বিচারের আগে মিডিয়া ট্রায়ালের ভয়াল সংস্কৃতি
প্রকাশ | ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
আশ্চর্য্য হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে বিভিন্ন ঘটনায় গ্রেপ্তার করার পরে নারী ও পুরুষদের প্রায়শই গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো। সেখানে জব্দ করা জিনিসপত্র সাজিয়ে গণমাধ্যমের সামনে এমনভাবে তাদের উপস্থাপন করা হয় ও বর্ণনা তুলে ধরা হয়, যাতে বিচারের আগেই তারা জনমনে দোষী বলে চিহ্নিত হয়ে যান। অনেকের ক্ষেত্রে নানারকম আপত্তিকর বিশেষণও ব্যবহার করা হয়। এরকম কর্মকান্ড বন্ধ করার বিষয়ে ২০১২ সালে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ। তারপরেও সেটি বন্ধ হয়নি। এমনকি ভ্রূক্ষেপও করছেন না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও মিডিয়াগুলো। অথচ ফৌজদারি আইনের খুবই বেসিক ভাষ্য হচ্ছে, সাক্ষী প্রমাণ দ্বারা আসামি দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে নির্দোষ ধরে নিতে হবে।
সম্প্রতি সারাদেশে আলোচিত বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় গৃহবধূ উম্মে সালমাকে হত্যার পর ডিপ ফ্রিজে রাখার ঘটনায় এর আগের্ যাব-১২ ব্রিফিংয়ে বলেছিল, ছেলেই তার মা'কে হত্যা করে ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই ঘটনাটি মোড় নেয় অন্যদিকে। তদন্তে পুলিশ বলছে, ভাড়াটিয়া মহিলার অনৈতিক কাজে বাধা ও তাকে বাসা ছেড়ে যেতে বলায় খুন হন গৃহ মালিক উম্মে সালমা। মজার সংবাদ এই যে, এই জাতীয় মিডিয়া ট্রায়ালে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির কোনো বক্তব্য মিডিয়া তুলে ধরছেন না। অথচ নির্দোষী ব্যক্তির যে ক্ষতি হওয়ার দরকার সেটি হয়ে যাচ্ছে- যা কখনো আর পূরণযোগ্য নয়।
বাংলাদেশে আলোচিত সব ঘটনাতেই সন্দেহভাজনদের আটকের পর সরাসরি গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন বা তাদের ছবি, পরিচয় প্রচার করা অনেকটা নিয়মিত হলুদ সাংবাদিকতার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ঘটনা ওই ব্যক্তিদের জন্য শুধু মানহানিকর নয়, মানবাধিকারের লঙ্ঘনও বটে। কারণ পরবর্তী সময়ে তিনি যদি দোষী প্রমাণিত না হন, তাহলে তার প্রতি মিডিয়া ট্রায়ালে যে অন্যায়টা করে ফেলা হচ্ছে, সেটার দায়ভার কী মিডিয়া নেবে?
মানুষের জীবন, স্বাধীনতা, হে, সুনাম এবং সম্পত্তির ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং আইনগত সুরক্ষার লক্ষ্যে নাগরিকের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুখ্য উদ্দেশ্যে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভুল তদন্তের কারণে একজন মানুষকে কি পরিমাণ হয়রানি ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয় তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বুঝবেন না।
অন্যদিকে, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০-এর ১৪ ধারা অনুযায়ী কোন ভিক্টিমের নাম, পরিচয়, ছবি প্রচার না করার ব্যাপারে এবং শিশু আইনের ২৮ ধারা অনুযায়ী কোনো শিশুর পরিচয় প্রকাশ না করার ব্যাপারে বিধি-নিষেধ রয়েছে।
সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই যদি মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে থাকে তাহলে ওই মামলায় বিচারকার্য অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। আবার সাক্ষ্য আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তির কোনো অইনগত ভিত্তি নেই।
মিডিয়া ট্রায়ালে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(১) অনুযায়ী অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না থাকায় শুধুমাত্র 'মিডিয়া ট্রায়াল' আবেগ দিয়ে কিংবা নিজেরে সফলতার সংবাদ প্রচার করায় সাধারণ জনগণ নিজেকে বিচারক ভেবে যে যার মতো করে মন্তব্য করে চলেছে।
অন্যদিকে, গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হলেও স্বাধীনতার বিষয়ে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে উলেস্নখ রয়েছে। যা সাংবাদিক-সম্পাদককে ভালোভাবে পাঠ করে আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থপ্রণেতা।
\হংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স