তখনো পাখি ডাকা শুরু করেনি। ভাঙেনি রাতের গোঙানি। তবুও প্রতিদিনের অভ্যাসমতো আজকেও ঘুম ছুটে যায় ছায়ার। ছায়া জানে, দিনের আগে দিন শুরু হওয়ার আনন্দটা একেবারেই আলাদা। যে রোজ ভোরের পাখি হয়, সে ছাড়া অন্য কারও পক্ষে এর স্বাদ আস্বাদন করা শুধু কঠিনই নয়; একেবারে দুঃসাধ্য। এই আমেজের কেবল একটি উপমাই দেওয়া যায়, যেমন : লবণ, কাঁচামরিচ, আদা, খাঁটি সরিষার তেল পরিমাণমতো চিড়ামুড়ির সঙ্গে মনের মতো করে মাখিয়ে মচমচ করে খাওয়া। যদিও এই উপমাটি তেমন একটা মানানসই হয়নি, তবুও ছায়ার এই মুহূর্তে এর চেয়ে ভালো উপমা আর মনে আসছে না। প্রতিদিনের মতো ছায়া জানলার ছিটকিনি খুলে বাইরে একবার চোখ ঘুরিয়ে নেয়। শান্ত, স্নিগ্ধ সমাহিত বাতাস এসে ছায়ার চোখে-মুখে আলত করে চুমু খায়। সেই চুমো ছায়ার ভালো লাগে, কিন্তু চুমোর প্রতি কোনো প্রকার মায়া লাগে না। ছায়ার অস্থির চোখ জোড়া কী যেন খুঁজছে...কাকে যেন খুঁজছে...! কোনো মহামূল্য রত্ন হারিয়ে গেলে মানুষ যেভাবে খোঁজে, ছায়াও ঠিক ঠিক সেভাবেই খুঁজছে। এ যেন বিশাল মহাকাশে উট খোঁজ করার ব্যাপার! এই অসীম মহাকাশজুড়ে লক্ষ-কোটি তারকারাজি আছে। ধূমকেতু, গ্যালাক্সি, ছায়াপথ আছে; কেবল ছায়ার উট নেই। এখনো চারদিকে ঘুটঘুটে আঁধার। এমন আঁধার...যে আঁধার বাসি, পঁচা জলের মতোন আসক্তিহীন। তবুও এর একটা ভিন্ন ঘরানার জৌলুশ আছে। আদিমকালের মতো আটকোরা রূপ-যৌবন আছে। এখানেই বোধ করি মানুষের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি খুঁজে পাওয়া যায়। তার সবকিছুই এমনি নিখুঁত, এমনি অকৃত্রিম। আর মানুষের সবকিছু মেকি, ভঙ্গুর।
মেসওয়াক হাতে বারান্দায় চলে আসে ছায়া। বারান্দা তো নয়, যেন ইনডোর ক্রিকেট খেলার পিচ। যেমন ইচ্ছে ব্যাটিং, বোলিং করার মতো যথেষ্ট জায়গা আছে। বল কুঁড়ানোর জন্য ৩/৪ জন ফিল্ডারও দাঁড় করিয়ে দেওয়া যাবে অনায়াসেই। যদিও বল বাইরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। গ্রিলের বাঁধা ডিঙিয়ে বাইরে যাবে এমন সাহস কার? ছায়া তার আলিশান বারান্দায় বারকয়েক পায়চারি দিয়ে অগ্রিম মর্নিংওয়াক সেরে নিল। শরীরটা এখন আগের চেয়ে অনেকটাই হালকা লাগছে। চোখ-মুখ থেকে ঘুমের সাচ্চা আমেজটা দূর হতে শুরু করেছে। তাও একটু জলের ছিটা দিলে মন্দ হয় না। ছায়া শুনেছে, জলের স্পর্শে আগুনেরও নাকি ঘুম হারাম হয়ে যায়! কী দারুণ ব্যাপার, তাই না? ছায়া নিমের মেসওয়াকটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। এক কি দুই বিঘত পরিমাপ সময়ের জন্য ছায়ার কাছে মনে হলো মেসওয়াকটি কোনো জড়বস্তু নয়; বরং দিব্যি জীবন্ত। সে তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। ছায়ার জীবনের সবকিছু মনোযোগ দিয়ে শুনতে চায়। ছায়ার ভালোবাসা পেতে চায়। ছায়াকে ভালোবাসতে চায়। অথচ ব্রাশপ্রেমি ছায়ার জীবনে এমন একটা আগ্নেয়গিরি সময় ছিল; যখন সে মেসওয়াকের নাম শুনলে বমি করে দিত। নিজের অজান্তেই বুকের ভেতর থেকে একদলা থুতু দুই ঠোঁটের আগায় এসে জোঁকের মতো কিলবিল করতে থাকত। আর এখন ছায়ার সেই দিন নেই। ছায়া নিজেই এখন একটা মেসওয়াক হতে চায়। যেভাবে মানুষ মেসওয়াককে যত্ন আত্তি করে, ভালোবাসে, আদর করে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। ছায়ারও এখন তেমনিভাবে কারও হাতের জ্যান্ত পুতুল হতে খুউব খুউব ইচ্ছে করে।
বারান্দার ঠিক মাঝ বরাবর চমৎকার ফ্রেমে বাঁধানো একটি রাজকীয় আয়না ঝুলছে এর নিচেই বেসিন, যা ফোয়ারার মতোন জল ছিটায়। ছায়া সেই জলে হাত ভেজায়। মুখ ভেজায়। আঙুলে আঙুল ঘষায়। কিন্তু হাত-মুখ ভিজলেও মন ভিজে না। ছায়া জানে, তার যে মন একদিন দাম্ভিক পাহাড় ছিল; সেই মন এখন কেবলই একটি জ্বলন্ত মোমবাতি। যে শুধু নিজেই জ্বলছে। আশপাশের শহর, নগর, বন্দর, কাউকে জ্বালাতে পারছে না। আজকাল ছায়া নিজেকেই চিনতে পারে না। নিজের কাছে নিজেই যেন এক অন্য মানুষ।
ছায়া নিজেই জানত না যে তার বাসায় একটি গোপন কক্ষ আছে। তবে সেই গোপন কক্ষও একদিন ছায়ার একাকিত্বের কাছে হার মানে। সেই কক্ষে প্রথম যেদিন ছায়া প্রবেশ করেছিল; সেদিন বিস্ময়ে তার দু'চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। খই ফোটার মতো ছায়ার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল; আহা! কী সুন্দর আয়নাঘর। ঘরটি খুব বেশি বড় নয়। বড়জোর দশ ফিট বাই দশ ফিট। এই ঘরের চারপাশের সব দেওয়াল বিদেশি আয়নায় মোড়ানো। স্বচ্ছ কাঁচগুলো এমনভাবে ডিজাইন করে লাগানো হয়েছে যে শরীরের সামনে-পেছনে ডানে-বামে সবদিক একই সঙ্গে দেখা যায় প্রথম প্রথম এই আয়নাঘরের গুপ্ত রহস্য ছায়ার কাছে উন্মোচিত হয়নি। তবে সুতীক্ষ্ন মেধাবী ছায়ার বেশিদিন লাগেনি এর জন্ম-রহস্য উদ্ঘাটন করতে। ছায়ার নিজেকে আমূল বদলে ফেলার পেছনে এই আয়নাঘরের অবদানও কম নয়। একজন মানুষ নিজের স্ত্রীকে কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে ভালোবাসলে তার সাজসজ্জার জন্য এইরূপ একটা আয়নাঘর তৈরি করতে পারেন! এ কী আগ্রার তাজমহলের চেয়ে কোনো অংশে কম? অবশ্যই না। বরং কেবল ভালোবাসার সূচকে হিসাব করলে কিছুটা বেশিই হবে। আর এসব ভাবলেই ছায়ার অবুঝ মন আরও অবুঝ হয়ে ওঠে। নিমিষেই দুই চোখ ছলছল করে। একদিন যে স্বামীকে অপমান, অবহেলায় নিজঘর ছাড়া করেছে, সেই স্বামীর পথ চেয়ে চোখের জলের মহড়া দেওয়া ছাড়া আজ ছায়ার আর কিছুই করার নেই। আয়নাঘরের রহস্য উন্মোচন করার পর থেকে ছায়ার অনেক কিছু না হলেও চলে কিন্তু আয়নাঘর ছাড়া একদিনও চলে না। যদিও শৈশব থেকেই ছায়া আয়না পছন্দ করত। আর এজন্য মেয়েবেলায় বান্ধবীরা মজা করে তাকে আয়নামতি বলে খেপাত।
ছায়া একজন অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে আয়নাঘরে প্রবেশ করল। তারপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। এ দেখা যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। নিজেই বুঝতে পারছে না সে কি যুবতী, না কিশোরী। দুই-তৃতীয়াংশ ফুটন্ত একটা গোলাপ যেন ছায়ার এই বাড়ন্ত রূপের কাছে কিছুই না। নাক, মুখ, চোখ সবকিছু বারবার খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখার পর ছায়া কিছু একটা ভাবতে ভাবতে শরীরের নিচের দিকে নামতে লাগল। অবশেষে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, তার মতো সুডৌল বক্ষ পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় কোনো মেয়ের নেই। জান্নাতের হুরদের থাকলেও থাকতে পারে। ছায়া বেশ কিছুক্ষণ নিজের চোখে, মুখে, গালে, থুঁতনিতে, বাঁশির মতো খাঁড়া নাকে হাত বুলিয়ে আদর করে। আয়নার সামনে নিজেকে আদর করতে ছায়ার বেশ লাগে। একটা সময় ছায়ার অবাধ্য হাত দু'টি আরও নিচে নামতে চায়। তবে ছায়া নামতে দেয় না। ভেতর থেকে চিৎকার করে কে যেন বলে, 'এ অধিকার শুধু আমার!' ছায়া বুঝতে পারে না; সেই আমিটা কে? সেই আমিটা কি ছায়া নিজে নাকি তার হারিয়ে যাওয়া স্বামী? নাকি তার স্বামী এবং সে দু'জনে মিলে এখন একই আত্মা? এসব ভাবনা ছায়াকে বিপদে ফেলে দেয়। ছায়া সঙ্গে সঙ্গে হাত দু'টিকে শাসন করে। সরিয়ে নেয়। এসব করতে করতে হঠাৎ ছায়া খেয়াল করে আজও তার অবাধ্য চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। ছায়া ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে জল মুছে নেয়। বুঝতে পারে তার মনটা এখন মোটেই ভালো নেই। একে যে করেই হোক ভালো করে তুলতেই হবে।
আচ্ছা, নিজের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে কেমন হয়। ভালো-মন্দ একটা কিছু তো হবেই। কে না জানে, স্রষ্টা ছাড়া মহাজগতের সবকিছুই আপেক্ষিক। সবকিছুর জয় যেমন আছে, তেমনি ক্ষয়ও আছে। ছায়া আয়নার ভেতর গভীর মনোযোগ দিয়ে এমনভাবে তাকাল যেন তার নিজের হৃদয়ের ভেতরটা সুস্পষ্ট দেখা যায়। অতপর নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল, কেমন আছ সুকেশ সুন্দরী?
হঠাৎ এই 'সুকেশ সুন্দরী' শব্দের ব্যবহারে ছায়া নিজেই কেমন একটু থতমত খেয়ে নিল। আসলেই তো তাই। শোকেসে সাজিয়ে রাখা দামি শোপিচের মতো সেও এখন কেবলই অর্থহীন শোভাবর্ধক। কেননা যে কোনো কিছুর সার্থকতা হলো ব্যবহৃত হওয়ার মধ্যে। এহেন বিব্রতকর প্রশ্নের পরও ছায়া আমতা আমতা করে বলল, সত্যি কথা বলতে কি আমি ভালো নেই।
এখন ভালো নেই কেন? বাসরঘরে স্বামীর সঙ্গে খুব তো বাহাদুরি দেখিয়েছিলি?
ছায়া কাঁপতে কাঁপতে বলল, তখন আমার কী হয়েছিল আমি জানি না। তুমি বিশ্বাস কর, আমি এমন করতে চাইনি।
এখন তোর এই কথা পৃথিবীর কেউ কি বিশ্বাস করবে?
তা জানি। কেউ করবে না। কিন্তু...
কোনো কিন্তু নয়। তোর নিরপরাধ স্বামীর এই পরিণতির জন্য তুই একমাত্র দায়ী। তুই একটা পাপিষ্ঠা।
না...না...আমি পাপিষ্ঠা নই। আমি চাই আমার স্বামী ফিরে আসুক। আমি তার পায়ে ধরে ক্ষমা চাইব। নিশ্চয়ই তিনি আমাকে ক্ষমা না করে পারবেন না।
এই পর্যন্ত কথোপথন শেষ করে ছায়া আবার বাইরের দিকে তাকায়। কয়েকটা শেয়াল আর কুকুর একসঙ্গে খেলা করছে। একটা আরেকটার মুখে মুখ ঘষে দিচ্ছে। নাকে নাক ঘষে দিচ্ছে। লেজের দিকে আলত কামড় দিচ্ছে। প্রকৃতির এই বিরূপ দৃশ্য দেখে ছায়া রোজকার মতো আজ আবারও আশা বেঁধে রাখে। ছায়া নিজেকে খুব ভালোবাসে। প্রতিটি মানুষই তাই করে। ছায়া জানে মানুষের স্বভাবের, আচার-আচরণের পরিবর্তন হয়। শিয়াল-কুকুরের হয় না।
ছায়া বিশ্বাস করে যে মানুষটিকে একদিন সে সুতীব্র ঘৃণা করত, সেই মানুষটিকে সে এখন সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। এমনকি তার নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। সেই মানুষটি কে? যে কিনা গল্পে না থেকেও নায়কের আসনে বসে আছেন! তাহলে কী সেই মানুষটির পরিচয়?
বড়লোক জামাই পেয়ে মা-বাবা এক প্রকার জোর-জবরদস্তি করেই মানুষটার সঙ্গে ছায়ার বিয়ে দিয়েছিল। তারপর সবার ক্ষেত্রে যেমন হয়, ছায়ার জীবনেও আসে সেই বাসর ঘর! যে বাসর ঘরে সে তার প্রেমে পাগলপারা স্বামী বেচারাকে এতটুকু শরীর স্পর্শ করতে দেয়নি। লোকটি তাকে কত যে অনুনয় করেছে, মিনতি করেছে, কতবার যে তার বিনয়ের বাহু প্রসারিত করেছে, কতবার যে তার নিখাদ ভালোবাসার কসম করেছে...কিন্তু একটিবারের জন্যও জোর করেনি। দেনমোহর সম্পূর্ণরূপে পরিশোধ করা স্ত্রীকে জবরদস্তি স্পর্শ করলে আইনগত তেমন কোনো সমস্যা ছিল না। তবুও তিনি একজন সত্যিকার পুরুষ মানুষ ছিলেন বলেই তা করেননি। তবে এতকিছুর পরও সেদিন পাষাণি ছায়ার মন গলেনি। কেন গলেনি সেই ইতিহাস ছায়া আজও জানে না। অপমানে, ক্ষোভে সেই নিরপরাধ মানুষটি ভোর ফোটার একটু আগে তার প্রাসাদের মতো বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। সেই যে গেল... তো গেল... আর ফিরে এলো না!
তারপর থেকেই শুরু হয় ছায়ার নতুন এক জীবন। যে জীবনে ছায়া নিজেই নিজের সঙ্গী। বলা যায়, ছায়াসঙ্গী। ছায়া হররোজ ভোরের বিছানা ছেড়ে আয়নাঘরে প্রবেশ করে। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আর তার হারিয়ে যাওয়া মানুষটির পথের বাঁকে তাকিয়ে থেকে তার মাঝে নিজেকে খোঁজে!!