মহাশ্বেতা দেবী (১৯২৬-২০১৬, কলকাতা) বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকার কর্মী। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড় রাজ্যের আদিবাসী উপজাতিগুলোর অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য তিনি কাজ করেছিলেন। মহাশ্বেতা দেবী বহুবার ভারতের উপজাতি মানুষের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। মহাশ্বেতা যতখানি লেখক, ততখানিই অ্যাক্টিভিস্ট।
মহাশ্বেতা দেবী সব সময় বিশ্বাস করতেন যে, সত্যিকারের ইতিহাস সাধারণ মানুষের দ্বারা রচিত হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সাধারণ মানুষ যে লোককথা, লোকগীতি, উপকথা ও কিংবদন্তিগুলো বিভিন্ন আকারে বহন করে চলেছে, তার পুনরাবির্ভাবের সঙ্গে তিনি ক্রমাগত পরিচিত হয়ে এসেছেন। প্রথম জীবনে সাংবাদিকতার পাশাপাশি তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিল্পনীতি সমালোচনা করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা শুরু করেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। তার লেখা হাজার চুরাশির মা, তিতুমীর, অরণ্যের অধিকার অবিস্মরণীয় রচনা হিসেবে বাংলা সাহিত্যে স্বীকৃত। তার লেখা উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে 'রুদালি'-এর মতো কালজয়ী সিনেমা।
শেষে মহাশ্বেতা দেবী বামপন্থি রাজনীতির আন্দোলন থেকে সরে আসেন। রাজ্য-রাজনীতিতে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় তাকে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকায় দেখা যায়। তিনি সমাজকর্মী, তিনি আমৃতু্য নিপীড়িত, বঞ্চিত-শোষিত মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে গেছেন। কর্মজীবনের শুরু থেকেই তিনি ভারতীয় বিভিন্ন উপজাতির মানুষের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ, ছত্তিশগড় কিংবা বিহার বা মধ্যপ্রদেশসহ অনেক জায়গায় তিনি সংশ্লিষ্ট রাজ্যের আদিবাসী উপজাতিগুলোর ক্ষমতায়ন ও তাদের সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে কাজ করে গেছেন। পশ্চিমবঙ্গে তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন শিল্প স্থাপনের উদ্দেশ্যে। অন্যায়ভাবে তৎকালীন সরকারের কৃষিজমি অধিগ্রহণ নীতির বিরুদ্ধে। শান্তিনিকেতনের বাণিজ্যিকীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হলে মহাশ্বেতা দেবী তার তীব্র বিরোধিতা করেন। শিক্ষকতা, গণ-আন্দোলন, সমাজ সংস্কার ও মানবাধিকার আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই তিনি অতিবাহিত হয়েছিল। শবর গ্রামের সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি দপ্তরে ক্রমাগত চিঠি লিখেছেন আন্দোলনের প্রয়োজনে তিনি। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের অন্যতম মুখ তিনি। 'অরণ্যের অধিকার'-এর সেই প্রবাদপ্রতিম লাইন 'উলগুলানের মরণ নাই'-এর জননী। মহাশ্বেতা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে দিলিস্ন বোর্ডের শিক্ষার্থীদের জন্য 'আনন্দপাঠ' নামে সংকলন তৈরি করেন। এখানে তিনি জিম করবেট, লু সু্যন, ভেরিয়ের এলউইন প্রমুখের লেখা নিয়ে আসেন বাংলা অনুবাদে। মহাশ্বেতা তার রাজনৈতিক গল্প ও উপন্যাসের জন্য বহুপাঠকের কাছে অতিদ্রম্নত পৌঁছে গিয়েছিলেন। দ্রৌপদী, বিছন, জল, রুদালি, বেহুলা, শিশু, স্তনদায়িনী, ভাত, কত গল্প! ক্ষুধার্ত আর বিপন্ন মানুষের জীবন-বৃত্তান্ত তিনি লিখেছেন। ২০১৬ সালের জুন মাসে মহাশ্বেতা দেবীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঝাড়খন্ড সরকার বিশিষ্ট আদিবাসী নেতা বিরসা মুন্ডার একটি মূর্তিকে শৃঙ্খলামুক্ত করে। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের শাসনকালে গৃহীত শৃঙ্খলিত বিরসা মুন্ডার একটি আলোকচিত্রের ভিত্তিতে মূর্তিটি নির্মিত হয়েছিল। 'বিরসা মুন্ডার' জীবনকাহিনী অবলম্বনে ১৯৭৭ সালে মহাশ্বেতা দেবী অরণ্যের অধিকার উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন।
মহাশ্বেতা দেবী সাংবাদিক ও সৃজনশীল লেখক হিসেবেও কাজ চালিয়ে যান। পশ্চিমবঙ্গের লোধা ও শবর উপজাতি, নারী ও দলিতদের নিয়ে পড়াশোনা করেন। তার প্রসারিত কথাসাহিত্যে তিনি প্রায়শই ক্ষমতাশালী জমিদার, মহাজন ও দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি আধিকারিকদের হাতে উপজাতি ও অস্পৃশ্য সমাজের অকথ্য নির্যাতনের চিত্র অঙ্কন করেছেন। মহাশ্বেতা দেবী লেখার উপাদানগুলো সংগ্রহ করেছেন সমাজের সর্বহারানোদের মাঝ থেকে; দলিত-নিম্নশ্রেণির লোকের কাছ থেকে। আজীবন কাজ করেছেন এদের নিয়ে, পড়াশোনাও করেছেন। তাই তো এসব শ্রেণি নিয়ে তার গর্ব। সগৌরবে বলতে পারেন :'...আমার লেখার কারণ ও অনুপ্রেরণা হলো সেই মানুষ- যাদের পদদলিত করা হয় ও ব্যবহার করা হয়, অথচ যারা হার মানে না। আমার কাছে লেখার উপাদানের অফুরন্ত উৎসটি হলো এই আশ্চর্য মহৎ ব্যক্তিরা, এই অত্যাচারিত মানুষ। অন্য কোথাও আমি কাঁচামালের সন্ধান করতে যাব কেন, যখন আমি তাদের জানতে শুরু করেছি? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার লেখাগুলো আসলেই তাদেরই হাতে লেখা।'
দলিতদের নিয়ে ইতিহাস লেখা হয় না কখনো। তারা আড়ালেই থেকে যায়। বাঙালি ইতিহাসেও তাই। আমরা অন্য দেশের শাসকদের নিয়ে ইতিহাস লিখি, জয়গান করি। কিন্তু আজীবন যারা দেশের জন্য, এখানকার যারা আদিবাসী তাদের নিয়ে কয়টা লেখা হয়? কয়জন স্বীকৃতি পান? কিন্তু মহাশ্বেতা দেবী লিখেছেন এদের নিয়ে, আন্দোলন করেছেন, দলিতদের অধিকার নিয়ে। রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে ব্যক্তিগতভাবেও লিখেছেন। একদিন মুন্ডা কিশোরী মহাশ্বেতা দেবীকে প্রশ্ন করেছিল : 'আদিবাসীদের কি কোনো নায়ক নেই?' এ প্রশ্ন সম্ভবত তার সারাটা জীবন তাড়িত করেছে। হয়তো সেই তাড়নায় বাংলা সাহিত্যকে তিনি ভিন্ন জীবনের আখ্যানে সমৃদ্ধ করতে চেয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন। সাহিত্য রচনার পাশাপাশি ওইসব মুন্ডারীর আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ছিলেন শবরদের মাতা। সাঁওতালদের মারাংদাই (বড় দিদি)। ক্ষুদ্র হয়ে যাওয়া গোষ্ঠীর মানুষের জীবনকে উপজীব্য করে উপন্যাস-গল্প রচনা করেছেন একের পর এক। লেখক গল্প ও উপন্যাসে নিচ শ্রেণির কথাই তুলে ধরেছেন। বিভিন্ন বক্তব্যেও তাই করেছেন। তার ছিল অকৃত্রিম দেশপ্রেম। নিজের অবস্থানের কথা চিন্তা না করে লিখেছেন সাধারণের নিয়ে। ২০০৬ সালে ফ্রাঙ্কফুট বইমেলায় ভারত দ্বিতীয়বারের জন্য অতিথি দেশ নির্বাচিত হয়। মেলার উদ্বোধনী ভাষণে মহাশ্বেতা দেবী রাজ কাপুরের বিখ্যাত চিত্রগীতি 'মেরা জুতা হ্যায় জাপানি' থেকে পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে একটি আবেগময় ভাষণ দেন : 'সত্যই এটি এমন এক যুগ যেখানে 'জুতা'টি (জুতো) জাপানি, 'পাতলুন'টি (প্যান্ট) 'ইংলিশস্তানি' (ব্রিটিশ), টোপি'টি (টুপি) 'রুসি' (রাশিয়ান), কিন্তু 'দিল'... দিল'টি (হৃদয়) সর্বদা 'হিন্দুস্থানি' (ভারতীয়)... আমার দেশ, ক্ষয়প্রাপ্ত, ছিন্নভিন্ন, গর্বিত, সুন্দর, উষ্ণ, আর্দ্র, শীতল, ধূলিধূসরিত, উজ্জ্বল ভারত। 'আমার দেশ'। মহাশ্বেতা দেবী ইতিহাস থেকে এমন চরিত্র নির্মাণ করেন- যা নিজেই ইতিহাস হয়ে যায়। প্রান্তিক মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া ইতিহাস থেকে তিনি নায়ক খুঁজে সাহিত্যে তাদের প্রতিস্থাপন করেছেন। যেমন শালগিরার ডাকে (১৯৮২) উপন্যাসটির নায়ক তিলকা মাঝি মূলত ইতিহাসের একজন নায়ক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজস্ব আদায়ের শোষণে পড়া বিহার-উড়িষ্যার সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেওয়া তিলকা মুরমুকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছেন এ উপন্যাস। ১৭৮৫ সালে এই তিলকা মুরমুরকে ফাঁসি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। প্রান্তিকগোষ্ঠী থেকে নায়ক হিসেবে তুলে ধরেছেন প্রায় তার সব গল্প-উপন্যাসে।
মহাশ্বেতা দেবীর ছোটগল্পেও দলিতদের কথা যেমন আছে, আছে রাজনীতির অন্তর্নিহিত বিশ্লেষণও। তিনি প্রায়ই বলতেন যে, সাহিত্যে শুধু হৃদয়-গ্রাহ্যতা নয়, মস্তিষ্ক-গ্রাহ্যতাও চাই। এটা মনেও লালন করতেন তিনি। তার প্রমাণ তার লেখায়, তার বক্তব্য-আলোচনায়। গল্প-উপন্যাসে এটা দারুণভাবে প্রমাণিত হয়েছে। মহাশ্বেতা দেবীর বিশিষ্টতা এই যে তিনি বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাসের ইতিহাস থেকে চরিত্র নির্মাণ করেছেন। আদিবাসী সংগ্রামের এবং ভারতীয় সংগ্রামের ইতিহাস থেকে বিপস্নবী এবং বীরের চরিত্র নিয়ে আসেন- যা বাংলা সাহিত্যের সংগ্রামী চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে। তার আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য : কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃতু্য (১৯৬৭), অরণ্যের অধিকার (১৯৭৫), চোট্টি মুন্ডা এবং তার তির (১৯৮০), সুরজ গাগরাই (১৯৮৩), টেরোড্যাকটিল, পূরণসহায় ও পিরথা (১৯৮৭), ক্ষুধা (১৯৯২) এবং কৈবর্ত খন্ড (১৯৯৪)। মহাশ্বেতা দেবী আদিবাসীদের জীবন উপজীব্য করে প্রচুর ছোটগল্প রচনা করেন, এসব গল্পগ্রন্থের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য- শালগিরার ডাকে (১৯৮২), ইটের পরে ইট (১৯৮২), হরিরাম মাহাতো (১৯৮২), সিধু কানুর ডাকে (১৯৮৫) প্রভৃতি। এসব গল্প-উপন্যাসে তিনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সামরিক নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে আদিবাসী প্রতিবাদী চরিত্র চিত্রিত করার পাশাপাশি দেশীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার শোষণের প্রতি প্রতিবাদ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর তুলে ধরেছেন। অন্য উপন্যাস-গল্পেও লেখক আদিবাসী প্রসঙ্গ এনেছেন। ককরোজ-নকরোজ (২০১২) নামে শিশুতোষ গল্পগ্রন্থও লিখেছেন তিনি। এছাড়া, অন্য গল্পগুলো হচ্ছে : ব-দ্বীপের (২০০৬), ভাতগল্প (২০১১), বৃহস্পৃতিবার (২০১৩), আমাদের গ্রামে মালো পাড়া নাই (২০১৬) এবং উপন্যাসগ্রন্থ আশ্বিনের শেষ রাত্তিরে (২০১৫) উলেস্নখযোগ্য।
মহাশ্বেতা দেবী একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিতদের শোষণ করার জন্য রাজনৈতিক শাসক বা কর্তৃপক্ষকে নিন্দা করেছেন এবং সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের জন্য আওয়াজ তুলতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য সাহিত্য প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করেছেন। হৃদয়ের টান থেকে কিছু করলে প্রকৃতিগতভাবেই পাঠকের কাছে চলে যাওয়া যায়। আন্তরিকতার খাঁদ নেই বলেই দলিতদের কাছে জননী মর্যাদা পেয়েছেন, বড় দিদির মর্যাদা পেয়েছেন। আবার অনেক পুরস্কার ও পদক পেয়েছেন। করেছেন দেশের প্রতিনিধিত্ব। এপার-ওপার দু'বাংলাতে তার অসংখ্য পাঠক সৃষ্টি হয়েছিল।