আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গুরুত্বপূর্ণ রায় দিল। তবে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (এএমইউ) সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিনা, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট এদিন কোনো রায় দেননি। তারা জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন তিন বিচারপতির একটি আলাদা বেঞ্চ। তবে, সুপ্রিম কোর্টের রায় থেকে এটা স্পষ্ট হলো, এএমইউ-এর সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে আইনি অসুবিধা নেই।
সাত বিচারপতির বেঞ্চ অবশ্য বিষয়টি নিয়ে একমত হয়নি। প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে চার বিচারপতি এই রায়ের পক্ষে ছিলেন। আর বিপক্ষে ছিলেন তিন বিচারপতি। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের মতামত গৃহীত হয়েছে। শুক্রবারই ছিল প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের অবসর নেওয়ার আগে শেষ কাজের দিন।
এর আগে, সুপ্রিম কোর্ট ১৯৬৭ সালে আজিজ ভাষা মামলার রায়ে বলেছিল, কেন্দ্রীয় আইনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পেতে পারে না।
যা নিয়ে বিরোধ
গত ৫০ বছরের বশি সময় ধরে এএমইউ সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পেতে পারে কিনা, সেই বিষয়ে বিতর্ক চলছে। ১৯৬৭ সালের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, এএমইউ সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান নয়, কারণ, তা কেন্দ্রীয় সরকারের ১৯২০ সালের এএমইউ অ্যাক্ট অনুসারে গঠিত হয়েছে।
এরপর ১৯৫১ ও ১৯৬৫ সালের এএমইউ-র প্রতিষ্ঠা আইনকে সংশোধন করা হয়। প্রশাসনিক কাঠামোরও পরিবর্তন হয়। অ-মুসলিমদের এএমইউ-র প্রশাসনে নেয়া হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতিকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটর করা হয়।
প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার ১৯৮১ সালে এএমইউ আইনের সংশোধন করে। সেখানে বলা হয়, এই বিশ্ববিদ্যালয় মুসলিম সম্প্রদায় তাদের সংস্কৃতি ও শিক্ষাগত লক্ষ্য সম্পূর্ণ করার জন্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু ২০০৬ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এই সংশোধন খারিজ করে দেয়। তারা বলে, এএমইউ-র পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল প্রোগ্রামে মুসলিমদের জন্য ৫০ শতাংশ সংরক্ষণও থাকবে না। সুপ্রিম কোর্টের ১৯৬৭ সালের রায়কে সামনে রেখে হাইকোর্ট এই রায় দিয়েছিল।
শুক্রবারের রায়
শুক্রবার সাত বিচারপতির বেঞ্চে ৪-৩ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে যে রায় দিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনে সংখ্যালঘু ছাড়া অন্য প্রতিনিধিরা থাকলে এটা বলা যাবে না যে, এই প্রতিষ্ঠানকে সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দেয়া যাবে না। সংসদের আইনে ওই প্রতিষ্ঠান করা হলেও এই কথা বলা যাবে না।
বলা হয়েছে, যদি সংখ্যালঘুরা কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন, তাতে যদি সংখ্যালঘুরা পরিচালকের পদে নাও থাকেন, তাহলেও তা সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেতে পারে। তাই সরকার আইন করে কোনো প্রতিষ্ঠান করার অর্থ এই নয় যে, সেটা সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পাবে না।
প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়, বিচারপতি সঞ্জীব খান্না, বিচারপতি সূর্য কান্ত ও বিচারপতি জেবি পাদরিওয়ালা এই রায়ের পক্ষে ছিলেন। তারা বলেছেন, যদি কোনো প্রতিষ্ঠান সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে তৈরি হয়, তাহলে সংবিধানের ৩০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে তা সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেতে পারে। এর বিরোধিতা করেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত, বিচারপতি মনোজ মিশ্র ও বিচারপতি এসসি শর্মা।
সংখ্যালঘুর স্বীকৃতির তাৎপর্য
কোনো প্রতিষ্ঠান সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পেলে তারা ৫০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী সংখ্যালঘুদের মধ্যে থেকে নিতে পারে। ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলিত, জনজাতি, অনগ্রসর, আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষ চাকরি ও পড়ার ক্ষেত্রে কোনো সংরক্ষণের সুবিধা পান না।
কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান
শুনানি চলার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়, তারা এএমইউ-র সংখ্যালঘু স্বীকৃতির বিরুদ্ধে। বলা হয়েছিল, এই ধরনের স্বীকৃতি পেলে তা ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের বিরোধী হবে। কেন্দ্রের মতে এই স্বীকৃতি পাওয়ার অর্থ, বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তন। তাহলে অন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এএমইউ আলাদা হয়ে যাবে।
কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য ছিল, এএমইউ হলো জাতীয় প্রতিষ্ঠান। তাদের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রেখে দেশের বৃহত্তর স্বার্থরক্ষা করা উচিত।
এরপর কী হবে?
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে এবার তিন বিচারপতির বেঞ্চ গঠিত হবে। তারা খতিয়ে দেখবে এএমইউ-কে সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দেয়া হবে কিনা। তারা দেখবে, সংবিধানের ৩০ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে তারা এই স্বীকৃতি পেতে পারে কিনা।
রায়ের প্রতিক্রিয়া
এআইএমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি টুইট করে বলেছেন, 'ভারতের মুসলিমদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। সংখ্যালঘুদের নিজেদের শিক্ষিত হওয়ার অধিকার স্বীকৃত হলো। বিজেপি-র যাবতীয় যুক্তি খারিজ করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। মোদি সরকারের উচিত, এই রায়কে ঠিকভাবে গ্রহণ করা। একজন পড়ুয়ার জন্য জামিয়া মিলিয়াতে খরচ করা হয় তিন লাখ টাকা, এএমইউতে তিন লাখ ৯০ হাজার টাকা, আর বিএইচইউ-তে ছয় লাখ ১৫ হাজার টাকা।'
কংগ্রেস নেত্রী শামা মোহাম্মদ বলেছেন, 'ওরা এএমইউ-র কাছ থেকে সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি ছিনিয়ে নিতে গেছিল। পরবর্তী রায় না আসা পর্যন্ত এএমইউ-র সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি বহাল থাকছে।'
এএমইউ-র উপাচার্য নাইমা খাতুন বলেছেন, 'আমরা সুপ্রিম কোর্টের রায়কে সম্মান করি। আমরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করব।'