বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

জোবায়ের আলী জুয়েল
  ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ

সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ প্রথম বাঙালি যিনি সর্বপ্রথম পাশ্চাত্যে এই উপমহাদেশের রাগ সঙ্গীতকে পরিচিতি ও প্রচার করেন। অতি উচ্চ মাত্রার সঙ্গীতকলাকার ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন। বাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে বিখ্যাত এক সঙ্গীত শিল্পী পরিবারে ১৮৬২ সালের ০৮ অক্টোবর তার জন্ম। তার পিতা সবদর হোসেন খাঁ ওরফে সদু খাঁ ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ। তার মাতার নাম ছিল সুন্দরী খানম। আলাউদ্দিনের ডাক নাম ছিল 'আলম'।

দুনিয়া জোড়া যার যশ খ্যাতি বিরাজমান- এখন সেই সুর সম্রাটের বাড়িতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেড়াতে গেলে যে কেউ আঁতকে উঠবে। ভাঙাচুরা আগুনে বিধ্বস্ত সম্পূর্ণ বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে হেফাজতে ইসলামের ধ্বংসাত্মক তান্ডবনীলায় এ এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। বাল্যকালে অগ্রজ ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর কাছে সঙ্গীতে আলাউদ্দিন খাঁ'র হাতে খড়ি। সুরের সন্ধানে তিনি ১০ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এক যাত্রা দলের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। ওই সময় তিনি জারি, সারি, বাউল, ভাটিয়ালি, কীর্তন, পাঁচালি প্রভৃতি গানের সঙ্গে পরিচিত হন। অতঃপর কলকাতা গিয়ে তিনি প্রখ্যাত সঙ্গীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নুলো গোপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তবে গোপাল কৃষ্ণ একটি শর্ত আরোপ করলেন আলাউদ্দিন খাঁ'র শিষ্যত্ব গ্রহণের সময় যে, কমপক্ষে বারো বছর এক নাগাড়ে সঙ্গীত সাধনা করতে হবে সেখানে থেকে। আলাউদ্দিন খাঁ রাজি হয়ে গেলেন আরোপিত শর্তে। কিন্তু সাত বছরের শেষ দিকে হঠাৎ পেস্নগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যবরণ করলেন সঙ্গীত সাধক গোপাল কৃষ্ণ।

পিতৃহীনের মতো দুঃখ শোকে কিছু দিন পাথর হয়ে রইলেন আলাউদ্দিন খাঁ। ক্রমে ক্রমে শোকের ভার কমলে আকস্মাৎ কণ্ঠসঙ্গীত সাধনা ছেড়ে দিয়ে তিনি যন্ত্রসঙ্গীত সাধনায় নিজেকে নিমগ্ন করলেন। স্টার থিয়েটারের সঙ্গীত পরিচালক অমৃতলাল দত্ত ওরফে হাবু দত্তের কাছে তিনি বাঁশি, পিকলু, সেতার, ম্যান্ডোলিন, ব্যাঞ্জু ইত্যাদি দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন। সে সঙ্গে তিনি লবো সাহেব নামে এক গোয়ানিজ ব্যান্ড মাস্টারের কাছে পাশ্চাত্য রীতিতে এবং বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ অমর দাসের কাছে দেশীয় পদ্ধতিতে বেহালা শেখেন। এছাড়া হাজারী ওস্তাদের কাছে মৃদঙ্গ ও তবলা শেখেন। এভাবে তিনি সর্ববাদ্য বিশারদ হয়ে ওঠেন।

আলাউদ্দিন খাঁ কিছুদিন ছদ্মনামে মিনার্ভা থিয়েটারে তবলা বাদকের চাকরি করেন। অতঃপর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার জগৎ কিশোর আচার্যের আমন্ত্রণে তার দরবারে সঙ্গীত পরিবেশন করতে যান। সেখানে ভারতের বিখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ আহমেদ আলী খাঁ'র সরোদ বাদন শুনে তিনি সরোদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার কাছে পাঁচ বছর সারোদে তালিম নেন। এরপর ভারত খ্যাত তানসেন বংশীয় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ'র কাছে সরোদ শেখার জন্য তিনি রামপুর যান। ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ রামপুরের নবাব হামেদ আলী খাঁর সঙ্গীত গুরু ও দরবার সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। আলাউদ্দিন খাঁ তার কাছে দীর্ঘ ত্রিশ বছর সেনী ঘরানায় সঙ্গীতের অত্যন্ত দুরূহ ও সুক্ষ্ণ কলা কৌশল আয়ত্ব করেন।

মাইহারের রাজা ব্রিজনাথ আলাউদ্দিন খাঁ'কে নিজের সঙ্গীত গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত করলে তিনি মাইহারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বেরিলির পীরের প্রভাবে তিনি যোগ, প্রণোয়াম ও ধ্যান শেখেন। এভাবে জীবনের একটা বড় অংশ আলাউদ্দিন শিক্ষার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেন। অতঃপর শুরু হয় তার কৃতিত্ব অর্জনের পালা। ১৯৩৫ সালে তিনি নৃত্য শিল্পী উদয় শঙ্করের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তখন তিনি ইংল্যান্ডের রাণী কর্তৃক সুর সম্রাট খেতাব প্রাপ্ত হন। তিনিই ভারতীয় উপমহাদেশের রাগসঙ্গীতকে সর্ব প্রথম পাশ্চাত্যের শ্রোতাদের কাছে পরিচিত করান- যা আগেই উলেস্নখ করা হয়েছে। তিনি উদয় শঙ্কর পরিচালিত নৃত্যভিত্তিক 'কল্পনা' শীর্ষক একটি ক্ল্যাসিক ধর্মী ছায়া ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন।

আলাউদ্দিন খাঁ সরোদে বিশেষত্ব অর্জন করেন। সহজাত প্রতিভা গুনে তিনি সরোদ বাদনে 'দিরি দিরি' সুরক্ষেপণের পরিবর্তে 'দারা দারা' সুরক্ষেপণ পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। সেতারে সরোদের বাদন প্রণালি প্রয়োগ করে সেতার বাদনেও তিনি আমুল পরিবর্তন আনেন। এভাবে তিনি সঙ্গীত জগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন- যা 'আলাউদ্দিন ঘরানা' 'মাইহার ঘরানা' নামে পরিচিতি লাভ করে।

আলাউদ্দিনের পরামর্শ ও নির্দেশে কয়েকটি নতুন বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবিত হয়। সেগুলোর মধ্যে 'চন্দ্র সারং' ও 'সুর শৃঙ্গার' বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য। তিনি অনেক রাগ-রাগিনীও সৃষ্টি করেন, যেমন: হেমন্ত, দুর্গেশ্বরী, মেঘবাহার, প্রভাতকেলী, মেহ-বেহাগ, মদন মঞ্জুরি, মোহাম্মদ (আরাধনা), মানঝ খাম্বাজ, ধবল শ্রী, সরস্বতী, ধনকোশ, শোভাবতী, রাজেশ্রী, চন্ডিকা, দীপিকা, মলয়া, কেদার, ভুবনেশ্বরী ইত্যাদি।

বহুসংখ্যক যোগ্য শিষ্য তৈরি তার অপর কীর্তি। তার সফল শিষ্যদের মধ্যে তিমির বরণ, পুত্র আলী আকবর খান, জামাতা পন্ডিত রবিশঙ্কর, ভ্রাতুসপুত্র বাহাদুর হোসেন খান, কন্যা রওশন আর বেগম (অন্নপূর্ণা), ফুলঝুরি খান, খাদেম হোসেন খান, মীর কাশেম খান, পন্ডিত যতীন ভট্টাচার্য, পান্নালাল ঘোষ, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, পৌত্র আশীষ খান, ধ্যানেশ খান, খুরশীদ খান, ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য প্রমুখের নাম উলেস্নখযোগ্য।

তিনি দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে অর্কেস্টার স্টাইলে একটি যন্ত্রি দল গঠন করে নাম দেন 'রামপুর স্ট্র্রিং ব্যান্ড'। ব্রিটিশ সরকার তাকে 'খাঁ সাহেব' উপাধিতে ভূষিত করে। অতঃপর ভারত সরকার তাকে একে একে 'সঙ্গীত নাটক আকাদেমী সম্মান (১৯৫২ খ্রি.)', 'পদ্ম ভূষণ (১৯৫৮ খ্রি.), 'পদ্ম বিভূষণ (১৯৭১ খ্রি.)', বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় 'দেশি কোত্তম (১৯৬১ খ্রিঃ)', এবং দিলিস্ন বিশ্ববিদ্যালয় 'ডক্টর অব ল' ' উপাধিতে ভূষিত করে।

১৯৫৪ সালে তিনি ভারত সরকার কর্তৃক প্রথম সঙ্গীত নাটক একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুলস্নাহ মুসলিম হল তাকে আজীবন সদস্য পদ দান করেন। এসব দুর্লভ সম্মান ও খেতাব সঙ্গীত বিদ্যায় আলাউদ্দিন খাঁ'র অসাধারণ কীর্তি ও সাফল্যকেই প্রমাণ করে।

সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৭২ সালের ০৬ সেপ্টেম্বর মৃতু্যবরণ করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে