বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সুমন চলে যাওয়ার পর

ইউনুস মোহাম্মদ
  ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সুমন চলে যাওয়ার পর

সুমন রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা অ্যান্ড্রোয়েট মোবাইল। ঢালাই রাস্তা। রাস্তার দুইপাশে চাম্বল গাছের সারি। গভর্নমেন্টের গাছ এগুলো। গাছগুলো উপরে ছাতার মতো ডালপালা বিস্তার করে আছে। রাস্তার পাশেই প্রতিবেশী বাড়ির ডোবা। দুই/তিন বাড়ির কুটাকাটি আর উচ্ছিষ্ট আবর্জনা এই ডোবায় এসে পড়ে। এজন্য একটা উৎকট গ্যাসীয় গন্ধ নাকে এসে লাগে সব সময়। এখনো লাগছে। তবে সেদিকে সুমনের ফোকাস নেই। তাদের বাড়ি এখানেই। রাস্তার অপর পাশে দুইচালার টিনের ঘর। উত্তর পাশে একটা ছাপড়া ঘর আছে। চারপাশের পাড়াপ্রতিবেশীরা সবাই পয়সাওয়ালা। সবার বাড়িতে বড় বড় ঘর আছে। তাদের সবার বাড়ি বড়। এখানে সুমনরাই কেবল গরিব।

সুমনের মাথায় লম্বা চুল। স্টাইল করে মাথার চুল কেটেছে। বিশেষ করে সামনের চুলগুলো বেশ লম্বা। সামনের চুলগুলো তার কপাল ঢেকে রেখেছে।

বছরখানিক ধরে সুমন ঢাকায় টার্সের কাজ করে। তবে যে বেতন পায় সেটা নিজেই খরচ করে ফেলে। বাড়িতে টাকা দিতে পারে না। দুই মাস পর পর সে বাড়িতে আসে।

এখন সে এক সপ্তাহ ধরে বাড়িতে আছে। ঢাকা যেতে চায় না। তার মা রাগারাগি করে। বলে যে, কাজ শিখবার গেছো, কাজ শিখুন লাগবো না। ঢাকায় যা।

কিন্তু সুমন মায়ের কথার কোনো গুরুত্ব দেয় না।

বাবা আছে। বাবা বড়বাজারে একটা হোটেলে বাবুর্চির কাজ করে। ভোরে যায় আর ফিরে রাত ১০টার পর। সুতরাং, বাবার সঙ্গে সুমনের খুব একটা কথা হয় না।

সুমনের পরনে ফুলপ্যান্ট। ঢাকা থেকে বাড়িতে এলে সব সময় সে এভাবে ফুলপ্যান্ট পরে থাকে। পায়ে বেলওয়ালা জুতা।

সুমনের মুখে সব সময় হাসি থাকে। এখনো আছে। পাশের বাড়ির একটা ছেলেকে দেখে সুমন হাসিমুখে কথা বলল। তখনই তার মুচকি হাসিটা দেখা গেল। সে হাসার সময় দুই ঠোঁটের ফাঁক গলে সামান্য দাঁত দেখা যায়। এখনো তাই দেখা গেল। হাসির সময় ঠোঁট দুটি সে প্রসারিত করে ফেলে। আর তখনই দাঁতের অংশ বিশেষ দেখা যায়।

কয়েকদিন পর সুমন ঢাকায় এলো। মেসে থাকে। একটা অর্ধবয়সি বুয়া তাদের রান্না করে খাওয়ায়। রান্নার হাল যা-তা। তরকারি যেন যুদ্ধ করে খেতে হয়। বুয়াকে কিছু বলা যায় না। কিছু বললেই রাগে কড়কড় করে উঠে সে। বুয়া আরো কয়েকটি বাসায় রান্নার কাজ করে। কাজেই এই কাজ ছুটে গেলেও তার বিশেষ কোনো অসুবিধা নেই। তাইতো বুয়ার এমন চটাং চটাং ভাব।

থাকার ব্যবস্থাও ভালো না। ছোট্ট একটা ঝুপড়ি ঘরে চারজন ছেলে থাকে তারা। গাদাগাদি করে শোয়। ঢাকা শহরে মশার এত উৎপাত যে মশারি টাঙিয়েও বিশেষ কাজ হয় না। মশারির ভেতরেও মশার কামড় খেতে হয়। তার ওপর মশারি না থাকলে স্বেচ্ছায় মশাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

তবে এতসব অসুবিধা সত্ত্ব্বেও তাদের কারো কোনো অভিযোগ নেই। বলা যায়, ফূর্তিতে আছে সবাই।

টার্সের কাজ উপরে করতে হয়। সুমন এখন কিছুদিন ধরে ঊপরে কাজ করে। এজন্য বেতনটাও বাড়ছে খুব তাড়াতাড়ি।

উপরে কাজ করা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ।সবাই উপরে কাজ করার সাহস পায় না। পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। অনেক ঊপরে আট দশ ইঞ্চি চওড়া লোহার এঙ্গেলের ওপর দিয়ে হাঁটতে হয়। হাতে আবার যন্ত্র থাকে। মাঝে মধ্যে ঝুলে থেকেও কাজ করতে হয়। কিছুদিন আগে পার্শ্ববর্তী এলাকার একটি ছেলে মারা গেছে টার্সের কাজ করতে এসে। ছেলেটি উপর থেকে নিচে পড়ে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে মারা গেছে।

এখন বেলা ১১টা বাজে। একটু আগে সকালের নাস্তা করেছে সুমন। উপরে টার্সের কাজ হচ্ছে। সুমন উপরে আছে। খুব বেশি উপরে না। দশ/বারো মিটার হবে। তার সঙ্গে উপরে আরো একটি ছেলে আছে। ছেলেটির নাম আলামিন। সুমনকে এঙ্গেলের উপর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। এমনিতে স্বাচ্ছন্দ্যে হেঁটে যায় কিন্তু আজ কেন জানি পা কাঁপছে। মারা যাওয়া ছেলেটির কথা মনে পড়েছে। টার্সের কাজ করতে এসে পড়ে গিয়ে মারা গিয়েছিল ছেলেটি। এখানে সামান্য এদিক ওদিক করা যাবে না। কোনো ভুল করা যাবে না। কিছু ভুল জীবনে একবারই করা যায়। কিছু ভুলের কোনো সমাধান নেই। কিছু ভুলের পরিসমাপ্তি ঘটে মৃতু্য দিয়ে।

আকাশে রৌদ্র মেঘের খেলা। এই রোদ উঠছে তো এই মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে রোদ। অক্টোবর মাস শুরু হয়েছে। একটা লোহার টুকরো হাতে নিয়ে এঙ্গেলের উপর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সুমন। মাথায় শক্ত করে হেলমেট বাঁধা। চোখে কালো চশমা। টার্সের কাজ করার সময় চোখে চশমা পরতে হয়। নিচে কংক্রিটের শক্ত ঢালাই। একপাশে লোহার বার স্তূপ করা। এগুলো কাজের মালমশলা। নিচে দুটি ছেলে দাঁড়িয়ে কাজ করছে। যখন যেটা লাগছে দড়িতে বেঁধে তুলে দিচ্ছে উপরে। তিরিশ পঁয়ত্রিশ হাত লম্বা একটা দড়ি ঝুলছে উপর থেকে নিচে পর্যন্ত। ছেলে দুটি মজা করে এটা ওটা বলছে মাঝেমধ্যে। সব সময় যেটা করে তারা।

হঠাৎ একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সৃষ্টিকর্তা চেয়েছিলেন বলেই হয়ত ঘটলো। হঠাৎ সুমন এঙ্গেল থেকে পা হড়কে নিচে পড়ে গেল। পড়লো গিয়ে কংক্রিটের ঢালাইয়ের ওপর। লোহার বারে বাড়ি খেয়ে হেলমেট ছিটকে বহু দূরে গিয়ে পড়লো। ফলে, মাথাটা ফেটে যাওয়া বাঙ্গির মতো বিছিয়ে পড়ল ঢালাইয়ের উপর। সুমন একবার শুধু প্রবল শক্তিতে ঝাঁকুনি দিল সমস্ত শরীর। তারপরই সব নিথর হয়ে গেল। মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে এসেছে। নাক আর কান দিয়ে রক্ত ছুটছে কাটা গরুর মতো। সঙ্গে সঙ্গে সবাই ছুটে এলো তার কাছে। কিন্তু সুমন বেঁচে নেই।

খবর পেয়ে মালিক ছুটে এলো। মালিক এত মোটা যে তাকে দেখলে মনে হয় একটা মুড়ির বস্তা। দুহাতে সবকিছু ঠেলে দিয়ে সামনে এগিয়ে আসছে। সুমো কুস্তিগিরের মতো দেখা যায়। বয়স কম। কিন্তু কাজের অভিজ্ঞতা অনেক। তারই এখানে সুমন কাজ করত। একটা আগেকার দিনের মোটর সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করে মালিক। মোটর সাইকেলটি তার বিরাট দেহের তুলনায় খুবই নগণ্য। তাই যখন সে তার বিরাট দেহ নিয়ে মোটর সাইকেলে চড়ে বসে তখন মনে হয় সে মোটর সাইকেলটার উপর জুলুম করছে।

মোটর সাইকেল থেকে নেমে সুমনের মৃতদেহ দেখলো সে। ফোনে সুমনদের বাড়িতে কথা বলল। সুমন এক্সিডেন্ট করেছে। মারা যাওয়ার কথাটা বলল না। শুধু বলল, মারাত্মক এক্সিডেন্ট করেছে। কি হয় বলা যায় না।

পুলিশি ঝামেলা মেটার পর সুমনের লাশ বাড়িতে আনা হলো। তখন বিকাল বেলা। সুমনদের বাড়িতে মানুষের ঢল। এলাকার সবাই শুনেছে এই দুর্ঘটনার খবর। মোটর সাইকেল নিয়ে মালিক সঙ্গে এসেছে। মোটর সাইকেল রাস্তার পাশে রেখে গাড়ি থেকে নামলো সে। তাকে দেখে অনেকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। সুমনের মা হাত-পা ছুড়ে পাগলের মতো কাঁদছে। মাথার চুল এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। তাকে ধরে দুয়ারে নিয়ে আসা হয়েছে। মালিক ভিড় ঠেলে কাছে এসে সুমনের মাকে সান্ত্বনা দিল। আজ থাইকা আমি আপনের ছেলে। আলস্নার মাল আলস্নায় নিয়া গেছে। আপনে আমি ধইরা রাহা পারুম? কাইন্দেন না। ওর জন্য দোয়া করেন।

সুমনের মা চিৎকার করে বলল, 'আমারে মা কইয়া ডাক দিব কিডা। আমার সুমন আর কোনো দিন মা কইয়া ডাক দিব না।'

বস্তুত, সুমন এই বাড়ির একমাত্র ছেলে ছিল। সে মারা যাওয়াতে এই বাড়িতে আর কোনো ছেলে রইলো না। তারা আজ থেকে ছেলে হারা হলো।

মালিক আরো দুইচার কথা বলে বাইরে বেরিয়ে এলো। রাস্তার একপাশে সুমনের জন্য বাঁশ কাটা হচ্ছে। সুমনদের পক্ষের লোকের সঙ্গে মালিকের কথাবার্তা হলো। তার কাজ করতে গিয়ে সুমন মারা গেছে। এখন মালিক কি করবে? তার কি কর্তব্য এখানে।

মালিক বলল, তাদের যেহেতু আর কোনো ছেলে নেই, তাই যতদিন তারা বেঁচে আছে ততদিন তাদের প্রতি মাসে পাঁচ হাজার করে টাকা দেবে। প্রতি ঈদে আরো কিছু আছে তাদের জন্য। মালিক সেটা এখনই বলতে চায় না।

আর সুমনের খরচটা সেই করে দেবে।

মালিক নারকেল গাছ তলায় চেয়ারে বসল। তার ওজন নিতে না পেরে চেয়ার টিকটিক করছে। প্রতিবেশী বাড়ির গণ্যমান্য আরো দুই-চারজন লোক এসেছে। তারাও চেয়ারে বসে কথাবার্তা বলছে।

সুমনকে দেখার জন্য মানুষ আসছে দূরের গ্রাম থেকে। এই তরতাজা মৃতু্যর খবর যে শুনছে সেই আসছে দেখছে।

সুমনকে মাটি দেয়া হবে মাগরিবের নামাজের পর। এলাকায় মাইকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে সেই কথা। সুমনের চাচা আর ফুপুরা আসছে তাকে শেষ দেখা দেখতে।

সুমনের মা আবার হাত-পা ছুড়ে কান্না করছে। দুইজন মহিলা তাকে ধরে রাখতে পারছে না। সুমনের ছোট মামি এসেছে। তার মনটা খুব নরম। সুমনের মাকে শক্ত করে ধরে আছে সে। ননাসের কাঁন্না দেখে সেও কাঁদছে।

স্থানীয় মসজিদের ইমাম সাব এসে সুমনকে গোসল দিল। তার শরীরের পরিমাপ নিয়ে কাফনের কাপড় কেটে ঠিক করল। মাগরিবের নামাজের পর রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে সুমনের জানাজার পড়ল সবাই। তারপর সুমনের লাশের খাট কাঁধে নিয়ে গোরস্তানের দিকে গেল সবাই। তবে রাত বলে অনেকে মাটি দিতে গোরস্তান পর্যন্ত গেল না।

সুমনের লাশ যখন নিয়ে যায় তখন বাড়িতে আরেকবার কাঁন্নার রোল উঠল। হাত-পা ছুড়ে সবকিছু ভেঙে ফেলে সুমনের মা। ছেলেকে নিয়ে যাওয়া সে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারছে না। সুমনের মামি কাপড় ঠিক করে দিল। এক সময় দাঁতে খিল ধরে গেল সুমনের মায়ের। বেশি কাঁন্না করলে এরকমই হয় তার। চামিচ দিয়ে দাঁত ছাড়াতে হয়। এখনো ছাড়াতে হলো।

সুমনকে নিয়ে তার মা-বাবার অনেক আশা ছিল। আশা ছিল ছেলেকে কাজ শিখিয়ে বিদেশে পাঠাবে। সুমনের মামাতো ভাই বিদেশে আছে। কাজ শেখার পর সেই তাকে বিদেশে নিয়ে যেত। মামাতো ভাই এই কথা বলেছিল। সেটা আর হলো না।

মাঝিরচর বাজারে কবরস্থান। সেখানে সুমনের জন্য কবর খোঁড়া হয়েছে। বাঁশের মাচাইলসহ সবকিছু সেখানে আগেই চলে গেছে। মালিক মোটর সাইকেল চালিয়ে লাশের আগে, আগে কবরস্থানে চলে এলো। কবরস্থানে লাইট আছে। পুরো কবরস্থান জোসনা করে বড় একটা বাল্ব জ্বলছে কবরস্থানের ফটকে। খাটিয়াসহ সুমনের লাশ আসছে ভ্যানে করে। গোড়ে বসে দুই/তিনজন লাশের অপেক্ষা করছে। কবর খোঁড়ার শুরু থেকেই তারা এখানে আছে। লাশ আসার পর খুব সাবধানে কবরে নামানো হলো মৃতদেহ। কোদাল দিয়ে টেনে কবরে প্রথম মাটি দিল সুমনের বাবা। লোকজন বেশি আসেনি। কয়েকজন প্রতিবেশী আর কিছু নিকটাত্মীয় আছে কবরস্থানে। মাটি দেয়া শেষে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে হুজুর দোয়া করলেন সুমনের জন্য।

বাড়িতে সুমনের মায়ের কাঁন্না থামেনি। বাড়িতে এখন মানুষের চাপ নেই। বাড়ি পাতলা হয়ে গেছে। সুমনের চাচা আর ফুপুরা এসেছে। তারাই এখন সুমনের মায়ের কাছে আছে। সারারাত সুমনের মায়ের কান্না থামলো না। ছেলের শোকে চোখে ঘুম নেই, খাওয়া নেই। তার সঙ্গে অন্যদেরও জেগে থাকতে হলো। এখন ছেলের শোকে সুমনের মা প্রায় পাগলপারা। তাই কখন কী করে বসে কে জানে। এমনও তো হতে পারে যে, ছেলের শোকে সে আত্মহত্যা করেছে। তাই, সারারাত জেগে থেকে তাকে পাহারা দিতে হলো।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে