বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ মার্কিন লেখকদের একজন আপটন সিনক্লেয়ার (১৮৭৮-১৯৬৮)। তার গ্রন্থসমূহ ওই শতাব্দীর আমেরিকার জীবন ধারা ও সংস্কৃতির দলিল। তার সম্বন্ধে তারই সমসাময়িক নাট্যকার জর্জ বার্নাড শ' একবার বলেছিলেন, লোকজন যখন জানতে চান গত ৩০/৪০ বছরের কী কী সর্বাধিক উলেস্নখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে, তখন তিনি তা জানার জন্য আপটনের উপন্যাসগুলো পড়তে বলেন। এর দ্বারা বোঝা যায়, এ লেখক ঘটনাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। তিনি ছিলেন উঁচু মানের সাংবাদিক। ছিলেন চমৎকার গল্প লেখকও। উলেস্নখ্য, সিনক্লেয়ার রাজনীতিকও ছিলেন। ১৯৩৪ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর পদের জন্য নির্বাচনে অংশ নেন। রাজনীতিকসুলভ প্রজ্ঞার চেয়ে তার বেশি বৈদগ্ধ ছিল লেখক হিসেবে। ১৯৪০ থেকে ১৯৫৩ সালের বিশ্ব ঘটনাবলিভিত্তিক তার একটি সিরিজ উপন্যাস প্রকাশিত হয়। ১৯৪০-এর শেষদিকে সেগুলো একত্রে খধহহু ইঁফফ ঝবৎরবংথ ডড়ৎষফ্থং ঊহফ নামে বেরোয়। ওই সিরিজ উপন্যাসগুলোতে লেনি বাড নামে একটি চরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। সে দূরদূরান্তে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু ঠিকই যথাসময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকে। গ্রন্থটি যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। আপটন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক সম্মাননা 'পুলিতজার প্রাইজ' পেয়েছিলেন ১৯৪৩ সালে, উৎধমড়হ্থং ঞববঃয উপন্যাসের জন্য। এ পুরস্কার নিশ্চয় তার বিশ্বজোড়া পরিচিতি এনে দেয়। কিন্তু তার খ্যাতির ভিত্তি তৈরি হয়েছিল সেই ১৯০৬ সালে, ঞযব ঔঁহমষব উপন্যাসের মাধ্যমে। বলা প্রয়োজন, ঊনতিরিশ বছর বয়সে প্রকাশিত এ উপন্যাসের জন্য নবীন লেখক প্রথম টাকা-পয়সার মুখ দেখেন। এক থেকে দেড় বছরের ভেতর এটা দ্রম্নত কাটতির বই হয়ে ওঠে। বিশ্বের সতরটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এ উপন্যাসটি।
আপটন সিনক্লেয়ারের জন্ম মেরিল্যান্ডের 'বাল্টিমোর'-এ। পরিবারটি এক সময় অভিজাত ও বিত্তশালী ছিল। তার পিতার ছিল মদের ব্যবসা। মদ বিক্রেতারা সাধারণত মদখোর হন না। কিন্তু সিনক্লেয়ারের বাবা নিজের দোকানের মদ নিজেই অতিমাত্রায় খেয়ে ফেলতেন। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে তার মৃতু্য হয় এবং ব্যবসা লাটে ওঠে। আপটন এগার বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হন। তারপর নিউইয়র্কের সিটি কলেজ থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন। কলেজ জীবনেই তার গল্প লেখার আরম্ভ। বয়স কুড়ি বছর হওয়ার আগে থেকেই লেখা থেকে পয়সা-কড়ি পেতে থাকেন এবং স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেন। ১৯১৫ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পরের ২/৩ বছরের ভেতর প্রকাশ করেন 'আপটন সিনক্লেয়ার ম্যাগাজিন।' পাশাপাশি চলতে থাকে উপন্যাস লেখার কাজও।
ঞযব ঔঁহমষব-এর বিষয়বস্তু কী? আমেরিকার তৎকালীন মাংস-প্যাকিং কারখানাগুলোর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অনিয়ম, অনাচার লেখক তুলে ধরেছেন এ গ্রন্থে। উপরন্তু বৈষম্য, অসাধু চাকরিবিধি, চাকরির অন্যায় শর্তাবলি প্রভৃতি যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন লেখক। ঞযব ঔঁহমষব যখন দ্রম্নত খ্যাতিপ্রাপ্ত, সে সময় থিওডোর রুজভেল্ট আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তিনি বইটি পড়ে রীতিমতো অভিভূত ও আহত হন। আদেশ দেন ফেডারেল তদন্তের। সেই তদন্তে ঞযব ঔঁহমষব-এ বিধৃত ঘটনাসমূহের সত্যতা প্রমাণিত হয়। এর ফলে, পাস হয় আমেরিকার অতিমূল্যবান এক আইন- ১৯০৭ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণ বিধি- যা আধুনিক আমেরিকার স্বাস্থ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থার টেকসই ভিত্তি।
সাতাশ বছর বয়সে উচ্চাশী নবীন লেখক সিনক্লেয়ার শিকাগোতে আসেন। ওঠেন শহরের কেন্দ্রস্থলে মাংস-প্যাকিং কারখানার খুব কাছের এক হোটেলের ছোট, কামরায়। ওখনে থাকতে থাকতেই তিনি ওই কারখানার ভেতরের কর্মকান্ড বিষয়ে কৌতূহতলী হন। কিন্তু কীভাবে ঢুকবেন ওখানে? এক সময় তার মনে হয়, জীর্ণ পোশাক পরে মধ্যাহ্নভোজে ব্যবহার উপযোগী একটা পানির পাত্র হাতে নিয়ে বিশাল ওই কারখানার যে কোনো দিকেই তিনি যেতে পারেন। এভাবেই শুরু। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত জীবনীগ্রন্থে সিনক্লেয়ার তার লেখক জীবনের গোড়ার দিকের কথা ব্যক্ত করেছেন এভাবে, 'প্রথমে সংশয় ছিল, আমি জায়গামতো পৌঁছাতে পারব কিনা। আমি শেষ পর্যন্ত ঠিক জায়গায় পৌঁছে যেতে পেরেছি। দিনের বেলা শ্রম্নমিকদের কাজ দেখতাম- তারা কী ধরনের কাজ করে- কেমন তাদের কাজের পরিবেশ। তারপর কৌতূহল বাড়লো। শেষে যে শ্রম্নমিকদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় ছিল তাদের বাড়িতে যাওয়া শুরু করলাম। সন্ধ্যার পর ওদের বাড়িতে গিয়ে বসতাম। কথাবার্তা বলতাম। অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতাম। তারা অকপটে উত্তর দিত। হোটেলে ফিরে সেসবের নোট রাখতাম।'
উনিশ শতকের কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা সক্রিয় ছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যাদের আর্বিভাব সে রকম কয়েকজন কথাসাহিত্যিকের মধ্যেও ওই প্রবণতা লক্ষণীয়। সিনক্লেয়ার লিউইস, শেরউড অ্যান্ডারসন প্রমুখ এ ঘরানার লেখক। ওই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন আপটন সিনক্লেয়ারও। যে সমস্ত কাজ এবং যে সমস্ত কাজের পরিবেশকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ স্বার্থের পরিপন্থি বলে মনে করেছেন সেগুলো নিয়ে কেবল সংবাদপত্রের উপযোগী প্রতিবেদন তৈরি করেননি; গল্প-উপন্যাসও রচনা করেছেন। আপটন ২৩/২৪ বছর ধরে তৈলক্ষেত্র থেকে কয়লাখনি, কয়লাখনি থেকে বড় সংবাদপত্র অফিসের ঘটনাবলিসহ সমকালিক মার্কিন জীবনের নানা দিকের ওপর লিখেছেন। করহম পড়ধষ (১৯১৭), ঙরষ (১৯২৭), অসবৎরপধহ ঙঁঃঢ়ড়ংঃ (১৯৩২), ইবঃবিবহ ঞড়ি ডড়ৎষফং (১৯৪১), উৎধমড়হ্থং ঐধৎাবংঃ (১৯৪৫), চৎবংরফবহঃরধষ গরংংরড়হ (১৯৪৭), জবঃঁৎহ ড়ভ খধহহু ইঁফফ (১৯৫৩), প্রভৃতি গ্রন্থ তার স্মরণীয় স্বাক্ষর বহন করে চলেছে।
অনেক খ্যাতিমান ইউরোপীয় ও মার্কিন লেখক প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় অনীহ ছিলেন। আপটন সিনক্লেয়ার তাদের মতো নন। পড়াশোনায় তার রীতিমতো আগ্রহ ছিল। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের কিছুকাল পর তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সাহিত্য ও দর্শন ছিল তার প্রধান পাঠ্যবিষয়। আশি বছর বয়সেও নিয়মিত পড়তেন, যদিও লেখা আর তেমন হতো না সে সময়।
১৯২৫ থেকে পাঁচের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সিনক্লেয়ার অত্যন্ত ব্যস্ত লেখক। চারের দশকটি ছিল তার জন্য সবচেয়ে ফলপ্রসূ। শুধু এই কালপর্বেই ১২/১৩টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ছিয়াত্তর বছর বয়সে জবঃঁৎহ ড়ভ খধহহু ইঁফফ (১৯৫৩) গ্রন্থটির সূত্রে তিনি আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন।
চারের দশকজুড়ে, পাঁচের দশকের প্রথম ৪/৫ বছর পর্যন্ত আপটন লেখার কাজে এতটাই যুক্ত ছিলেন যে, তাকে দু'জন স্টেনোগ্রাফার রাখতে হয়েছিল। তারা লেখকের হয়ে দিন-রাত কাজ করতেন। এ সম্বন্ধে লেখক বলেছেন, 'আমার স্টেনোগ্রাফার কর্তৃক আগের দিন সাজানো লেখাগুলো' সন্ধ্যাবেলা আবার পড়তাম। তারপর কাছাকাছি কোথাও হাঁটতে বেরুতাম। হাঁটতে হাঁটতে ভাবতাম পরের দিন কী লিখব।'
ক্যালিফোর্নিয়ার ইড়ড়শযড়ঁংব প্রকাশনী ১৯৮৬ সালে ঞযব ঔঁহমষব-এর যে সংস্করণটি প্রকাশ করে তার ব্যাক কভারে ঞযব ঘবুিড়ৎশ ঊাবহরহম ড়িৎষফ-এর মন্তব্য ছাপা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, বিগত সুদীর্ঘকালে একটি বইয়ের জন্য এমন বিশ্বজোড়া খ্যাতি আর কোনো লেখক অর্জন করতে পারেননি। আত্মজীবনীর ৬৮ পৃষ্ঠায় সিনক্লেয়ার বলেছেন, 'কেবল সত্য প্রকাশের গরজ থেকে নয়, মানবজাতির মঙ্গল চিন্তা থেকেও আমি আমার সংস্কারমূলক বইগুলো লিখেছি। মানুষকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যেই বইগুলো লেখা। একাজে আমি অক্লান্ত ও নির্ভীক।'
'শার্লক হোমস'খ্যাত আর্থার কোনান ডয়েলের একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম সেখানে তিনি লেখকদের সম্বন্ধে খুব একটা কথা বলেননি। কিন্তু আপটন সিনক্লেয়ার সম্বন্ধে বলেছেন যে, তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্পকার। সমরেশ বসু যেমন 'গঙ্গা' বা 'বাথান'-এর মতো উঁচু দরের উপন্যাস লিখেছেন, তেমনি টাকা-পয়সার জন্য 'নটনী'র মতো নিম্নমানের গল্পও লিখেছেন। টাকার জন্য সিনক্লেয়ারও তার কলম্বিয়া অধ্যায়ে লিখেছেন কিছু হালকা উপন্যাস ও চটুল রোমান্স। ৮৯ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। মৃতু্যর পঞ্চান্ন বছর পরেও তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে প্রধানত তার তিনটি কাজ : ঞযব ঔঁহমষব, উৎধমড়হ্থং ঞববঃয ও খধহহু ইঁফফ ঝবৎরবংু ড়িৎষফ্থং ঊহফ.