:ডিম রাখবেন গো, ডিম!
মৃদু কণ্ঠের হাল্কা হাঁক। কাছাকাছিতে থাকা লোকজনই কেবল শুনতে পায়। দূরের কারোর কাছে আওয়াজ পৌঁছায় না। বোধহয় ডিমওয়ালির ইচ্ছাও নয়, তার ডিমগুলো সব বিক্রি হয়ে যাক। তার ডিম কেউ কিনুক।
তবু সে ডিমওয়ালি। কুলসুম তার নাম। বয়স ২৯-৩০ বছরের বেশি নয়। মাথায় শাড়ির আঁচলে ঘোমটা টান। সদর রাস্তা ধরেই হাঁটছে সে। 'ডিম রাখবে গো ডিম' বলে তার হাঁকডাক যতখানি না প্রবল, হাঁটার গতিবেগ তার চাইতে অনেক বেশি দ্রম্নত। হাতে ঝুলানো একটা হাঁড়ি। মাটির হাঁড়ি। হাঁড়ির গলায় রশি। তাই জড়িয়ে সে ডিম ফেরি করে।
গতকাল এক পথে গেলে আজ অন্য পথ ধরে। এইভাবে সে নিত্য পথ বদলায়।
এমনিতে এলাকাটা সুনসান। দোকানপাট খোলে কি খোলে না। রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল কম। এমনিতে এটা একটা সীমান্তবর্তী এলাকা। পাকিস্তানি আর্মির লরি আর সাঁজোয়া গাড়ি যায় দুদ্দাড়। ওদিকে যখন তখন মুক্তিবাহিনীর হামলা। রাস্তার দুইপাশে লাগোয়া জনপদে আতঙ্ক।
এই ডিমওয়ালির কি কোনোই ভয়-ডর নাই? এমন পরিস্থিতি পরিবেশে একা একা চলাফেরার সাহস পায় কোত্থেকে?
হঠাৎ পেছনে ডাক : এই ডিমওয়ালি!
ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল কুলসুম। রাস্তার মোড়েই এক পানওয়ালার দোকান। পানওয়ালাই ডাকছে তাকে।
পানের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল কুলসুম।
দোকানি বলল : আপনার ডিমের হাঁড়িটা দিন। কেমন ডিম এনেছেন দেখি। বেছে-বুঝে ডিম নেব।
কুলসুম তাকাল তার হাঁড়ির দিকে। নির্বিকার কণ্ঠে বলল : বেছে বেছে ডিম বিক্রি করি না।
দোকানি আশ্বাস দিল : ঠকাব না। ন্যায্য দামই দেব।
কুলসুম পাল্টা প্রশ্ন করল : আপনার দোকানের মালপত্র খদ্দেরকে কি নিজ হাতে বেছে নিতে দেন? নাকি আপনি নিজেই নিজের হাতে তুলে দেন?
দোকান থেকে রাস্তার দিকে ফিরল কুলসুম। সোজাসাপ্টা বলে দিল : আপনার কাছে ডিম বেচব না।
রাস্তা ধরে হনহন করে এগিয়ে যেতে লাগল।
দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিল একজন ক্রেতা। বলল : ডিমওয়ালির সাহস আছে বৈকি।
হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে হাসল কুলসুম। এই কথাটি জননেতা হাজী দানেশও বলেছিলেন। কুলসুমকে দেখে অবাক হয়ে তিনি এই কথাটা বলেননি, তার প্রতি আস্থা জানিয়েছিলেন।
বাঙালিদের ওপর তখন পাকিস্তানি হানাদাররা হামলা চালিয়েছে। সারা দেশে দুর্যোগ। পরিস্থিতি টালমাটাল। এই সময়টাতেই কুলসুমদের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা থানার নাজিরপাড়া গ্রামে খবর এলো, তার বড় বোন অন্তঃসত্ত্বা। ওরা থাকে দিনাজপুর শহরে।
কুলসুম দেখতে এলো বড় বোনকে। দুনিয়ার দুর্যোগ মাথায় নিয়েই।
কয়েক দিন পরেই দিনাজপুর শহরে আক্রমণ চালাল পাকিস্তানি হানাদাররা। গোলাগুলির মধ্য দিয়ে কুলসুম তার বোনের পরিবারের সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে এলো ভারতের গঙ্গারামপুর থানা শহরে। তাদের যেখানে আশ্রয় জুটল তার পাশেই মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন কৃষকনেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশসহ আরও কয়েকজন। হাজী দানেশ আবার সম্পর্কে কুলসুমের দুলাভাই। ফুপাতো বোনের স্বামী।
কুলসুম এসে ধরল হাজী দানেশকে, সেও মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখাবে। ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়তে পড়তে আর লেখাপড়া হয় নাই। তবে মুক্তিযুদ্ধে ঠিকই ভূমিকা রাখতে পারবে, স্বাধীনতা না পাওয়া পর্যন্ত থামবে না।
হাজী দানেশ শুনে হাসলেন। বলল : তোর বাপ একসময় বাঘ মেরেছিলেন। তাঁর মেয়ে যদি মুক্তিযুদ্ধ না করে তাহলে দেশ কেমন করে স্বাধীন হবে!
পরদিনই শপথ। স্বাধীন বাংলার পতাকা ছুঁয়ে।
কুলসুমের আপাতত ভূমিকা ডিমওয়ালির। মাটির হাঁড়িতে করে ডিম পৌঁছে দেয় সীমান্তের ভিতরে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে।
এমনই এক ক্যাম্পে এলো কুলসুম। তাকে দেখেই মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের কমান্ডারের মুখে হাসি ফুটল। বলল : আপা, এসেছেন! এবার আমাদের খাওয়া-দাওয়াটা ভালো মতোই জমবে।
একজন নতুন রিক্রুট মুক্তিযোদ্ধাকে ডেকে কুলসুমের কাছ থেকে ডিমগুলো বুঝে নিতে বলল কমান্ডার।
নবীন যোদ্ধা হাঁড়ি হাতে নিতেই কুলসুম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করল : সাবধান! ডিম কিন্তু ফেটে যেতে পারে!
যুবক হাঁড়িতে নজর রেখে বলল : মাত্র এই কয়টা ডিম! এতো বড় হাঁড়ি!
মাটিতে হাঁড়ি রেখে গুনে গুনে ১৫টি হাঁসের ডিম বের করল। ডিমগুলো একটা ঝুড়িতে রাখল। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল কুলসুমের দিকে।
কুলসুম মিটি মিটি হাসছে। বলল : হাঁড়িতে আর নাই?
: আছে। খড়।
: বের করে ফেল।
খড় বের করে মাটিতে রেখে যুবক বলল : আর কিছুই নাইতো। শুধু বালু দেখতে পাচ্ছি।
কুলসুম মৃদু হেসে বলল :তার তলাতেই সোনার ডিম। সাবধানে হাত ঢুকিয়ে বের কর। দেখ, ফেটে যেন না যায়!
যুবক হাঁড়ির বালির ভিতরে হাত চালিয়ে বের করে আনল যে জিনিসটা সেটা কোনো ডিম নয়, একটা গ্রেনেড। বিস্ময়ে সে তাকিয়ে রইল তার হাতের মুঠোর দিকে।
কুলসুম এক গাল হেসে বলল : আরও আছে। খান সেনাদের খাদ্য।