বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

যতীন্দ্রমোহন বাগচী বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র

আজহার মাহমুদ
  ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যতীন্দ্রমোহন বাগচী বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র

বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই/মাগো, আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই? এই কবিতাটি ছিল ৯০ দশকের শিক্ষার্থীদের অন্যতম পছন্দের একটি কবিতা। এখনো ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায় এই কবিতা পাঠ করলে। এই কবিতার রচয়িতার নাম যতীন্দ্রমোহন বাগচী। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি কবি ও সম্পাদক।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী বাংলা সাহিত্যের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি নদিয়া জেলার জমশেরপুরে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস হুগলি জেলার বলাগড় গ্রামে। বাবার নাম হরিমোহন বাগচী ও মায়ের নাম গিরিশমোহিনী দেবী। যতীন্দ্রমোহন ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। অল্পবয়সেই তার প্রতিভা সবার নজর কাড়ে। তিনি খাগড়া মিশনারি স্কুল বহরমপুর থেকে বৃত্তি নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৯৮ সালে কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। সেই একই বছর ভাবিনীদেবীকে বিয়ে করার মাধ্যমে তিনি বৈবাহিক জীবন শুরু করেন। বিয়ের পর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯০০ সালে এফএ এবং ১৯০২ সালে ডাফ কলেজ (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ) থেকে বিএ পাস করেন।

যতীন্দ্রমোহন ব্যক্তিগত সচিবরূপে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে কলকাতা করপোরেশনে নাটোর মহারাজের ব্যক্তিগত সচিব ও জমিদারির সুপারিনটেনডেন্ট পদে এবং কর কোম্পানি ও এফএন গুপ্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন। যতীন্দ্রমোহন বহু সাহিত্য পত্রিকায় গঠনমূলক অবদান রেখেছেন। ১৯০৯ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত মানসী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯২১ ও ১৯২২ সালে তিনি যমুনা পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন।

১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ পূর্বাচল পত্রিকার মালিক এবং সম্পাদক ছিলেন। পলস্নী-প্রীতি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিমানসের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। গ্রামবাংলার শ্যামল স্নিগ্ধ রূপ উন্মোচনে তিনি প্রয়াসী হয়েছেন। গ্রামজীবনের অতি সাধারণ বিষয় ও সুখ-দুঃখ তিনি সহজ সরল ভাষায় সহৃদয়তার সঙ্গে তাৎপর্যমন্ডিত করে প্রকাশ করেছেন। যতীন্দ্রমাহন ছিলেন রবীন্দ্রোত্তর যুগের শক্তিমান কবিদের অন্যতম। পলস্নীপ্রকৃতির সৌন্দর্য ও পলস্নী জীবনের সুখ-দুঃখের কথা তিনি দক্ষতার সঙ্গে প্রকাশ করেন। ভাগ্যবিড়ম্বিত ও নিপীড়িত নারীদের কথা তিনি বিশেষ দরদের সঙ্গে প্রকাশ করেছেন। 'কাজলা দিদি' ও 'অন্ধবন্ধু' তার এ ধরনের দুটি বিখ্যাত কবিতা।

যতীন্দ্রমোহন বাগচী বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে রবীন্দ্রানুসারী হিসেবে চিহ্নিত, যদিও এই প্রশ্নে অনেক বিতর্কও রয়েছে। ভারতের কবি মোহিতলাল মজুমদারের মতে, 'রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা যারা করেছেন তাদের মধ্যে যতীন্দ্রমোহন অন্যতম।'

যতীন্দ্রমোহনকে কেউ কেউ পলস্নীকবি আখ্যাও দেন- তবে তার পলস্নী কবিতা শুধু পলস্নী বর্ণনায় পরিণত হয়নি, সেখানে একই সঙ্গে মানুষ ও প্রকৃতি মিশে আছে, হৃদয় ও জীবনের সম্মিলিত উদ্ভাসও। মাটির সঙ্গে তার নাড়ির টান ছিল অবিচ্ছেদ্য, প্রকৃতিপ্রীতির কারণেই তার কলমে ফুটে ওঠে যথাযথ নিসর্গ বর্ণনা।

তার কবিতা লেখার শুরু কিশোরকাল থেকে। একুশ বছর বয়স থেকে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত তার রচনা প্রকাশিত হতে থাকে। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'লেখা'। এটি একটি কাব্যগ্রন্থ। অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে 'রেখা', 'অপরাজিতা', 'নাগকেশর', 'কাব্যমালঞ্চ', 'পাঞ্চজন্য', 'পথের সাথী', 'বন্ধুর দান', 'জাগরণী', 'নীহারিকা' এবং 'মহাভারতী'। 'রবীন্দ্রনাথ ও যুগসাহিত্য' নামে একটি স্মৃতিকথা এবং 'সাথী' নামে একটি উপন্যাসও রয়েছে তার। পলস্নীপ্রকৃতি, পলস্নীর সহজ-সরল মানবজীবন, মানুষের দুঃখ-কষ্ট, নারীর নীরব বেদনাবোধ যতীন্দ্রমোহন বাগচীর রচনার প্রধান বিষয়বস্তু। কখনো কখনো নাগরিক জীবনের সঙ্গে সরল ও সাধারণ গ্রামীণ জীবনের তুলনাও ফুটে উঠেছে নিপুণভাবে। বিষয়বস্তুর স্পষ্টতা, সহজ কিন্তু প্রাঞ্জল ভাষা আর ছন্দের কারুকার্য তার কবিতাকে দিয়েছে বিশিষ্টতা। 'মানসী' ও 'যমুনা' পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক এবং 'পূর্বাচল' পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন তিনি।

'ওই যে গাঁটি যাচ্ছে দেখা 'আইরি' খেতের আড়ে/ প্রান্তটি যার আঁধার করা সবুজ কেয়াঝাড়ে,/ পুবের দিকে আম-কাঁঠালের বাগান দিয়ে ঘেরা,/ জট্‌?লা করে যাহার তলে রাখাল বালকেরা্ত/ ওইটি আমার গ্রাম, আমার স্বর্গপুরী,/ ওইখানেতে হৃদয় আমার গেছে চুরি...' গ্রামীণসর্গের বর্ণনায় তার 'জন্মভূমি' নামের এই কবিতা আজও অনেকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রম্নয়ারি তিনি মৃতু্যবরণ করেন। প্রচারে না থাকলেও যতীন্দ্রমোহন বাগচী আজও বাঙালির মননে রয়েছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে