শক্তি চট্টোপাধ্যায় পঞ্চাশ দশকের শক্তিমান কবি। তার অসাধারণ রচনার কারণে তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তার কবিতা বাংলা ভাষার সাহিত্যমোদিদের মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। তিনি কবি হিসেবে খ্যাতিমান হলেও তিনি একাধারে কবি ও কথাসাহিত্যিক। গদ্য সাহিত্যেও তার অবস্থান সুদৃঢ়। লেখালেখির জগতে তার প্রবেশের সূত্রপাত গদ্য দিয়ে। সাহিত্য জগতে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন 'কুয়োতলা' নামে উপন্যাস দিয়ে। তারপর তিনি কবিতার মোহনীয় সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে কবিতা চর্চায় ব্রতী হয়েছেন এবং তার কাব্য ভুবনকে প্রসারিত করেছেন। আলো ফেলেছেন। তার কবিতা জগৎ সৌন্দর্যস্নাত। কবিতাকে ভালোবেসে তিনি নাম দিয়েছেন 'পদ্য'। তিনি পদ্য নামে ডাক দিলেই হাজির হতো কবিতা। তার পদ্যসম্ভার পাঠকদের আলোড়িত করে। জীবনানন্দ দাশ-পরবর্তী সময়ের অন্যতম মৌলিক কবি তিনি। তার হৃদয়স্পর্শী দীপ্র কবিতা তাকে উদ্ভাসিত করেছে।
শক্তির কবিতার বক্তব্য স্বতন্ত্রধর্মী। সমুদ্র, আকাশ, নদী, বৃক্ষ, নক্ষত্র, বৃষ্টি, জঙ্গল, মহুয়া, ফুল, বীজ, টিলা, জ্যোৎস্না, ঝিঁঝি, রাত্রি, অন্ধকার, পাহাড়, পাথর, জীবন-মৃতু্য, জীবনের স্বপ্ন আশা, ভালোবাসা ক্লেশ তার কবিতার বিষয় হয়েছে। তার কবিতায় দৃশ্যমান সবকিছুর পাশাপাশি জীবনের সুখ-দুঃখের অনুভূতি উঠে এসেছে। তার কবিতায় নিজস্ব জীবনের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। তার আলাদা পদ্যরীতি বক্তব্য প্রকাশের শক্তিময় ভাষা তার কবিতাকে সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। শক্তি চট্টোপাধায়ের সুষমামন্ডিত কবিতা দীপ্য অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। কালের প্রবাহে তার কবিতা আড়ালে চলে যায়নি। বরং আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এ কথা খুব শক্তভাবে বলা যায়। তার কবিতা নতুন লেখক ও পাঠকদের আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে। তার মৃতু্যর এতদিন পরও কবি পরিচয় ম্স্নান হয়নি একটুও। তার অবস্থান ক্ষুণ্ন হয়নি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামের আড়ালে তিনি স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার ও রূপচাঁদপক্ষী ছদ্ম নামে অসংখ্য রচনা সৃষ্টি করেছেন।
১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাব'। এই কাব্যগ্রন্থটি ইংরেজি এবং মৈথিলী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে এ কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচালিত ছেঁড়া তমসুখ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
মার্চ ১৯৫৬ সালে, শক্তির কবিতা 'যম' কবিতা সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি কৃত্তিবাস এবং অন্য পত্রিকার জন্য লিখতে শুরু করেন। বুদ্ধদেব বসু তাকে নবপ্রতিষ্ঠিত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য কোর্সে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। শক্তি কোর্সে যোগদান করলেও সম্পূর্ণ করেননি। শক্তির কবিতা মৃতু্য ভাবনা ছাপিয়ে জীবনের জয়গানে মুখর হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মানুষ মৃতু্যকে বরণ করে নেয়। এই সত্য ধরা পড়েছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় পাশাপাশি জীবন বোধের অমল আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে তার কবিতা। তার কাব্য চেতনায় উঠে এসেছে মৃতু্য ভাবনা, জীবন প্রেম সমাজ মানুষের প্রতি মায়া-মমতার প্রসঙ্গ। তার কবিতা অবশ্যই জীবন সংলগ্ন। মৃতু্যচিন্তা অতিক্রম করে তিনি জীবন প্রেমের কাছেই নিজেকে সমর্পিত করেছেন, যা আমরা তার 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাব' শীর্ষক কবিতার মধ্যে দেখতে পাই। তার এই কবিতায় হৃদয় থেকে উৎসারিত হওয়া জীবন বোধই প্রস্ফুটিত হয়েছে। মৃতু্য-ভাবনা তাকে স্পর্শ করলেও জীবনের সুখ-দুঃখকেই তিনি আলিঙ্গন করেছেন। জীবনবোধই বিজয়ী হয়েছে। তিনি উচ্চারণ করেছেন :
ভাবছি, ঘুরে দাঁড়ানোই ভালো
এত কালো মেখেছি দু'হাতে
এতকাল ধরে।
কখনো তোমার করে, তোমাকে ভাবিনি।
এখন খাদের পাশে রাত্তিরে দাঁড়ালে
চাঁদ ডাকে আয়, আয়, আয়।
এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে
চিতাকাঠ ডাকে আয়, আয়, আয়।
যেতে পারি,
যে কোনো দিকেই আমি চলে যেতে পারি
কিন্তু, কেন যাব?
সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাব
যাব
কিন্তু, এখনই যাব না
তোমাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাব
একাকী যাব না অসময়ে।
শক্তির এই কবিতায় মৃতু্য ভাবনা প্রবলভাবে উঠে এসেছে। মৃতু্যবোধ তাকে আক্রান্ত করলেও তিনি মৃতু্যবোধকে অগ্রাহ্য করে বলেছেন, যেতে পারি কিন্তু কেন যাব। মৃতু্য ভাবনার গন্ডি থেকে বেরিয়ে গেছেন তিনি।
শক্তির কবিতায় অভিমান প্রকট হয়ে উঠেছে। যাপিত জীবনের যন্ত্রণাকারতা কখনো কখনো তাকে হতাশাগ্রস্ত করে দিয়েছে। তার হৃদয় রক্তাক্ত হয়েছে। জীবনকে তুচ্ছ অর্থহীন মনে হয়েছে। তার মনে হয়েছে মৃতু্য তাকে ডাকছে। তিনি মৃতু্যর কাছে নিজেকে নিক্ষেপ করতে গিয়ে থেমে গেছেন। সটান ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। মৃতু্যভাবনাকে তিনি স্তিমিত করেছেন। সামাল দিতে সক্ষম হয়েছেন। কলেস্নালিত জীবনের কাছে তার নিস্পৃহতা অভিমান হতাশা পরাজিত হয়েছে। তিনি ফিরে গেছেন জীবনের কাছে। জীবনকে আবিষ্কার করেছেন নতুনভাবে। তার কবিতায় জীবনবোধ আবর্তিত হয়েছে।
অভিমান, হাহাকার অন্তর্গত যন্ত্রণা ছাপিয়ে জীবনের সঙ্গে অন্তরঙ্গময় হয়ে উঠেছেন। জীবনের স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে তিনি স্বপ্নভঙ্গের বেদনাকে ভুলে যেতে চেয়েছেন। বেঁচে থাকাকে উপভোগ করতে চেয়েছেন। অতীতের সুখ স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখতে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভাবনাকে উপেক্ষা করেছেন।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন দার্শনিক চেতনা আক্রান্ত কবি। তার কবিতা সহজেই অন্যদের থেকে আলাদা করা যায়। তিনি ভিন্নধারার নিজস্ব এক কাব্যভাষা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি জীবনানন্দ উত্তর যুগের বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান আধুনিক কবি হিসেবে বিবেচিত। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত এবং আলোচিত ছিলেন। ষাটের দশকে যে চারজন কবিকে হাংরি আন্দোলনের জনক মনে করা হয় তাদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় অন্যতম।
বাংলা কবিতাঙ্গনে সত্যিকার অর্থে শক্তি চট্টোপাধ্যায় শক্তিমান কবি হিসেবে উজ্জ্বল অবস্থান তৈরি করেছেন। বিষয় বৈচিত্র্য, বহুমাত্রিকতা তার কবিতাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে।
শক্তি তার কবিতায় অন্তর্গত বেদনাকেও শিল্পসম্মতভাবে প্রকাশ করেছেন। ক্ষোভ ও মনোবেদনা শিল্পায়িত হয়ে ফুটে উঠেছে তার কবিতায়। কবি ও কাঙাল শীর্ষক কবিতার উদ্ধৃতি দেও যেতে পারে :
কিছুকাল সুখ ভাগ করে, হোলো মানুষের মতো
মৃতু্য ওর, কবি ছিল, লোকটা কাঙাল ও ছিল খুব।
মারা গেলে মহোৎসব করেছিল প্রকাশকগণ
কেননা, লোকটা গেছে, বাঁচা গেছে, বিরক্ত করবে না
সন্ধ্যেবেলা সেজেগুজে এসে বলবে না, টাকা দাও,
নতুবা ভাঙচুর হবে, ধ্বংস হবে মহাফেজখানা,
চটজলদি টাকা দাও-নয়তো আগুন দেব ঘরে।
অথচ আগুনেই পুড়ে গেল লোকটা, কবি ও কাঙাল!
শক্তি তার কবিতার মাধ্যমে লেখক ও প্রকাশক উভয়কেই সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন। লেখকদের ন্যায্য পাওনা না পাওয়ার চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি অনেক সময় লেখকরা তার মেধা ও শ্রমের মূল্য পান না। সম্মানীর জন্য ধর্ণা দিতে হয় প্রকাশকদের দুয়ারে। প্রকাশকরা নিজেদের বাণিজ্যকে বড় করে দ্যাখেন। লেখকরা বঞ্চিত হয় ন্যায্য পাওনা থেকে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় সামাজিক বাস্তবতাকে ভিত্তি করে কবিতা রচনায় নিমগ্ন থেকেছেন। শক্তির কণ্ঠস্বর স্বতন্ত্র।
বিষয়বৈচিত্র্য, উপমা, উৎপ্রেক্ষা রূপকল্প তার কবিতাকে ভিন্ন ধরনের সুধাময় করে তুলেছে।
তার কবিতায় অস্তিত্ব চেতনা, লাবণ্য, মায়া-মমতা জীবন আকর্ষণ আনন্দ-বেদনার প্রতিধ্বনি অনুরণিত হয়েছে। মৃতু্য ভাবনা তাকে যেমন গ্রাস করেছে পাশাপাশি তিনি তার কবিতাকে জীবনের জয়গানে গুঞ্জরিত করে তুলেছেন। কঠিন বাস্তবতা ধরা পড়েছে। কণ্টকিত পথে যাত্রার নাম জীবন। তবু একান্ত নিভৃতে তার কবিচিত্তে মায়া জেগে উঠেছে। তিনি বলেছেন :
সকল প্রতাপ হল প্রায় অবসিতৃ
জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
কিছু মায়া রয়ে গেল দিনান্তের,
শুধু এই
কোনোভাবে বেঁচে থেকে প্রণাম জানানো
পৃথিবীকে।
মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,
শাধু এই ু ঘৃণা নেই, নেই তঞ্চকতা,
জীবনযাপনে আজ যত ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় নানাভাবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। তিনি স্বীয় সৃজন প্রতিভায় দার্শনিক ভাববাদকে প্রকাশ করেছেন নিপুণভাবে। তার কবিতায় নিজস্ব অনুভূতি, যাপিত জীবনের কথা প্রযুক্ত করেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় বর্ষামুখর রাতে নিজেকে অবনী চরিত্ররূপে প্রকাশ করে বলেছেন : অবনী বাড়ি আছ?
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
'অবনী বাড়ি আছ?'
বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরান্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে/'অবনী বাড়ি আছ?'
আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
'অবনী বাড়ি আছ?
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মনে নানা ভাবনা বিভিন্ন সময় হানা দিয়েছে। তিনি যখন ঘোর নির্জন ঘরে একলা থেকেছেন তার সামনে মেঘদূতমালা অসংখ্য গরু নিয়ে যাত্রা করছে এমন দৃশ্য তার দৃষ্টি পথে ভেসে উঠেছে। মেঘেরা গাভীর মতো বিচরণ করছে। তিনি অবনী হয়ে দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছেন। কারা যেন তার দরজায় কড়া নাড়ছে। কে যেন তাকে কাছে ডাকছে 'আয় আয়' বলে। সে যেতে চাচ্ছে না। সে অবনীর কণ্ঠে বলছে 'তুমি আমাকে ডাকছ, আমি চলে যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব? 'সে আরও বলে ওঠে 'আমার তো একটা ছোট শিশুসন্তান রয়েছে, ওর মুখ ধরে চুমু খাব।'
জগৎ সংসারের মায়া-মমতা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে চাচ্ছে।
কবি পরক্ষণে বুঝতে পারলেন, সে ইচ্ছে করলেই তার এই বসবাসকে চিরস্থায়ী করতে পারবে না। চলে যেতেই হবে তাকে। মমতার বন্ধন সন্তানের লাবণ্যময় মুখ তাকে ধরে রাখতে পারবে না। এ ভাবনা থেকে তিনি বললেন, 'আমি যাব কিন্তু এখনই যাব না।' এসব কথা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অবনী বাড়ি আছ শীর্ষক কবিতায় সুন্দরভাবে বিবৃত হয়েছে। তার ভাবনা শিল্প সম্মতভাবে কবিতায় ধরা পড়েছে। শক্তির কবিতায় ভাববাদ ও বাস্তববাদের যুগলবন্দি লক্ষ্য করা যায়। তিনি নিজস্ব বাব্যভাষা দিয়ে বিস্তৃত করেছেন কবিতার ভুবন। তার ছিল কঠিন অনুভব। এই কঠিনতাকে তার কাব্যভাষা শিল্প সমৃদ্ধ করেছে। আপনমনে থাকার আকুতি তিনি তার কবিতায় প্রকাশ করেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তার কবিতায় নারীর নরম সুষমা এবং পাথরের কাঠিন্যকে একীভূত করেছেন। বহুমাত্রিক ভাবনাকে তিনি কবিতাবদ্ধ করেছেন। তার মধ্যে ছিল অগণিত মানুষের বসতি। আপনমনে এসব মানুষের সুখ-দুঃখ ব্যাকুলতাকে তিনি ধারণ করেছেন, বয়ে বেড়িয়েছেন। অসংখ্য মানুষের মিলিত অনুভূতি তার ভিতর সংসার করত। তিনি মৃতু্য ভাবনায় অবগাহিত হয়েছেন। মৃতু্য অপ্রতিরোধ্য, সে কারণে তিনি দ্বিতীয়বার জন্মাতে চেয়েছেন। পথ তো অনেকগুলো। সব পথে এক জীবনে হাঁটা সম্ভব নয়। তাই তিনি দুটো জন্ম প্রত্যাশা করেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সব তন্ত্র পদ্যরীতি তার কবিতাকে শিল্পোত্তীর্ণ করে তুলেছে। তিনি বাংলা কবিতার জগতে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন তার অনুরক্ত পাঠকরা শক্তির কবিতাকে চিত্তে ধারণ করে রাখে।