ক্ষরণ

প্রকাশ | ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

নীহার মোশারফ
সামি, এখনো শুয়ে আছ। ওঠবে না? তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল সারিকা। ওঠব। প্রতিদিন তো সময় মতো বিছানা থেকে উঠি। আজ ছুটির দিন। না-হয় একটু...। একটু কী? শোনবে? বল। গত রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি। শিরোনাম? আমার স্বপ্ন আমার প্রেম। যে স্বপ্ন আমাকে অতীতে নিয়ে গেছে। নিয়ে গেছে চার বছর আগের সেই স্মৃতিতে। যেখানে প্রেম ছিল। ছিল হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ। কী বলছ এসব? হঁ্যা, সত্যি বলছি। ঠিক আছে। বিছানা থেকে ওঠ। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে নাও। তারপর তোমার গল্প শোনব। খাবার খাওয়া শেষ হলে সারিকা সামিকে বলল, কই তোমার গল্প বলা শুরু কর। ও হঁ্যা, আমি তখন ঢাকায় বন্ধুদের সঙ্গে মেসে থাকি। পড়ালেখা করি। ফাঁকে ফাঁকে টিউশনি করি। সংসারের প্রতি দায়িত্ব থাকায় মাঝেমধ্যে খুব পরিশ্রম করি। বাড়িতে টাকা পাঠাই। খুব আনন্দেই কেটে যাচ্ছিল সময়। একদিন রুমে শুয়ে আছি। গান শুনছি। এমন সময় একটা ফোন এলো। অচেনা নাম্বার। ফোনে কী বলল? হ্যালো সামি... কে? আমি আসলাম মাহমুদ। চিনতে পেরেছ? চিনেছি। কেমন আছেন? ভালো। তুমি? আমিও ভালো। তুমি কি বাসায়? কেন বলুন তো? আমি গাঁয়ের বাড়ি থেকে রওয়ানা দিয়ে ঢাকায় পৌঁছেছি। তোমার কাছে ক'দিন থাকতে চাই। ব্যবস্থা হবে? আসুন। একটা ব্যবস্থা তো হবেই। লোকটি তোমার কী হয়? সারিকা বলল। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে চিনি। খুব কাছের আত্মীয় নয়। এলাকার বড় ভাই। আচ্ছা। তারপর? আসলাম ভাই আমার মেসে ওঠেন। রান্নাবান্নায় খুব সমস্যা। কাজের বুয়া নেই। আমি একটু-আধটু যা রান্না করতে পারি। লেগে গেলাম কাজে। খাওয়া-দাওয়া শেষে দুজন বিকালে ঘুরতে বের হলাম। আসলাম ভাই দুদিনের কথা বলে প্রায় তিন মাস আমার সঙ্গে ছিলেন। অবশ্য ততদিন থাকার একটা কারণও ছিল। এক সময় জানতে পারি রাজনৈতিক ঝামেলা এড়াতেই নাকি আমার কাছে তার থাকা। তাই? আরে শোনো না, ভেতরে ভেতরে বড় ভাইয়ের প্রতি আমার খুব রাগ হলো। মুখে কিছু বলতে পারছি না। নীরবে সহ্য করে যাচ্ছি। কেন, তুমি তাকে সরাসরি 'না' বলে দিতে। সারিকা বলল। তা কী করে সম্ভব? তারপর? একদিন আসলাম ভাই আমাকে এক উদ্ভট প্রশ্ন করলেন। কী প্রশ্ন? আমি বিয়ে করেছি কিনা। তুমি কী বললে? আমি বললাম, বড় ভাই হঠাৎ এমন প্রশ্ন? না। এমনিতেই। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে আসলাম ভাই। খুলে বলুন তো। আসলাম ভাই বলল, আসলে সামি তোমার এখানে এসে আমি ক'দিনে তোমার যে ব্যাপক পরিচিতি দেখলাম কাব্যজগতে, তাতে অবাক হয়েছি। অথচ তোমাকে আমরা গ্রামের কেউ বুঝতেই পারিনি। তোমার কর্মকান্ডের মধ্যে একটি পরিচ্ছন্ন জীবন খুঁজে পেয়েছি। খুব ভালো লাগল তোমার কাব্যচর্চা দেখে। কী যে বলেন ভাই। আমি মনে করি, তোমার কাব্যময় জীবনকে আরও কাব্যময় করে তুলতে একজন সুন্দর মনের মানুষের প্রয়োজন। অর্থাৎ নারীর প্রয়োজন। যার ছোঁয়া পেলে তুমি আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠবে। কেন, আমি কি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছি? না। না। তা হবে কেন? অবশ্যই তুমি সময়ের শ্রেষ্ঠ যুবক। আমি বলছিলাম, আমার পরিচিত এক যুবতী আছে। তোমার সঙ্গে মানাবে ভালো। তুমি চাইলে তার মুঠোফোন নাম্বার দিতে পারি। কথা বলতে পার। কথা বললেই তো আর প্রেম হয়ে যাবে না, তাই না? তা অবশ্য ঠিক। ভেবে দেখি। এই কথা? সারিকা বলল। হঁ্যা। তারপর আসলাম ভাইকে রুমে রেখে আমি টিউশনিতে চলে যাই। এক সময় আসলাম ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে অচেনা সেই রাজকুমারীকে ফোন করি। ফোনে সে আমাকে সাজানো কিছু প্রশ্ন করে। আমি ঠিক ঠিক উত্তর দিতে পারি বলে সে আমাকে কিছুটা হলেও বুদ্ধিমান মনে করে। কী বুদ্ধিমান স্বামী গো আমার। মানে? মানে আবার কী! আগে গল্প শেষ কর। এরপর থেকে সে আমাকে ঘন ঘন ফোন দিতে থাকে। ফোন রিসিভ করতে গেলে আমার কাজের ক্ষতি হয়। ক্ষতি হয় পড়ালেখার। তাকে না দেখে শুধু বিশ্বাসে ভর করে এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ি। তার সঙ্গে দেখা করি। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমার চেখে সর্ষেফুল। আমার চারপাশটা যেন কেমন ছোট হয়ে আসছে। ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে আকাশ। সেদিন আমার সঙ্গে আসলাম ভাই ও তার স্ত্রীরও ছিলেন। তারা বিষয়টি লক্ষ্য করেছিলেন। আমি কিছুক্ষণ নীরব ছিলাম। রাজকুমারীকে যেমনটা চেয়েছিলাম তেমনটা নয় সে। তারপর! আমি ভাবলাম, এমনও রূপ হয় নারীর। এই কি স্বপ্নের রাজকন্যা? যাকে আমি কল্পনার চোখে জ্যোৎস্নার ঘ্রাণলাগা হাওয়ার বাঁকে দেখেছিলাম। নাকি সে অন্য কেউ? কেন যেন আমার সঙ্গে তাকে মিলাতে পারছিলাম না। শুধু মনে মনে উচ্চারণ করলাম- প্রেমের কত ধরন আহা নাম যদি হয় উঃ কাকে বলে সুখের আধার কাকে বলে উঃ! তুমি তো গল্পের নায়ক। কবি। কবিদের হৃদয় আকাশের মতো উদার। তোমাকে যারা চিনবে, বুঝবে তারাই হবে জগতের সবচেয়ে সুখী মানুষ। তোমার চোখে আমি সরলতা দেখেছি। তোমাকে চিনতে আমার সময় লাগেনি। অবাক হয়ে বলল সারিকা। না। বিষয়টি আসলে তা নয়। তাহলে কী প্রাণের স্বামী? আগে আমার গল্পের বাকিটুকু শেষ করি...। কর। কর। জীবন গল্পের শেষ নেই। বহতা নদীর মতো। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, একজন প্রেমিক পুরুষ প্রথম দেখাতে ক'জন পছন্দ করে? ক'জনকেই-বা চিরসঙ্গী করে? মানুষের জীবন তো একটাই। ভালোবাসার মানুষও একজন হওয়া উচিত। সুশ্রী বা কুশ্রী বলে নয়, আমার দেখা প্রথম যুবতীই হবে আমার জীবনসঙ্গী। যাকে আমি আদর দেব। চাঁদের জোছনায় শরৎ কাশের ছোঁয়া দেব। সত্যিই একদিন তাকে কাগজপত্রে নিজের করে নিই। জানতে চাইনি তার পারিবারিক অবস্থা। নিজের সিদ্ধান্তে তাকে বিয়ে করি। আর বিয়ের রাতেই জানতে পারি...। কী জানতে পার? সারিকা বলল। জানতে পারি আসলে সে নারী নয়। পুরুষখেকো দানবী। বহু পুরুষের জীবন নিয়ে সে খেলেছে। তার এক বোন চিরকুমারী। আরেক বোন বিয়ের পর স্বামীকর্তৃক ডিভোসি। আমি দানবীকে বললাম, একি শোনালে তুমি? এ কেমন মিথ্যায় জড়ালে আমাকে? সে কোনো উত্তর দিতে পারেনি। শুধু মিথ্যে কেঁদেছে। তার দোষ কী ছিল? তা তোমাকে বলতে চাই না আমি। বলতে তোমাকে হবেই। শোনো সারিকা, তার কাছে জানতে চেয়েছি- একজন পুরুষ যখন নারীর কাছ থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়ায় তখন সে পুরুষকে সমাজের অন্যরা কোন চোখে দেখে? উত্তর দিতে পারেনি। শুধু বলেছে, আমার দুবোনের অবস্থা সমাজে এতই খারাপ যে আমরা কাউকে মুখ দেখাতে পারছিলাম না। তার ওপর আমার কলঙ্কের দাগ পুরো পরিবারকে এতটাই দগদগে করেছে যে, আমার মরা ছাড়া আর উপায় ছিল না। আমার চার ভাই বেকার। বাবার আয়-রোজগার নেই। আসলাম ভাই সবই জানে। তাকে শুধু আমার আগের বিয়ের তথ্য গোপন রাখতে বলেছি। আসলাম ভাই আমার সঙ্গে প্রতারণা করতে পরল? আনতারা বলল, আসলে আসলাম ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। তাকে একদিন আমার বাসায় এনে সব খুলে বলি। তখন সে আমাকে আশ্বাস দিয়েছে একজন ভালো সঙ্গী খুঁজে দেওয়ার। তাহলে আমি তোমার দ্বিতীয় শিকার? এভাবে বলছ কেন সামি? আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনি। এছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। এখন তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তাহলে আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। আনতারা কেমন গো? এমন কেউ করে? সারিকা বলল। তুমি খুব হাঁসফাঁস করছ মনে হচ্ছে। এ তো স্বপ্নে দেখা গল্পের চরিত্র। বাস্তব অনেক দূর। না। না। বাস্তবেও এমন হচ্ছে অহরহ। হয়তো হচ্ছে। তোমার গল্প বলা শেষ? শেষ। তবে উপসংহার বাকি। তার কথা শেষে আমি মনের আনন্দে গান ধরেছি- 'মনপাখি তোর খাঁচায় ছিল আলো মিথ্যে ভালোবাসার চেয়ে তিমির-আঁধার ভালো।' তারপর সেকি কান্না। সেই বিয়ের রাতেই আমি অজানার উদ্দেশে বের হয়ে যাই। তাকাইনি পেছনে ফিরে। সামি, গল্পে দারুণ ট্র্যাজেডি। তোমার চোখ ছলছল করছে। গল্পের সারমর্ম নিছক একটি ঘটনা। স্বপ্নের আঁকিবুঁকি। মিথ্যে ভালোবাসায় যন্ত্রণা অনেক। তবে, আমি তোমার লীলাবতী। আমাকে জড়িয়ে রেখ তোমার বুকের মধ্যিখানে। সারিকা বলল। হঁ্যা, তা তো রাখবই। আদরে আদরে ভরিয়ে দেব তোমার হৃদয়। পাখি হয়ে উড়ব স্বপ্নীল আকাশে।