'অদ্ভুতই বটে! তোর গায়ে বেলিফুলের ঘ্রাণ লেগে আছে। উঁহু শুধু বেলি না। জেসমিন, গন্ধরাজ আর বেলির মিশেল। কিন্তু বেলি'র আধিপত্য আছে।'
'তো!'
আফিয়া তাহসিনের সমুদ্র-গর্জন শুনে, আদনান হতাশ হওয়ার জোর চেষ্টা করল। মেয়েটা ফুঁসে ওঠে কথায় কথায়।
মরে যাওয়ার আগে দাদি মনে হয় ঠিক বলেছিল, যে মেয়ে কথায় কথায় ঝড় ডেকে আনে, জলের তলা থেকে শূন্যে লাফিয়ে ওঠে, সে মেয়ে মসলাদার। তাকে বিয়ে করতে পারলে জীবনে একঘেয়েমি আসবে না। বেয়াড়া ঘোটকী বসে আনতে দম লাগে। মৃত দাদিকে ভুলতে পারে না আদনান। শালার বুড়ি বেশ আধুনিক ছিল। কেন যে, মরে গেল পাজি বুড়িটা!
'আর দেখতে লাগছে বিষ্টি ভেজা গোলাপ পাপড়ি।' সাহসের রেগুলেটার ঘড়ির কাঁটার ডান দিকে আর একটু ঘুরিয়ে দিয়ে মুচকি হাসলো আদনান।
কি শয়তানি হাসি রে! ফ্রাই প্যানের গরম তেলে ক' ফোটা জল পড়েছে যেন! তেলে জ্বলে ছ্যাঁৎ করে উঠলো আফিয়া, 'চুপ থাকবি! সাত সকালে মেজাজে আগুন ধরাস না আদির বাচ্চা। সব সময় পকেটে ম্যাচ লাইট বয়ে বেড়ানো অভ্যাস তোর।
আফিয়ার মুখে ওর নাম বিকৃত হতে দেখলে মজা লাগে আদনানের। চোয়াল শক্ত করে বলবে- 'আদি!' কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হতাশা ও কষ্টের আবহ সৃষ্টিতে আদনান বেশ পটু।
এখন সেই অস্ত্র প্রয়োগ করল ও। নিখুঁত নিশানা, 'ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে এভাবে কেউ কথা বলে! আজই মামাকে বলতে হবে। শেষ পর্যন্ত তুই-তুকারি! আমি বিড়ি খাই না। আমার পকেটে ম্যাচ লাইট থাকে না। ওটা তোর ফুপির কাছে থাকে। চুলা জ্বলায়!'
'আজ-টাজ না, এক্ষুনি বল। তুই যে ভাইয়া থেকে ছাঁইয়া হওয়ার কোশিশ করছিস, সেটাও বলিস।' দুহাত দু'দিকে প্রসারিত করে ভেংচি কেটে আবার বলল, 'আফিয়া তাহসিন,' ওরে আমার ভাইয়া! হুঁহ!'
নিরীহ দূর্বাঘাসের আভাস মিশে গেল আদনানের গলায়, 'আমি তোর ফুফাতো ভাই, সেটা জানিস না? তিন বছরের বড়, মানিস না! ফুফাতো ভাইয়ের প্রতি মামাতো বোনের অনেক দায়িত্ব থাকে। বুঝলি?'
এই ভনিতায় না হেসে পারা দুষ্কর। হাসতে হাসতে বাতাসে হেলে পড়া জবা ফুল হলো আফিয়া তাহসিন। হ্যাঁচকা টানে আদনানকে সোফায় বসালো। কপট মেজাজ দেখিয়ে বললো, 'কি কি দায়িত্ব পালন করতে হবে ফুপাতো বড় ভাইয়া?'
ভ্রূ কুঁচকে আদনানের দিকে বাঁকা দৃষ্টি হানলো সে। তারপর চকিতে সরে গেল খোলা জানালার কাছে। বাইরে তাকালে পদ্মা নদী। জানালায় হেলান দিয়ে আদনানের উদ্দেশে নাটুকে স্বরে আবার বলল, 'বলুন না বড় ভাইয়া। কি আমার দায়িত্ব-কর্তব্য'। ঠোঁট বাঁকালো সে।
'শোন, আষাঢ় মাসে বৃষ্টি হয়। পাতা ভিজে যায়। পাতা ছোঁয়া পানি মাটিতে পড়ে। মাটি গলে যায়।'
'তো!'
গম্ভীর হলো আদনান। আফিয়া বুঝতে পারছে আদনানের এই গম্ভীরতা ভান না। ঘন মেঘের মতো প্রগাঢ় এবং ভারী। এখনি বৃষ্টি হয়ে ঝাঁপাবে।
আদনান বললো, 'এই ঘরটা আষাঢ় মাস। তুই হলি বৃষ্টি। তোর মন বিষ্টি ভেজা পাতা। আর আমি মাটি। না ভিজে, না গলে উপায় আছে?'
কয়েকটি নীরব মুহূর্ত। আফিয়ার চিবুকে দানা বাঁধলো গোধূলির আবির। অনুভূতিগুলো গলায় আটকালো। পানি লাগবে ওর। পানি হয়ে এগিয়ে এলো আদনান। আফিয়ার কানের লতি ছুঁয়ে দিল।
তারপরও খানিক সময় নিল আফিয়া তাহসিন।
ঘন শ্বাস ফেলে আদনানের চোখে চোখ রাখল।
বুঝলো, সত্যিই চোখ মনের কথা বলে। না বলা মুগ্ধতায় ভরে আছে আদনানের মুখমন্ডল।
ঝড় থামার পর প্রকৃতি যেমন থমথমে হয়, ঘরের পরিবেশ এখন তেমন। চোখ ও মনেরও শুশ্রূষা হলো আফিয়ার। এই প্রথম আদনানের জন্য ভালোবাসা জন্মেছে ওর মনে। মাত্র ঘটলো ব্যাপারটা। করোটির ভেতরে ঘটে গেছে রাসায়নিক বিক্রিয়া। পর্দা সরিয়ে জানালার বাইরে তাকালো ও। জলে ভরা নদী। দুলছে! টলমল করছে নৌকা। উদ্ভাসিত হয়ে আছে নিসর্গ।
এক শতাব্দী পর শোনা গেল আফিয়া তাহসিনের অস্ফুট কথা, 'আদনান, আজ থেকে আফিয়া তাহসিন তোর! যদি কোনো দিন বেইমানি করেছিস, তোর কলিজা খেয়ে ফেলব। মনে রাখিস।'
'নিচে যাই মামার কাছে।' হঠাৎ ত্রস্ত পায়ে ঘর থেকে বেরুতে উদ্যোত হলো আদনান।
'আব্বুকে কি বলবেন?'
'বলতে হবে না, তোকে বাগে আনতে পেরেছি।'
কে কার বাগে এলো, কে জানে! আফিয়া জানে, আদনান খুব সৎ ও সাহসী ছেলে। ভাবতে ভালো লাগল, মাঝেমধ্যে এই ভাইয়া কাম ছাঁইয়াকে বকাঝকা করা যাবে। ফুপুকে বলে টাইট দেয়া যাবে।
এক অকল্পনীয় দীর্ঘতা পেয়ে বসেছে আফিয়া তাহসিনকে। জানালার বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল ও। দূরের ওই দেবদারু গাছ, যেটা কিনা সূর্য ছুঁয়ে দেয় গোধূলির সময়, তার চেয়ে আফিয়া আজকে লম্বা হয়েছে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে আফিয়ার।
'সমস্যা নেই! তুই কাঁদ। আমি ছাড়া কেউ নেই এখানে। মামাকে মানাতে পেরেছি।'
\হকখন যে শয়তানটা পেছনে এসেছে দাঁড়িয়েছে, টের পায়নি আফিয়া। কিন্তু সত্যি সত্যি কেঁদে উঠলো ও। কেউ এত মিস্টি করে ফোঁপাতে পারে, জানা ছিল না আদনানের। দাদি বলত দূরন্ত, দামাল অথচ মায়াবতী একটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াবে ও। শালার বুড়ি কি করে ভবিষ্যৎ দেখেছিল কে জানে!