গ্রামের নাম কালিন্দীপুর। সময়ের সঙ্গে সভ্যতার আলো পৌঁছালেও মানুষের বিশ্বাস আর সংস্কার এখনো আটকে আছে শতবর্ষ আগে। এক অদ্ভুত ভয় এখানে দিনের আলোতেও ছড়িয়ে থাকে। এই গ্রামে অনেক গল্প শোনা যায়- বটগাছ, ছায়া আর অশরীরীর। অমিত শহরের ছেলে। প্রগতিশীল গবেষক। যুক্তিবাদী মন আর কুসংস্কারের প্রতি অমোঘ টান তাকে নিয়ে এসেছে এই গ্রামে। তার প্রজেক্টের বিষয়বস্তু হলো লোককথা আর স্থানীয় বিশ্বাসের মনস্তত্ত্ব। গ্রামে ঢোকার পর থেকেই নানা ধরনের গল্প তার কানে আসে।
গ্রামের সবচেয়ে পুরনো আর ভয়াবহ কুসংস্কারটি জড়িয়ে আছে সেই বড় বটগাছটিকে ঘিরে। গাছটা গ্রামের ঠিক মাঝখানে। শোনা যায়, বহু আগে এখানে এক বিধবা নারী আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই থেকে এই গাছ নাকি অভিশপ্ত। প্রতি পূর্ণিমার রাতে গাছের ছায়ায় নেমে আসে এক অদৃশ্য শক্তি। সে কারো পিছু নিলে তাকে আর মুক্তি দেয় না। তাকে সবাই ডাকে 'ছায়াসঙ্গী।'
অমিত এসব শুনে মৃদু হেসে বলেছিল, 'গল্প বলার দক্ষতা আপনাদের চমৎকার। তবে ভয়ের কিছু নেই। এসব মনের খেলা।'
গ্রামের বৃদ্ধা রমলা তাকে সাবধান করেছিলেন, 'ছেলেটা না বুঝে বড়াই করছে। যারা ছায়াসঙ্গীর শিকার হয়েছে- তারা কখনো ফেরেনি। বটগাছের কাছে রাতে যেও না, বাবা।'
অমিতের মাথায় কৌতূহলের ঝড়। শহুরে ব্যস্ত জীবন ছেড়ে এই গ্রামে এসে সে প্রথমবার বুঝল, অদ্ভুত রহস্যের টান মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে।
গ্রামের অতিথিশালায় অমিতের থাকার ব্যবস্থা হলো। ছোট ঘর, কাঠের জানালা, পুরনো আসবাব। ঘরের এক কোণে একটি টেবিলল্যাম্প জ্বলছে। জানালার বাইরে পূর্ণিমার আলোয় চারপাশটা যেন স্বপ্নের মতো সুন্দর। অমিত বসে বসে গ্রামের গল্পগুলো নিয়ে নোট লিখছিল। হঠাৎ জানালার পর্দা উড়ে গেল। বাতাসের সঙ্গে মৃদু একটা আওয়াজ ভেসে এলো- মনে হলো ঘুঙুরের। সে চমকে জানালার বাইরে তাকাল। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। কিছুক্ষণ শুনে মনে হলো আওয়াজটা দূরে, বটগাছ থেকে আসছে।
মাথা ঝাড়া দিয়ে সে নিজের কাজে মন দিল। 'এসব অলস মনস্তত্ত্ব। ঘুঙুরের আওয়াজ আসলে বাতাসের খেলা।'
কিন্তু রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই আওয়াজ তীব্র হতে লাগল। ঘরের ভেতর তার ছায়াটাও একটু একটু করে বড় হচ্ছিল। অমিতের মনে হলো ছায়াটা অস্বাভাবিক এবং এটা তাকে অনুসরণ করছে।
সে আতঙ্কিত হয়ে বাতি বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম এলো না। ঘরের ভেতর কারো ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল।
সকালে ঘুম ভাঙল পাখির ডাক শুনে। রাতের ঘটনার কথা মনে পড়তেই হাসল অমিত। ভাবল, হয়তো দেরি করে ঘুমানোর জন্য এমনটা ঘটেছে।
গ্রামের মানুষজনকে জিজ্ঞেস করায় তারা বেশ ভয় পেয়ে গেল। 'তুমি কি সত্যি বটগাছের কাছে যাবে?'
\হ'কেন নয়?' অমিত বলল। 'আমি সব সত্য সামনে আনতে চাই। এই ছায়াসঙ্গীর গল্পের রহস্যভেদ করতে চাই।'
বৃদ্ধা রমলা তাকে একবার চোখ তুলে দেখলেন। 'ছেলে, পা বাড়ানোর আগে আবার ভেবে দেখো। বটগাছ শুধু গাছ নয়। ওখানে যারা যায়, তাদের সঙ্গে কিছু থেকে যায়। তোমার ছায়া, তোমার বন্ধু, তোমার জীবন সব কিছু বদলে যাবে।'
রমলার কথা শুনে অমিত মৃদু হাসল। কিন্তু দুপুরে বটগাছের কাছে পৌঁছে তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। গাছটা অদ্ভুত বড়, যেন আকাশ ছুঁয়ে গেছে। আর গাছের শিকড়গুলো মাটির উপরে উঠে এসে অদ্ভুত আকার নিয়েছে। সে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু তার পেছনে একটা ঠান্ডা বাতাস অনুভব করল। যেন কেউ ফিসফিস করে ডাকছে, 'অমিত'
রাতে ঘরে ফিরে অমিতের অস্বস্তি বাড়ল। তার ছায়া আগের মতো নেই। ঘরের কোণায় যে ছায়াটা পড়ে, সেটার আকার আরও বড় হয়ে গেছে।
সে ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু বাইরের আলোয় ঘরের ছায়াটা আরও গভীর হয়ে ঘরের দেয়ালজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ঘুঙুরের শব্দ এবার একটানা বাজতে শুরু করল।
সে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু একটা অনুভূতি তাকে জাগিয়ে রাখল। কেউ যেন তার পাশে বসে পা দুলিয়ে ঘুঙুরের শব্দ করছে।
ঘুমের ভেতর অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। সাদা কাপড় জড়ানো এক নারী তার সামনে দাঁড়িয়ে। তার মুখ ঢাকা। আর তার পায়ে ঘুঙুর। 'তুমি পালাতে পারবে না', নারীকণ্ঠে মৃদু ফিসফিস শব্দ।
অমিত বুঝতে পারল, কিছু একটা হচ্ছে। ছায়া তাকে ছাড়ছে না। যেখানেই যাচ্ছে, ছায়াটা তাকে অনুসরণ করছে। ঘুঙুরের আওয়াজ কানে বাজছে সারাক্ষণ।
গ্রামের মানুষ তাকে পরামর্শ দিল, 'এ গ্রাম ছেড়ে চলে যাও। তবে মনে রেখো, ছায়াসঙ্গী যার পিছু নেয়, সে সহজে মুক্তি পায় না।'
অমিত সিদ্ধান্ত নিল সে চলে যাবে।
পুরো আকাশ জুড়ে পূর্ণিমা আজ। গ্রামজুড়ে নিস্তব্ধতা। অমিত তার ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে বের হলো। অমিত যত দূর হাঁটছে, ছায়াটা তাকে আগলে রাখছে।
বটগাছের সামনে যেতেই শুনতে পেল সেই ডাক, 'অমিত'
সে থমকে দাঁড়াল। ঘুঙুরের আওয়াজ এবার ঠিক মাথার পেছনে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল অমিত।
সাদা কাপড় জড়ানো নারী। মুখ ঢাকা। আর ছায়া মিশে আছে অমিতের ছায়ার সঙ্গে।
অমিত দৌড়ে পালাতে চাইল। কিন্তু পা নড়ল না। চারপাশ থেকে ছায়ারা এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। ঘুঙুরের আওয়াজ থেমে গেল। আর অমিতের চোখে ঘুম নেমে এলো। পরের দিন সকালে অমিতকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। বটগাছের নিচে শুধু তার ছায়া পড়ে রইলো। এই কথা নিমিষেই গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল, 'অমিত ছায়াসঙ্গীর সঙ্গে মিশে গেছে'। এখনো পূর্ণিমা রাতে বটগাছে শোনা যায় ঘুঙুরের মৃদু আওয়াজ আর ছায়ার ফিসফিসানি : ফিরে এসো.....