জন্মদিনের শুভেচ্ছা
নূর কামরুন নাহার আমাদের চেনা জীবনের রূপকার
প্রকাশ | ০৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
আফরোজা পারভীন
নূর কামরুন নাহার অনেকদিন ধরে লিখছেন। সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই তার অনায়াস ও স্বচ্ছন্দ্য বিচরণ। তিনি সতত চলমান, থেমে নেই এতটুকু। এটাই সবচেয়ে বড় কথা। উপন্যাস গল্প প্রবন্ধ কবিতা মিলিয়ে তিনি লিখেছেন আঠারোটি গ্রন্থ।
'শোপিস' গল্পে স্বামী ইমতিয়াজের সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না স্ত্রী রেবার। ইমতিয়াজের প্রতিদিনই বিছানায় নতুন মেয়ে লাগে। সে ডিভোর্স চায়। কিন্তু যেদিন থেকে ডিভোর্স ফাইল করেছে সেদিন থেকেই ল-ইয়ার আনসারীকে একটু অন্যরকম লাগে, টেবিলে রাখা নু্যড ক্রিস্টাল মূর্তি বিবাহিত না অবিবাহিত জানতে চেয়ে মূর্তির বিভিন্ন সেনসিটিভ অঙ্গে হাত বুলায়। রেবা লজ্জিত এবং বিব্রত হয়। একটা চূড়ান্ত সেটেলমেন্টের জন্য আনসারী রেবাকে সন্ধ্যার পর আসতে বলে। নির্জন চেম্বারে সে বলে, 'এমন আগুন রূপ, এমন ছুরির মতো শরীর হয় নাকি। ঠাট্টা করছি না। সত্যি যদি তোমাকে পেতাম তাহলে এমন শোপিস বানিয়ে রেখে দিতাম।'
ডিভোর্সের কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলে রেবা। শোপিস হয়েই যদি থাকবে তাহলে ইমতিয়াজের পাথর স্বর্গেই থাকবে। এটাই শোপিসের কাহিনি। উচ্চবিত্ত অথচ অবহেলিত নির্যাতিত এক নারীর চিত্র তিনি তুলে এনেছেন এ গল্পে অনুপুঙ্খ বর্ণনায়।
'ওম' গল্পে বাবা শরফুজ্জামান হাসপাতাসে। মেয়ে আর ছেলের পালা করে রাত জাগা, দেখাশুনা, হাসপাতালের মানবেতর পরিবেশ, রোগীদের অবস্থা, গায়ে হলুদ দেওয়া 'লতা'র বাবার মৃতু্য, এসবেরই এক নিটোল চিত্র 'ওম' গল্পটি। গল্পের ডিটেইলিং-এর প্রশংসা করতেই হয়। খুঁটিনাটি ছেঁকে তুলে এনেছেন ছোট মাছ তোলার মতো। পাঁচ নাম্বার বেডের বস্নাডক্যান্সার আক্রান্ত রাজুর মৃতু্যর সঙ্গে সঙ্গে পিতাকে ছাপিয়ে সন্তানের জন্য মাতৃত্ব জেগে ওঠার বিষয়টি যে কোনো মা গভীরভাবে অনুধাবন করবেন। এ গল্পের সেরা অংশ এটি। মধ্যরাতে ভয়ভীতি উপেক্ষা করে সিএনজিতে মায়ের সন্তানদের কাছে ফেরা ও জড়িয়ে ধরে বাধভাঙা চুমু এক চেনা অথচ অনিন্দ্য অনুভূতিতে মন ভরিয়ে দেয়। বাবার জ্ঞান ফেরার পর বিশ বছর আগে মৃত স্ত্রী নীলিমাকে খোঁজা এক নতুন চমক। বাবার শীত আটকাবার জন্য মৃত ব্যক্তির মুখের পানি মাখা লাল কম্বল নিয়ে বাবাকে চেপে ধরার বর্ণনার নিখুঁত অংকনও লেখকের মুন্সিয়ানা।
'জীবন কখনও কাশফুল' মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েনের গল্প। আমরা ছুটছি প্রতিনিয়ত চরকির মতো। প্রাত্যহিকতার জালে বন্দি আমরা। চাকরি সংসার সন্তান এ এক নিবিড় চক্র। এর মধ্যে নিজের জন্য সময় কোথায়! স্বামী ঘরে ফেরে তো স্ত্রী বের হয়, স্ত্রী ফেরে তো স্বামী। কখনো দু'জন একসঙ্গে। বাসা বন্ধ। বাচ্চারা নিজেদের মতো করে বেড়ে ওঠে খায় দায়। এ জীবনে কোনো ঘুলঘুলি নেই, কোনো চোরাখোপ নেই, যেখান দিয়ে বসন্তের বাতাস ঢুকবে। নেই কোনো ভাঙাচোরা একফালি ফাঁক, যেখান দিয়ে দেখা যাবে শরতের আকাশ। অথবা হয়তো আছে সেটাও জানা নেই। এই একঘেয়ে প্রাত্যহিক যান্ত্রিকতা ছকবাঁধা জীবনের বাইরে একদিন বেরিয়ে আসে স্বামী-স্ত্রী হাবিব আর মিনু, গলির ঘিঞ্জি বাসা থেকে। আফতাবনগর প্রজেক্ট ছাড়িয়ে তারা চলে যায় কাশফুলের রাজ্যে। সেদিন আর বাসে চড়ে পয়সা বাঁচানোর চেষ্টা করে না ওরা। কূলপস্নাবিত কাশফুলের সমুদ্রে ওরা উন্মাতাল হয়। খায় ঘোরে চর্কির মতো, কাশফুলে কাশফুলে সাদা হয়ে যায় ওদের মাথা, পুরো শরীর। ফেরার সময় রিক্সার ঝাকুনিতে হাবিবের বুকের ওপর এসে পড়ে মিনুর মাথা। নববধূর মতো রঙিন হয়ে ওঠে ও, যদিও যৌথ জীবন সতের পেরিয়েছে। হাবিব বলে, 'মিনু একটা আইসক্রিম খাবে?' এক সময় এ বোধ মিনুর মনে জন্মে, জীবন শুধু গলির না, কখনো কাশফুলের।
গল্পটি ভালো লেগেছে। জীবনকে ভালোবাসতে জানলে, উপভোগ করতে জানলে গলিও হয়ে ওঠে প্রশস্ত রাজপথ। বুনোফুল হয়ে ওঠে কাশফুল। আসলে দরকার কাশফুল মন। যে মন থাকলে গলি ছাপিয়ে জীবন কাশফুল হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের সংগ্রামী যুগলেরা সংগ্রামকে জীবনের সারবত্তা জেনে অন্যদিকে চোখ ফিরাতে পারেন না। খোঁজেন না জীবনের গন্ধ বর্ণ আর কাশফুল।
'শীতের পাখি' গল্পের কাদির মিয়া জলিল মিয়ার পুত্র। ঢাকার আদিবাসী। পুরনো ঢাকা ছেড়ে মালিবাগে বাড়ি বানিয়েছেন। মনেপ্রাণে ঢাকাইয়া আভিজাত্য লালন করেন। চলিস্নশ পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ করেই বিয়ে করেন রসুলপুরের মেয়ে অপরূপা হাফিজাকে। সাংসারিক টানাপোড়েনে হাফিজা ঢাকায় এসে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়েছিল। প্রথমে অনিচ্ছায় আর পরে বাধ্য হয়ে তাকে দেহবিক্রি করতে হয়েছে। সেই টাকায় ভাইকে বিদেশে পাঠিয়েছে। সব কিছু গোপন করে বিয়ে হয়েছে কাদিরের সঙ্গে। কাদির তাকে বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। শাশুড়ি তাকে আপন করে নিয়েছে। ঢাকা শহরে এমন ঝকঝকা সাজানো সংসার তার ভাগ্যে জুটবে কখনোই ভাবেনি হাফিজা। তার মনে সারাক্ষণ সব হারানোর ভয়। সবাইকে তার ক্লায়েন্ট মনে হয়। বান্ধবী রুমা তাকে একদিন বলেছিল, 'এ কামের কথা কোনো দিন কাউরে কইবা না এমনকি মাকেও না, আর যদি কোনো দিন বিয়াও বও স্বামীরেও না, জীবন গেলেও কইবা না।' তাই অপরাধবোধে ভুগলেও স্বামীকে কিছু বলতে পারে না সে।
\হস্বামী কাদির তাকে বলে, ঢাকায় তিন ধরনের মানুষ আছে। এক হচ্ছে ঢাকার আদি স্থায়ী বাসিন্দা। যেমন সে। আর এক ধরনের আছে যারা গ্রামের সব বিক্রি বাট্টা করে ঢাকায় এসে স্থায়ী হয়েছে। আর তৃতীয় এক শ্রেণি আছে যারা ঢাকায় আসে, কিছুদিন থাকে কামাই করে তারপর তারা গ্রামে চলে যায়। এরা 'শীতের পাখি'। স্বামীর বলা এই 'শীতের পাখি' কথাটা হাফিজার মনে গেঁথে যায়। সত্যিই তো, যদি কাদির সব জানতে পারে তবে সেও তো তার স্বামীর জীবনে হয়ে যাবে শীতের পাখি। আগেও এ শহরে সে শীতের পাখি ছিল। অনিশ্চয়তা আর সব হারানোর ভয়ে সে ভেতরে ভেতরে কাঁপতে থাকে। একদিন স্বামী খুব শখ করে তাকে নিয়ে বেড়াতে বের হয়। তার পা চলে না, মাথাব্যথা করে, যেদিকে তাকায় যাকে দেখে তাকেই তার ক্লায়েন্ট মনে হয়।
গার্মেন্টসের মেয়েদের জীবনের এই দুঃখের আখ্যান আমাদের সবারই কমবেশি জানা। বিয়ে হলেও তারা যে মানসিক একটা অনিশ্চয়তায় থাকে এটাও সত্য। গল্পটা ভালো। বাস্তব। অনুপুঙ্খ বর্ণনা আছে।
লেখক চেনাজীবনের গল্পই বলেছেন। চেনাজীবনটাই আমরা অনেক সময় চিনতে পারি না, আধেক দেখি বা দেখি না। লেখক সেটা দেখিয়েছেন। আমাদের চেনা আর পরিচিত গল্প, চারপাশের মানুষের গল্প পড়তে ভালো লাগে তার ভাষার গতিশীলতার জন্য। তিনি চেনা গল্পকে নতুন করে চোখের সামনে মেলে ধরলেন বলে সাধুবাদ জানাই। নূর কামরুন নাহার লেখায় একনিষ্ঠ থেকে এগিয়ে যাবেন, সাহিত্যরাজ্যে নিজস্ব একটি স্থান করে নেবেন এই আশা রাখি।