণ। প্রবাদ হলো অভিজ্ঞতার নির্যাস অর্থাৎ প্রবাদের শক্তিই হলো অভিজ্ঞতা। লোকসমাজের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার সারৎসার থাকে প্রবাদে। যুগের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা মানুষের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যোগ হয়। প্রবাদের প্রকাশভঙ্গি সরল ও সহজ। প্রবাদ সহজ সরল হওয়ার কারণে তা সহজেই শ্রোতার মনে সাড়া জাগায়। প্রবাদের আলঙ্কারিক গুণ রয়েছে বলে মানুষ তা সহজে ভুলে যায় না। সাধারণত ছন্দ ও অন্ত্যমিলের জন্য বা কখনো উপযুক্ত অনুষঙ্গের জন্য প্রবাদ দীর্ঘদিন মানুষের মনে থাকে। প্রবাদ যেহেতু সমাজ-সংসারের অতিপরিচিত অসাধারণ অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করে তাই প্রবাদের আবেদন সর্বজনগ্রাহ্য। প্রবাদের রচয়িতার নাম জানা অসম্ভব, স্রষ্টার এই নামহীনতাই প্রবাদকে নিরপেক্ষ করে। প্রবাদের রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। সুপ্রাচীনকাল থেকেই কাব্য-সাহিত্যে প্রবাদ অনন্য এক স্থান দখল করে আছে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্য নিদর্শন চর্যায়ও অনেক প্রবাদ জনমনে অনুচিন্তার আবেশ ঘটিয়েছে। চর্যায় যেমন তার বহিঃপ্রকাশ পরিলক্ষিত হয়- \হসরস ভণিন্ত বর সুণ গোহালী কিমো দুঠ্য বলন্দেঁ। (৩৯নং পদ) অর্থ : দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো। এই প্রবাদটি বহুল ব্যবহৃত ও মানুষের মুখে মুখে এখনো প্রচলিত ও জনপ্রিয় প্রবাদগুলোর মধ্যে একটি। চর্যায় এরূপ আরও বহু প্রবাদ আছে, যা মানুষের মনে দাগ কাটে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো- হাথেরে কাঙ্কাণ মা লৌউ দাপণ (৩২নং পদ) অর্থ : হাতের কঙ্কণ আছে কিনা তা দেখার জন্য তো আর আয়না বা দর্পনে দেখতে হয় না। বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদে আরও কয়েকটি প্রবাদ আছে। চর্যাপদকর্তা ভুসুকু আবির্ভাবকাল এগারো শতক। তার রচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় প্রবাদ হলো- আপনা মাংসেঁ হরিণা বৈরী (৬নং পদ) অর্থ : হরিণ তার নিজের মাংসের জন্য নিজের শত্রম্ন। কিংবা আমরা চর্যার আরও কিছু বহুল চর্চিত প্রবাদের কথাও এখানে প্রসঙ্গক্রমে উলেস্নখ করতে পারি। যেমন- হাঁড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী (৩৩নং পদ) অর্থ : হাঁড়িতে ভাত নেই অথচ নিত্য অথিতি এসে ভিড় করে। দুহিল দুধ কি বেন্টে ষামায় (৩৩নং পদ) অর্থ : দোয়ানো দুধ কী বাটে প্রবেশ করে। চৌদ্দ শতকে বড়ু চন্ডীদাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এবং ষোল শতকে মুকুন্দরাম চন্ডীমঙ্গলে একই প্রবাদ ব্যবহার করেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের তাম্বুলখন্ডে উলেস্নখিত প্রবাদটি হচ্ছে- যে থানে শুঁচী না জাএ। তথাঁ বাটিআ বহাএ অর্থ : যেখানে সূচ প্রবেশ করতে পারে না সেখানে রজ্জু ঢোকানো অসম্ভব। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের দানখন্ডে লিখিত প্রবাদটি ব্যঙ্গার্থে ব্যবহৃত হয়েছে- \হমাকড়ের হাথে যেহ্ন ঝুনা নারীকল অর্থ :বানরের হাতে যেমন ঝুনা নারকেল। প্রসঙ্গত বানর ঝুনা নারকেল খেতে পারে না। এই প্রবাদটি মূলত যে যা পারে না, তাকে তা করতে দেওয়ার ব্যঙ্গার্থে ব্যবহৃত হয়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের দানখন্ডের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় প্রবাদ হচ্ছে- \হললাট লিখিত খন্ডন না জাএ অর্থ :ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন। মানুষ স্বভাবতই ভাগ্য বা কপালে বিশ্বাসী। এই প্রবাদে ভাগ্য বা কর্মের অবশ্যম্ভাবী ফলদানের বিষয়টি পরিস্ফুট হয়েছে। কৃষ্ণকীর্তনের এই প্রবাদটি কিন্তু খুবই জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত। দানখন্ডের আরও একটি জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত প্রবাদ হচ্ছে- দেখিল কোকিল বেল গাছের উপরে। আরতিল কাক তাক ভখিতেঁ না পারে। অর্থ :বেল পাকলে কাকের কিছু আসে যায় না, কারণ বেল শক্ত বলে কাক খেতে পারে না। প্রবাদ হলো বুদ্ধিপ্রধান রচনা। অনুমান করা হয় যে, মানুষ প্রবাদের সৃষ্টি ও প্রয়োগকৌশল লোকসাহিত্যের অন্যান্য শাখার তুলনায় অপেক্ষাকৃত পরে আয়ত্ত করেছে। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে মিশরের প্যাপিরাসের গল্পে প্রবাদের প্রয়োগ আছে। বেদ-উপনিষদেও প্রবাদ আছে। রামায়ণেও আমরা প্রবাদের ব্যবহার দেখতে পাই- পিঁপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে। অর্থ :একটি বিশেষ সময়ে পিপীলিকার পাখা গজায়। বিস্তৃত অর্থে পিঁপীলিকার পাখা গজালে তারা আলোর দিকে ছুটতে থাকে। আলোর আঁচে এক সময় তারা মারা যায়। বাস্তব জীবনেও নির্বোধ মানুষ অহংকারে নিমজ্জিত হয়ে বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে এবং বিপদগ্রস্ত হয়ে অনিশেষ দুঃখ কষ্ট ভোগ করে দুর্বিষহ জীবনযাপন করে। রামায়ণের এ রকম বহু প্রবাদের মধ্যে আরেকটি জনপ্রিয় প্রবাদ হচ্ছে- বামন হইয়া হাত বাড়াইলে চাঁদে। অর্থ :বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়ানো। বিস্তৃত অর্থে মানুষ এমন কিছু পেতে চান যা পাওয়ার যোগ্য তিনি নন কিংবা যা তার সাধ্যের বাইরে। যে কোনো প্রবাদ মানুষের ব্যবহারিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধি থেকে জন্ম নেয়। প্রবাদ ক্ষুদ্রতম রচনা; একটি সংক্ষিপ্ত বাক্য থেকে ছন্দোবদ্ধ দুই চরণ পর্যন্ত এর অবয়বগত ব্যাপ্তি। তবে ক্ষুদ্র হলেও তা পূর্ণাঙ্গ ভাবদ্যোতক ও অর্থবহ হয়ে থাকে। প্রবাদ সমাজমানসে জন্ম নিয়ে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার রূপ বদলায় এবং এক সময় একটি স্থায়ী রূপ লাভ করে। কখনো কখনো একই প্রবাদ কিছুটা পরিবর্তনসহ অঞ্চলভেদে একাধিক রূপেও প্রচলিত থাকে। মহাভারতে ব্যবহৃত প্রবাদের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো- পরে নিন্দ নাহি দেখ ছিদ্র আপনার। অর্থ :পরের নিন্দা কর অথচ নিজের দোষ চোখে পড়ে না। লোকসাহিত্যের অন্য শাখার মতো প্রবাদেও মানুষ, সমাজ ও পরিবেশের কথা অনিবার্যভাবে এসেছে। এগুলো এখন বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব সম্পদ এবং ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত। শুদ্ধ অন্তঃপুর বাসীনী গৃহকর্ত্রী থেকে, মেয়ে বউ রচনা করেছে সরস ও সুতীব্র মন্তব্য আর তার থেকেই হয়েছে প্রবাদ। মহাভারতের প্রবাদ হচ্ছে- ব্যাগ্র নাহি জন্ম লয় মৃগীর উদরে। অর্থ :মৃগীর গর্ভে কখনো বাঘের জন্ম হয় না। প্রবাদ সবাই সহজেই বুঝতে পারে, বলতে পারে। এর মধ্যে জটিল কথা নেই। শুনলেই মনে থাকে। ছন্দ, অন্ত্যমিল ইত্যাদি দিয়ে সুন্দরভাবে অভিজ্ঞতা, নীতিকথা, সমালোচনা, রাজনীতি বা কোনো বিখ্যাত ঘটনার নজির তুলে ধরা হয় প্রবাদের মাধ্যমে। মহাভারতে আছে- অগ্নি, ব্যাধি, ঋণ- এ তিনের রেখ না চিন। অর্থ :আগুন, অসুখ, ঋণ- এ তিনটির চিহ্ন রাখা উচিত না। অর্থাৎ আগুন, রোগ ও ঋণের অন্ত বা শেষ রাখা উচিত না। অবহেলা করে সামান্য রেখে দিলে পরে তা আরও বাড়তে পারে। প্রবাদ অতীতের বিষয় হয়েও সমকালকে সবচেয়ে বেশি স্পর্শ করে। আধুনিক যুগে প্রায় সব ধরনের রচনায় প্রবাদ ব্যবহৃত হয়। কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক, সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন, বক্তৃতা, এমনকি দৈনন্দিন কথাবার্তায়ও প্রবাদের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি ও প্রসার ঘটলে প্রবাদের ব্যবহার আরও বিস্তৃত হয়। প্রবাদের উৎপত্তির পিছনে কিছু কারণ বা চলতি গল্প থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই গল্প বা কারণগুলো মুছে গেলেও প্রবাদের ভেতরকার অর্থের জন্য সেগুলো ব্যবহার করা হতে থাকে। যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্তের শর্মিষ্ঠা নাটকের ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হচ্ছে- পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙা। অর্থ :পরের ক্ষতি করে নিজে লাভবান হওয়া। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার লেখা 'পেটে ও পিঠে'-তে যে প্রবাদকে লাভ-ক্ষতির সাম্যতার উদাহরণ হিসাবে উপস্থাপন করেছেন তা হলো- পেটে খেলে পিঠে সয়। অর্থ :একদিক দিয়ে লাভ হলে অন্যদিকে ক্ষতি সহ্য হয়। আবার দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণে স্বার্থ সিদ্ধির সুযোগ হাত-ছাড়া না করার পরামর্শ পাওয়া যায় প্রবাদে- নিজের চরকায় তেল দেহ (দাও)। অর্থ :অনধিকার চর্চায় সময় নষ্ট না করে নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করা। দীনবন্ধু মিত্রের জামাই বারিক প্রহসনমূলক আখ্যানে ব্যবহৃত একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হচ্ছে- জোর যার মুলস্নুক তার। অর্থ :শক্তিবান বলপ্রয়োগে যা ইচ্ছা অধিকার করতে পারে। বাংলা প্রবাদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রবাদও আছে। যেমন- লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন। এই গৌরী সেন সপ্তদশ শতাব্দীর লোক, হুগলির বাসিন্দা। কথিত আছে, ব্যবসাসূত্রে তিনি দস্তার পরিবর্তে এক জাহাজ রূপা পেয়েছিলেন। সেই লাভের টাকা তিনি সৎকর্মে ব্যয় করবেন বলে সংকল্প করেন। সবার প্রয়োজনে মুক্তহস্তে দান করে তিনি প্রবাদে স্থান করে নিয়েছেন। তার এই সুকর্মের জন্য ধন্যবাদার্হ। আর প্রবাদে বলা হয়- 'কর্মই ধর্ম। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার রচিত 'সীতারামে' প্রবাদে বলেছেন- যার কর্ম তারে সাজে, অন্য লোকের লাঠি বাজে। অর্থ :অভ্যস্ত লোকের পক্ষে যে কাজ সহজ, অন্যের জন্য তা কঠিন। প্রবাদের বিচরণ ক্ষেত্র ব্যাপক। চলতি কথা থেকে শুরু করে সাহিত্যে এর যথেচ্ছ প্রয়োগ করা যায়। অবশ্যই অকারণে নয়। এর সাহিত্য গুণ রয়েছে। ফলে সাহিত্যতেই বেশি ব্যবহার হয়, চলতি কথায় চেয়ে। আধুনিক বাংলাতে এখন এর ব্যবহার সাহিত্যতেই বেশি করে চোখে পড়ে কথ্য ভাষার তুলনায়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তার রচিত 'নীলকরে' ব্যবহৃত যে প্রবাদটি খুবই সাড়া ফেলেছে সেটা হলো- গোদের উপর বিষফোঁড়া। অর্থ :এক কষ্টের উপর আরেক কষ্ট। অন্নদাশঙ্কর রায় 'জনরবে' একটি প্রবাদে বলেছেন- কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ। অর্থ :একজনের জন্য ভালো, অন্যজনের জন্য মন্দ। কবি বিজন ভট্টাচার্যের 'চতুরঙ্গে' ব্যবহৃত জনপ্রিয় ও বহুল চর্চিত প্রবাদটি হলো- নেড়া একবারই বেল তলায় যায়। অর্থ :তিক্ত অভিজ্ঞতা মানুষকে সতর্ক করে। প্রবাদ দু-তিনটে শব্দের গোছা নয়। একেবারে লম্বা একটা বাক্য। এর অর্থ অনেক সময় না জানলে, বোঝা দুষ্কর হতে পারে। প্রবাদ বহুদিন ধরে লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বাক্য। তাই এই কদরও তেমন। মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ'র ভাষায় 'সুন্দরীর অলক-তিলকের ন্যায় প্রবাদবাক্যগুলো ভাষায় সৌন্দর্য ফুটাইয়া তোলে।' যুগ যুগ ধরে রচিত প্রবাদগুলো বাংলা ভাষার শক্তি ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।