'সোনায় বাঁধা গ্রন্থ দিলে প্রতিশ্রম্নতি ঠাসা
আমি দেব বর্ণমালা আমার মাতৃভাষা
কেউ যদি দেয় বিশ্বজোড়া বাড়ি
আমিতো দেব মাত্র দশহাত লজ্জা ঢাকা শাড়ি'
অভয় কবিতার শেষের এই লাইনগুলো প্রতিটি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেয়। তখন পাঠককে আরও বেশি মুগ্ধ করার দায়িত্ব বেড়ে যায় একজন কবির। মাত্র দুটি লাইন একজন কবিকে হাজার হাজার কবিতার ভিড়ে অমর করে রাখতে পারে।
কবি এবং কবিতা সর্বজনীন। কোনো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বন্দি নয়। তবু আমরা কবিদের সময়ের সীমায় বেঁধে ফেলি।
৮০ দশকের কবিদের মধ্যে কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন অন্যতম প্রধান।
\হতারুণ্যের কবি হিসেবে তিনি তার পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক সমাদৃত। পাঠক যখন গল্প উপন্যাসে নিজের পছন্দকে প্রায়োরিটি দেয় রেজাউদ্দিন স্টালিন তখন কবিতা নিয়ে মগ্ন। তার নিজের মতো করে তিনি অক্ষরের গল্প তৈরি করেন। পাঠকের জন্য একটা জাদুর জগৎ বানাতে তৎপর তিনি। লেখেন তার নিজের আবেগ অনুভূতিকে নিজের মতো সাজাতে। তখন তিনি চিত্রকল্প উপমাসহ বিভিন্ন অনুসঙ্গের আশ্রয় নেন। কবিতার মধ্যই একটি সমাজরাষ্ট্র রাষ্ট্রের সারাৎসার। অভাব অনটন জীবনের অপার্থিব চাওয়া-পাওয়া চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। এখানেই কবির স্বার্থকতা। কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের রয়েছে একশ'র ওপরে গ্রন্থ; তার মধ্য গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতাসহ রয়েছে শিশুতোষ ছড়াও। তার লেখার মূল বিষয় হলো পুরাণের প্রাসঙ্গিক নবায়ন। তার অধিকাংশ লেখাতেই রয়েছে এক বিস্ময়কর জাদুবাস্তবতার ইন্দ্রজাল। এই জায়গায় কবিকে অন্য কবিদের থেকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে কবির লেখা পৌঁছে গেছে বিশ্ব দরবারে। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার কবিতা অনূদিত হয়েছে, হচ্ছে এবং আবৃত্তি করছেন বড় বাচিক শিল্পীরাও।
মিথ ও পুরাণের বহুমাত্রিক প্রাসঙ্গিক ব্যবহার তার লেখাকে আধুনিক ও ধ্রম্নপদীরূপে গুণান্বিত করেছে।
ঠিকানা-কবিতায় কবি কী চমৎকারভাবে নিজের ঠিকানা দিলেন 'যেখানে আমি দৃশ্যবান সেটাই আমার ঠিকানা'। মানুষ যেখানে যেমন সেটাই তখন তার ঠিকানা। আবার কবিতার শেষ অংশে লিখেছেন 'স্থায়ী ঠিকানা কিছু নেই, নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে হেরাক্লিটাস এই উপলব্ধি দিল।
কখনো মনে হয়, অনেক দূর থেকে কেউ ডাকছে কণ্ঠস্বর খুব চেনা ওটাই হয়তো আশ্চর্য ঠিকানা।'
মানুষের নিজস্ব ঠিকানা সত্যিই রহস্যময়।
২০২২ সালে বের হয় তার প্রেমের চিঠির গ্রন্থ সেখানেও তিনি রোমান্টিসিজমের সঙ্গে চমৎকারভাবে বৈশ্বিক বেদনার কথা বলেছেন। এখানেই তিনি সফল। সমকালীন কবিদের থেকে ভিন্নধারার লেখায় নিজেকে উপস্থাপন করেছন। ছড়া লিখে প্রথমে লেখক জীবনে আত্মপ্রকাশ করেন। লেখাটি ছিল এমন 'পুষ্প যেমন মানব সেবায় জীবন করে দান, আমরা তেমন দেশের সেবায় বিলিয়ে দেব প্রাণ।'
তখন তিনি ক্লাস ফাইভের ছাত্র। তার মা ছিলেন সেই পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। আর পত্রিকার নাম ছিল শতদল। এতেই আমরা বুঝতে পারি তার লেখার প্রথম উৎসাহদানকারী তারই জন্মদাত্রী মা। যে কোনো কাজের উৎসাহ আমরা আসলে প্রথমে পরিবার থেকেই পাই। কবির বেলায়ও তার ব্যতিক্রম নয়। আর এখনতো তিনি লেখা দিয়ে অগণিত পাঠকের হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা করে নিয়েছেন। যশোর জেলার সন্তান কবি স্টালিন শৈশব কৈশোর কাটিয়েছেন সেখানে। যার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভৈরব ও কপোতাক্ষ নদ। এই নদের চারপাশের দৃশ্য কবিকে আরও পরিপূর্ণতায় ভরিয়ে তুলতে শিখিয়েছে। জীবনকে নদীর শান্ত সৌম্য বিক্ষুব্ধ রূপ এমন ভাবে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে- তাই হয়তো তিনি লিখেছেন, 'মৃতু্যকে ভয় পায় যে জীবন,তাকে বাঁচতে বলে কে?'
তার লেখক জীবনের প্রাপ্তিও অনেক। একদিকে পাঠকের ভালোবাসা; অন্যদিকে, বিভিন্ন সংগঠন থেকে পাওয়া পুরস্কার। ২০০৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমির পুরস্কার পান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাষ্টার্স করে নজরুল একাডেমিতে চাকরি করেন তিনি। দীর্ঘদিন পরিচালক হিসেবে কর্মরত থেকে অবসর নেন। লেখালেখির সঙ্গে তিনি একজন সফল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন টেলিভিশনের তিনি সফল উপস্থাপক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ফিরিনি অবাধ্য আমি' তিনি অবাধ্য হলেও বাধ্যগত ছাত্রের মতো কথা রেখেছেন। তার কলম চলছে বিরামহীন। হাজার বছর তার কলম চলুক। তার পাঠকের অন্তরে তিনি নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলবেন। জন্মদিনে কবির প্রতি আমার শ্রদ্ধা ভালোবাসা এবং শুভ কামনা। সশরীরে হাজার বছর বেঁচে থাকুন কবি। বেঁচে থাকুন পাঠকের অন্তরে। শুভ হোক প্রতিক্ষণতার পথ চলা।