জীবনের প্রতিচ্ছবি

প্রকাশ | ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০

ফারজানা ইসলাম
আজ সকালে ঘুম ভাঙলো একটু দেরিতে। প্রথমে সবকিছু স্বাভাবিক মনে হলো এবং প্রায় সারারাত মনের সঙ্গে যে যুদ্ধ করেছি তা যেন আমার স্মরণেই ছিল না। আস্তে আস্তে নিজের শরীরের দিকে নজর দেওয়াতে ঘাড়ের কাছে মেরুদন্ডে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করলাম। মাথাটাও বেশ ঝিমঝিমিয়ে উঠল। শারীরিক এসব বাতিককে পাত্তা না দিয়ে তড়িঘড়ি করে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলাম চোখ রক্তবর্ণ, মুখ ফ্যাকাশে। ঠান্ডা জ্বর অনুভূত হচ্ছে। আয়নায় আজ নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করি। এই আমি কি সেই আমি। দুরন্ত শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত-বসন্ত সব ঋতুই আমার কাছে সমান ছিল। গ্রীষ্মের দাবদাহ, বর্ষার মুষলধারে বৃষ্টি, শীতের প্রচন্ডতা আমাকে স্পর্শ করত। বসন্তে কোকিল ডাকে, মৃদুমন্দ বাতাস বয়, মানুষের মন নেচে উঠত। কিন্তু সব মানুষের মন কি নেচে ওঠে। বিশেষ করে যাদের মনে আনন্দ নেই। আজ অতীতের স্মৃতিমাখা অনুভূতিগুলো মোচড় দিয়ে উঠছে। ছোটবেলায় অনেকটা ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম আমি। এ জন্য মায়ের বকুনি পিটুনি খেয়েছি কতবার। মেয়ে বন্ধুদের চেয়ে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল, কেরাম ও ব্যাটমিন্টন খেলতে পছন্দ করতাম। মাঠে মেয়েদের সঙ্গে খেলে আবার ছেলেদের সঙ্গে খেলতে যেতাম। পোশাকের ব্যাপারে আমি ছিলাম অন্যরকম। ছোটবেলা থেকেই সালোয়ার-কামিজের পরিবর্তে জিন্স প্যান্ট ও ফতোয়া পরতে পছন্দ করতাম। আমি পারদর্শী ছিলাম সাইকেল চালাতেও। রাজশাহীর পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত রিভারভিউ স্কুলের সাইকেল প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলাম। ১৭০০ মিটার সাইকেল প্রতিযোগিতা ছিল। আমি শহীদ নজমূল হক স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। খেলাধূলার পাশাপাশি সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতির প্রতিও আমার দারুণ ঝোঁক ছিল। সোনার দেশসহ স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় লিখতাম। আমি গার্লস গাইডের ভালো একজন স্বেচ্ছাসেবী ছিলাম। গাইড জোছনা ম্যাডাম আমাদের প্রশিক্ষণ দিতেন। ঈদ উৎসবে নানা খেলার মাধমে শিশুদের আনন্দ দিতাম। অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করার মানসিকতা আমার ছোটবেলা থেকেই ছিল- যা আজো লালন ও বিকশিত করে চলেছি। এ বিষয়ে বিস্তৃত করেছি আমার কর্মময় ও ব্যক্তিগত জগৎকেও। একটি ঘটনা মনে পড়ে যায়, প্রচন্ড রোদতপ্ত এক দুপুর। দুস্থ অসহায় এক মা এসে বললেন, আমার পায়ে সেন্ডল নেই। তার দিকে আমি তাকালাম। বড় মায়া লাগল আমার। অবশেষে আমার সেন্ডল দিয়ে দিলাম তাকে। ভাবলাম গরমে ওর পা ফেটে যাচ্ছে। আমি কীভাবে বাড়ি যাব সেটা চিন্তা করলাম না। অনেক কষ্টে বাড়ি এসে মাকে বলি সেন্ডল হারিয়ে গেছে। বাজার দূরে থাকায় সেন্ডল কিনতে আমার সাত দিন লেগেছিল। আমার দূর সম্পর্কের দাদু ভাই (আম্মুর মামা) আমাদের বাসায় পেনশনের টাকা তুলতে আসতেন। আমি তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম। লোকটি ভীষণ কৃপণ ছিলেন। কিছু খেতে চাইলেও কিনে দিত না। অনেক কষ্টে তার কাছ থেকে একটি আইসক্রীম আদায় করলাম। এমন সময় এক বাচ্চা হাত পাতল। আমি ওকে দিয়ে দিলাম। দাদু জিজ্ঞেস করলে বললাম, হাত থেকে পড়ে গেছে। যেহেতু আমি বাচ্চাদের পছন্দ করতাম। ওদের খাবারসহ নানা জিনিস কিনে দিতাম। এজন্য বাবা-মা ভাইয়েরা শঙ্কার মধ্যে থাকত আমাকে নিয়ে। নিজে না খেয়ে মানবসেবায় মত্ত কিনা। ছোটদের নিয়ে বিজ্ঞানমেলা কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করতাম। নিজের উদ্যোগে ওদের পুরস্কার দিতাম। আজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেবলই মনে হচ্ছে, আমি যা করেছি মানুষের জন্য। আমি যতটা করতে চেয়েছি, হয়তো তা পারিনি। আমার মনে হচ্ছে, শীত-দুপুরে হেলানো সূর্যের মিঠেকড়া তাপ মাথায় চড়িয়ে শব্দহীন পায়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছি শৈশবের দিকে। আমার চিন্তাভাবনার গতি-প্রকৃতি এমন যে মনে হচ্ছে- আমার সমগ্র চিন্তাচেতনায় একনাগাড়ে কে যেন বাড়ি মারছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। বৃষ্টির পানিতে সবুজপাতা অত্যধিক সতেজ হয়ে উঠলে আমার চোখে-মুখে স্বর্গীয় আনন্দ খেলা করে। আকাশের দিকে তাকাতেই মন জুড়িয়ে যায়। কখনো মনে হয়, জীবনের পদে পদে ফঁ্যাকড়া। বাতাসের একটানা হিসহিসানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। হয়তো ঝড় আসবে। কখনো মনে হচ্ছে আয়নার সামনে নয়, ঘনান্ধকারে ঢেকে থাকা নিকষকালো গভীর রাতের প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। রাজধানী ঢাকার ফুটপাত ছুঁয়ে বাতাস এলোমেলোভাবে বইতে শুরু করলে রাস্তায় অসহায় শিশুদের দেখতে পাই। আমার কপালের বিন্দু বিন্দু জমে ওঠা ঘাম মুছতে শুরু করি। আমার ভেতর আনমনা ভাব চলে আসে। ছোট্ট বেলার টকটকে বিকালের কথা, ফসলের সবুজ মাঠে স্থানীয় বাতাসের হামাগুড়ি দেওয়ার দৃশ্যের কথা মনে পড়ে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, দূর আকাশে ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়ে মাঠের মধ্যে লাটাই ধরে ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। দুরন্ত শৈশব বারবার আমাকে ডাকছে। প্রকৃতি সাজুক আর না-ই সাজুক কিশোরী মন এমনিতেই নেচে ওঠে। চঞ্চলতা এবং দুরন্তপনা একইসঙ্গে আমাকে হাতছানি দেয়। মনের মধ্যে বান ডাকে। বিচিত্রমুখী চিন্তা মনের মধ্যে অনবরত কাজ করতে থাকে। চিন্তার পর চিন্তা এসে যখন মাথার মধ্যে পাক খেতে শুরু করে তখন আমার চোখের সামনে নতুন স্বপ্ন জেগে ওঠে। আমাকে বাকি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। দাঁড়াতে হবে অসহায় দুস্থ নিরন্ন মানুষের পাশে। আমাকে অতিক্রম করতে হবে সব ধরনের সীমাবদ্ধতা। আজ আকাশব্যাপী মেঘের বড্ড আনাগোনা। মুহূর্তেই বৃষ্টি পড়া শুরু করল। আমি দেখতে পাচ্ছি সবুজ পাতায় বৃষ্টির নাচন। আমি কি বুষ্টিতে ভিজছি, নাকি আয়নায় আমার জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখছি?