সাধারণত কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন থাকে প্রায় সব ছেলেমেয়ের।
শিমুলও চেয়েছিল দেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে। ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তার ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি। ব্যর্থতার দুঃখ-গস্নানি বুকে চেপে শেষ পর্যন্ত ঢাকার একটি কলেজে অনার্স পড়া শুরু করেছিল মফস্বল শহরের মেধাবী মেয়েটি। লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস কমপিস্নট করার স্বপ্ন ছিল তার। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবনে ঢোকার পর নিজের জীবনটা চমৎকারভাবে সাজানোর পরিকল্পনা ছিল। বিসিএস না হলেও অন্তত কোনো ব্যাংকে ঢোকার একটা ইচ্ছে মনে মনে লালন করছিল। করপোরেট জবের আকর্ষণীয় জগৎটাও তাকে খুব টানত। জীবনের লক্ষ্য পূরণে প্রথম থেকেই সিরিয়াস ছিল সে। যে করেই হোক নিজেকে যোগ্য করে তুলে জীবনে ভালো একটি অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করাটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল শিমুল। ভার্সিটিতে পড়তে না পারলেও একটি মেয়ে তার মেধা ও যোগ্যতায় এগিয়ে থাকতে পারে। চমৎকার একটি জায়গায় নিয়ে যেতে পারে নিজেকে। তার নিজের ওপর আস্থা তৈরি হচ্ছিল ধীরে ধীরে। কিন্তু মানুষ যা ভাবে, বাস্তবে তা শেষ পর্যন্ত ঘটে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
ঢাকায় পড়াশোনা করতে এসে বাইরে প্রাইভেট হোস্টেল থাকাটা অনেক ব্যয়বহুল। মামার বাসা ছেড়ে তেমনি একটি প্রাইভেট হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে শুরু করে শিমুল। মা বাড়ি থেকে টাকা যা পাঠায়, তা দিয়ে সব খরচ চালানো অনেক কষ্টকর হয়ে ওঠে তার জন্য। বাড়ি থেকে অনেকটা জোর করে সবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঢাকায় পড়তে এসেছে সে। এখন যে খরচের মাত্রা বাড়ছে তা বাড়ি থেকে সামাল দেয়া অসম্ভব। প্রাইভেট হোস্টেলের সুযোগ-সুবিধা অনেক ভালো। তবে সেখানে টাকা খরচের পরিমাণটা অনেক বেশি। এর চেয়ে কলেজের হোস্টেলে উঠতে পারলে অনেক সাশ্রয় হয়। কিন্তু কলেজ হোস্টেলে সিট পাওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার। সোনার হরিণ পাওয়ার মতো অবস্থা। এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সিট পেতে হলে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী হতে হয়। ছাত্র সংগঠনের নেতানেত্রীদের খুব কাছের মানুষ হতে হয়। তার ছাত্রজীবনের অভিজ্ঞতায় শিমুল এটা বুঝে নিয়েছে ইতোমধ্যেই। কিন্তু সে তো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়! পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতে চেয়েছে তাদের। কিন্তু কলেজ হোস্টেলে সিট পেতে হলে তাকে অবশ্যই প্রভাবশালী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হতে হবে। এটা অনেকেই তাকে পরামর্শ দিয়েছে। এ অবস্থায় ভীষণ অসহায় বোধ করে শিমুল।
তেমন পরিস্থিতিতে তার পাশে সাহায্য-সহযোগিতার ত্রাণকর্তা হিসেবে দাঁড়ায় কলেজের রাজনৈতিক সংগঠনের প্রভাবশালী নেত্রী এক বড় বোন নুসরাত। সে-ই শিমুলকে কলেজ হোস্টেলে সিট পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেই থেকে নেত্রী বড় বোনটি তাকে সংগঠনের নানা কাজে সঙ্গে নিয়ে গেছে। যেতে মন সায় না দিলেও কলেজ এবং বাইরের বিভিন্ন মিটিং-মিছিলে অংশ নিতে হয়েছে। একপর্যায়ে ছাত্র সংগঠনের গন্ডি ছাড়িয়ে আরও উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের অফিসে, বাসায় সঙ্গে যেতে চাপ দিয়েছে নুসরাত।
আপু, ওখানে আমার কাজ কী, আমি তো ছোটমানুষ। বড় বড় নেতা-মন্ত্রীদের অফিসে, বাসায় গিয়ে আমি কী করব? আমি তো রাজনীতির এত মারপঁ্যাচ বুঝি না, জানি না। ওখানে তো আমি বেমানান।
আরে, তোমাকে রাজনীতি বুঝতে কে বলেছে? এখন রাজনীতি দিয়ে অনেক কিছুই হয় না। রাজনীতি বোঝা লাগে না, এর বাইরে আরও অনেক জিনিস লাগে। তোমাকে আমি অনেক পছন্দ করি। তাই তো বড় বড় নেতা-মন্ত্রীদের কাছে তোমাকে নিয়ে যেতে চাই। ওখানে সহজে কেউ যেতে পারে না। আমার সঙ্গে রয়েছ বলে তুমি যেতে পারছ। এভাবে যেতে যেতে দেখবে, একদিন তোমার কপাল খুলে গেছে।
বড় বোনটি শিমুলকে উৎসাহী করতে মোলায়েম কণ্ঠে কথাগুলো বলে। দেখবে, একদিন তুমিও আমার মতো বড়ো নেত্রী হয়ে গেছ। নুসরাতের কথামতো রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ আমলা, সচিবদের অফিস ও বাসায় যেতে যেতে শিমুল ক্রমেই আরও স্মার্ট, বেপরোয়া, সাহসী হয়ে ওঠে ভেতরে ভেতরে। ততদিনে সে বুঝে নিয়েছে, এই শহরে কিছু পেতে হলে বিনিময়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। বিশেষ করে সুন্দরী মেয়েদের।
ছাত্রী সংগঠনের নেত্রী কলেজের বড় বোন নুসরাত ডাকসাইটে নেতা, মন্ত্রীদের কবজা করার জন্য শিমুলকে কাজে লাগায়। বিনিময়ে সে অনেক কিছু পায়। গাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই বাগিয়ে নেয়। কানাডায় অনেক টাকা পাচার করে। সেখানে বাড়ি কেনে, সেকেন্ড হোম গড়ে তোলে। শিমুলের মতো ছাত্রী সংগঠনের আরও কয়েকটি সুন্দরী মেয়েকে কাজে লাগিয়ে অল্প সময়েই এগিয়ে যায় নুসরাত। অথচ শিমুলরা কেবলই ব্যবহৃত হয় তার প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনের মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু তাদের কপাল খোলে না। সবাই তাদের চেনে ভিন্ন এক পরিচয়ে, যা মোটেও সম্মানজনক নয়। হঠাৎ এক সময় বড় ধরনের অপকর্মের দায়ে সেই নেত্রী নুসরাতের ওপর আইনের খড়গ নেমে আসে। কলেজে নিরীহ ছাত্রীদের ওপর অন্যায়ভাবে দমন-নির্যাতনের অভিযোগে তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। রাজনৈতিক দলের অফিস কিংবা সচিবালয়ে তার যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হয়। পত্রপত্রিকায় তার সব অপকর্মের কাহিনী নিয়ে সিরিজ রিপোর্ট ছাপা হয়। একপর্যায়ে সে সব সামাল দিতে ব্যর্থ হয়। এরপর নিজেকে রক্ষা করতে কানাডায় পালিয়ে যায় নুসরাত। যার আশ্রয়ে এতদিন নিজেকে একটি জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছিল, সেই নুসরাতের আশ্রয় হারিয়ে শিমুল আবার একাকি, অসহায় হয়ে পড়ে। সেই ছাত্রী সংগঠনের নেত্রী নুসরাতের সহযোগী হিসেবে শিমুলও সবার অনেক নিন্দা, লাঞ্ছনা, গঞ্জনার শিকার হয়। তেমন অবস্থায় নিজেকে রক্ষা করতে এবং নতুন একটি আশ্রয়ের খোঁজে সচেষ্ট হয়।
অন্যায় অত্যাচার নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে দেশের সব মানুষ। শিমুল সেই রাজনৈতিক দলটির ছাত্র সংগঠনের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করে সবার নিন্দা এবং ঘৃণার পাত্রী হয়ে উঠেছে আগেই। চেপে বসা দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনে অতিষ্ঠ সাধারণ ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে রাজপথে নেমে আসে। তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দমনে সরকার নির্মমতা, পাশবিকতা, অমানবিকতা, বর্বরতা, নৃশংসতার আশ্রয় গ্রহণ করে। দেশজুড়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করে দিতে চাইলেও সবাই আরও বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি নিজেদের ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দেওয়া হয়। তারা নির্মমতার ভয়ংকর প্রকাশ ঘটায় দেশজুড়ে। কিন্তু শত শত তরতাজা টগবগে তরুণ যুবক, কিশোরদের রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। তারা আরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। রাজপথ কাঁপায়। দেশের ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অকুতোভয় বীর সৈনিকের মতো রাজপথে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মৃতু্যর পরোয়া না করে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে। এক সময় প্রবল আন্দোলনের মুখে টিকতে না পেরে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় স্বৈরাচারী শাসক। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত হয় অসাধারণ এক বিজয়। সেই স্বৈরাচারী সরকারের দোসর ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনেকেই আটক হয়।
শিমুল এ অবস্থায় নিজেকে ভীষণ অপরাধী ভাবতে শুরু করে। এখন তার বাড়ি ফিরে যাওয়ারও উপায় নেই। সবাই এক নামে তাকে চেনে। তার নানা কেচ্ছা-কাহিনী ছড়িয়েছে ইতোমধ্যেই। একজন নিন্দিত মেয়ে হিসেবে বাড়িতে ফিরে গেলেও সেখানে স্বস্তিতে থাকতে পারবে না সে। এখন তো দেশ ছেড়ে বিদেশেও পালিয়ে যেতে পারবেন না সে। এয়ারপোর্ট এবং অন্যান্য সীমান্তের চেকপোস্টগুলোতেও বোধ হয় তার নাম পাঠানো হয়েছে। সেখানেও বিপদ অপেক্ষা করছে তার জন্য। এখন সে কোথায় কার কাছে আশ্রয় চাইবে, ভেবে পায় না। দিশেহারা হয়ে পড়ে শিমুল। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না হঠাৎ করে। তেমনি সময় ফারিয়া ভাবির সঙ্গে শিমুলের দেখা হয়ে যায়। ভাবি তাকে পেয়ে আকাশের চাঁদ পেয়ে যায় যেন। এমন একটি মেয়ের খোঁজে ছিল সে। শিমুলের সঙ্গে ফারিয়ার যোগাযোগ হয়নি এর আগে। ফারিয়া শহরের সব সুন্দরী মডেল, সিনেমা-টিভির নায়িকা, নিউজ প্রেজেন্টারদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এ লাইনে তাকে অনেক ঝানু ও অভিজ্ঞ একজন নারী মনে করা হয়। এসব মেয়েদের প্রায়ই কাজে লাগায় ফারিয়া। তার কাছে সব সময় নতুন নতুন মেয়ের কালেকশন থাকে। যাদের ফারিয়া কাজে লাগায় সুযোগ মতো। এ ধরনের মেয়েদের বেশ চাহিদা রয়েছে তার ক্লায়েন্টদের কাছে। সঙ্গী-সাথী, বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে আলাপচারিতা, আড্ডায় অনেক কথাই আলোচনা হয় শহরের ধনাঢ্য পরিবারের পেস্ন-বয় স্বভাবের মানুষের নিয়ে। এভাবেই বিভিন্ন গেস্ট হাউজ, ক্লাব, বারগুলোতে ফারিয়া ভাবির হাত ধরেই যাওয়া-আসা শুরু করে শিমুল। তার মতো সুন্দরী, স্মার্ট, আকর্ষণীয় মেয়েদের নিয়ে চলিস্নশ পার করা এই সাবেক মডেল মোটামুটি বড় একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। মডেলিং জগতে ব্যস্ততার সময় থেকেই ফারিয়া তার কাজের পাশাপাশি এই ধান্ধায় জড়িয়ে পড়েছিল। তখন দারুণ ডিমান্ড ছিল তার। শহরের হোমড়া-চোমড়া বিজনেস এলিট, আমলা, রাজনীতিবিদদের অনেকেই তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেতে উন্মুখ হয়ে থাকত। যৌবনে ভাটা পড়তেই এ লাইনের সুন্দরী, আকর্ষণীয় মেয়েদের নিয়ে ভালো নেটওয়ার্ক গড়ে ব্যবসা বেশ জমিয়ে তুলেছে এর মধ্যে।
২.
যদিও পাঁচ-ছয় বছর আগে ছোট্ট মফস্বল শহর থেকে কিছু একটা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাজধানী ঢাকায় পা রেখেছিল শিমুল। তখন তার বয়সও ছিল কম। ঢাকায় কিংবা অন্য কোনো শহরে নামি কোনো ভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন লালন করা মেয়েটি ছোটবেলা থেকে খুব বেশি সাহসী কিংবা জেদি না হলেও স্বপ্নভঙ্গের কষ্ট তাকে হঠাৎ করে যেন বদলে দিয়েছিল। তার মধ্যে প্রচন্ড জেদ চেপে বসেছিল। যে করেই হোক ঢাকায় গিয়ে নিজের মেধা ও যোগ্যতা প্রমাণ করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার একটা পথ খুঁজে বের করবেই। বাড়ির সবাই শিমুলের এ ধরনের জেদি মনোভাবে খুশি হতে পারেনি তখন। তার চেয়ে বরং একাকী একটি মেয়ের রাজধানী ঢাকার জটিল ও অনিশ্চিত জীবনের আবর্তে জড়িয়ে অজানা গন্তব্যে যাত্রা শুরুটাকে সমর্থন জানায়নি। নানাভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিবৃত্ত করতে চেয়েছে। যেখানে মেয়েটির বয়স অল্প। দেখতেও সুন্দরী। বৈষয়িক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা কিছুই হয়নি।
ঢাকা শহরে পদে পদে নানা ধরনের বিপদ, শঙ্কা আর কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে অন্ধকার অতলে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। ঢাকার কোনো কলেজে ভর্তি হয়ে অনার্স না পড়ে নিজেদের মফস্বল শহরের সরকারি কলেজটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য নানাভাবে বুঝিয়েও কোনো কাজ হয়নি। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ কেউ তাকে বিয়ে দিয়ে স্বামীর সংসারে পাঠানোর পরামর্শও দিয়েছিল। শ্বশুরবাড়ি গেলে সংসার জীবনে ঢুকে পড়লে ঢাকা শহরে যাওয়ার ভূত মাথা থেকে কোথায় পালিয়ে যাবে! সব নেশা কিংবা জেদ নিমিষেই কেটে যাবে তখন। বিয়ের বয়স না হলেও বড়বোন বকুলের পাশাপাশি একসঙ্গে ছোটবোন শিমুলেরও বিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিল বাড়ির সবাই। ইচ্ছে কিংবা মন থেকে সায় না থাকলেও পরিস্থিতির চাপে পরিবার তেমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই পুরো ব্যাপারটা সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি শিমুল। জোর গলায় প্রতিবাদ জানিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি বিয়ে-শাদির বন্ধনে নিজেকে জড়ানো কিংবা নিজের লালিত নানা স্বপ্ন পূরণের পথ থেকে সরে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি জীবনে ঢুকে পড়ার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো। ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দিলে আত্মহত্যার হুমকি দিতেই সবাই ভয় পেয়ে চুপসে গিয়েছিল সেদিন।
সেই থেকে কেউ আর তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। অনার্স পড়তে ঢাকা শহরে একটি কলেজে ভর্তি হয়েছিল শিমুল। শুরুতে রামপুরায় ছোট মামার বাসায় উঠলেও খুব বেশি দিন সেখানে থাকা সম্ভব হয়নি। কলেজে যাওয়া-আসায় সমস্যা হওয়ায় মামার বাসা ছেড়ে একটা ছাত্রী হোস্টেলে উঠতে বাধ্য হয়েছিল শিমুল। মফস্বল শহর থেকে সরাসরি ঢাকার মতো কসমোপলিটন শহরে পা রাখলে শুরুতে যে কোনো ছেলে কিংবা মেয়েই কিছুটা লজ্জা, সংকোচ, বিব্রত অবস্থার মধ্যে থাকে। কোথাও যেতে কিংবা কারও সঙ্গে কথা বলতে এক ধরনের জড়তা ভাব জড়িয়ে থাকে তাদের। কিন্তু অল্প কিছুদিন না যেতেই তাদের কেউ কেউ এতটা বদলে যায়, তখন আর চেনা যায় না। চারপাশে বিত্ত-বৈভব, রঙিন বিলাসী জীবন দেখতে দেখতে নেশা ধরে যায় চোখে। সেই বিলাসী রঙিন জীবনের স্বাদ পেতে তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগে মনে। হয়তো কারও কারও সামনে সেই জীবনে পা রাখার নানা আহ্বান, আমন্ত্রণ দিশেহারা, বিভ্রান্ত করে দিতে চায়। তখন কেউ কেউ বিভ্রান্ত হয়ে ভুল পথে পা রাখে, অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যায়।
শিমুল এখন আর পিছু ফিরে তাকাতে চায় না। নিজের অতীতটা ভুলে শিমুল জাহরিন হিসেবে নিজের পরিচয়টাকে সবার কাছে তুলে ধরতে চায়। তার মোবাইল ফোনে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার ডজনখানেক ধনাঢ্য শিল্পপতি, ব্যবসায়ী এবং অনেক কোটিপতির নম্বর সেভ করা আছে। তাদের প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গে শিমুলের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এই ধনাঢ্য মানুষকে বাইরে থেকে দেখে কেউ আসল রূপটা জানতে পারে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, আবার কেউ সমাজসেবক, শিল্পপতি। কেউ কেউ আবার উচ্চপদস্থ আমলা, সরকারি কর্তাব্যক্তি। যাদের অঙুলি হেলনে সমাজে কত কী ঘটে যায়! বাইরে থেকে দেখে তাদের ভদ্র, রুচিশীল, জনদরদি, সজ্জন মানুষ মনে হলেও ভেতরটা তাদের অনেক কুৎসিত। বিভিন্ন সময়ের ঘনিষ্ঠতায় ও মেলামেশায় তাদের বিকৃত রুচি এবং অদ্ভুত সব লালসার খবর জানা হয়ে গেছে তার। সমাজের উচ্চবিত্ত এলিট শ্রেণির এসব মানুষ অনেকের কাছে গিয়ে তাদের ভেতরের অনেক অজানা বিষয় আবিষ্কার করা হয়ে গেছে তার। তাদের বিছানায় সঙ্গী হয়ে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে। বিনিময়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে অবিশ্বাস্য মোটা অঙ্কের টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি, দামি ডায়মন্ডের অলংকার সামগ্রী, মূল্যবান গিফট, জামাকাপড়। এখন সে বেশ কয়েকটি দামি আইফোন ব্যবহার করে। এগুলো বিদেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন গিফট হিসেবে এনে দিয়েছে তাকে।
এখন শুধু শিমুলই নয়, এ লাইনে তার পাশাপাশি আরও অনেক মেয়ের তৎপরতা বেড়েছে। দামি খদ্দেরদের পটাতে এবং নিজের আয়ত্তে রাখতে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে তাদের মধ্যে। শিমুল ঢাকা শহরে পা রাখার পর যখন কলেজে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করেছিল, তখন তার জীবনটা ছিল খুবই সাদামাটা। শহুরে জটিলতা, নানা পঁ্যাচঘোচ কিছুই মাথায় ঢুকত না। সহজ-সরলভাবে সবকিছু দেখার চেষ্টা করত। কিন্তু এভাবে তো জীবন চলে না এখন। জীবনের বাঁকে বাঁকে নানা প্রলোভন, প্রতারণা, মিথ্যে ছলনা একটি নিষ্পাপ সহজ-সরল-সাধারণ মেয়ের জীবনের গতিপথ কীভাবে পাল্টে দেয়- নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে শিমুল। এই সমাজে আশপাশে এমন কিছু মানুষ রয়েছে, যাদের চিন্তাচেতনায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে, শিরায় শিরায় রক্তের প্রবাহে নষ্টামি। তারা নানাভাবে অন্যদের প্ররোচিত করে, প্রতারণার ফাঁদে ফেলে বিপথে যেতে বাধ্য করে। নিজের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে- দেখে বুঝলেও তখন কিছুই আর করার থাকে না। অসহায়ের মতো নিজেকে সমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে না। পেছন ফিরে তাকাতে একদম ইচ্ছে না করলেও মাঝেমধ্যে কী যেন হয়ে যায়। আজকের দিনগুলোর সঙ্গে অতীতের সময়কে মেলাতে পারে না সে কোনোভাবেই। শিমুলের নিজেকে মাঝে মধ্যে খুবই অচেনা মনে হয়। কিছু নারী-পুরুষ একদিন তাকে বিপথগামী করেছিল। তার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে চরম সর্বনাশ করেছিল। তার জীবনের গতিপথটাই বদলে দিয়েছিল।