বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও জনবান্ধব করতে ইয়াং জাজেস ফর জুডিশিয়াল রিফর্মের ১২ দফা সংস্কার প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৪ আগস্ট সংগঠনটির উপদেষ্টা ও সমন্বয়ক কমিটির যৌথ সভায় এই প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়।
১২ দফা সংস্কার প্রস্তাবগুলো হলো-
১. জেলা পর্যায়ের আদালতগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক 'সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়' গঠন এবং মাসদার হোসেন মামলার সব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
২. বিচার বিভাগের সামগ্রিক আর্থিক স্বাধীনতা এবং প্রত্যেক আদালতের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য বিচার বিভাগের বাজেট সংক্রান্ত বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করার পাশাপাশি প্রত্যেক আদালতের অনুকূলে পৃথক বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে।
৩. বিচারকদের পদায়ন ও বদলি সংক্রান্তে একটি ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
৪. বিভিন্ন আইনে উলিস্নখিত আদালত ও ট্রাইবু্যনালগুলোর জন্য বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীর পদসহ পৃথক আদালত সৃজন করতে হবে এবং দেশের জনসংখ্যা ও মামলার সংখ্যা অনুপাতে বিচারকদের সংখ্যা যুক্তিসঙ্গত হারে বৃদ্ধি করতে হবে।
৫. বিচারকদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা বৃদ্ধিসহ পৃথক আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং বিচারিক কর্মঘণ্টার পূর্ণ ব্যবহারে এজলাস সংকট নিরসনে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাযুক্ত অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে।
৬. পর্যাপ্ত সংখ্যক দক্ষ সহায়ক কর্মচারী নিয়োগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জেলা পর্যায়ের আদালতগুলোর ২য়/৩য় শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়োগ বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের আওতায় আনতে হবে।
৭. উচ্চ আদালত ও জেলা আদালতে সরকারি মামলা পরিচালনায় শৃঙ্খলা আনয়ন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রবর্তন করতে হবে এবং জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সরকারি আইন কর্মকর্তা (জিপি/পিপি) নিয়োগ প্রদান করতে হবে।
৮. বিদ্যমান মামলা-জট নিরসন ও মামলা দ্রম্নত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধিসহ সংশ্লিষ্ট আইনগুলোতে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনয়ন করতে হবে?
৯. স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রম্নত নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নিতে হবে।
১০. ফৌজদারি মামলায় স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত, কম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির স্বার্থে বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণে বিশেষায়িত তদন্তকারী সংস্থা এবং আদালত ও বিচারকদের নিরাপত্তাসহ আদালতের আদেশ কার্যকর করার উদ্দেশ্যে বিচার বিভাগের অধীনে বিশেষ ফোর্স গঠন করতে হবে।
১১. ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার সহজীকরণ ও জনসাধারণের দোরগোড়ায় বিচারিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলার জন্য পৃথক পৃথক আদালত নিশ্চিত করতে হবে এবং নতুন উপজেলা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় সুবিধাসহ একটি করে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপন করতে হবে।
১২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা সমুন্নত রাখা এবং বিচারকদের বক্তব্য ও দাবি দাওয়া নিয়মতান্ত্রিকভাবে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনকে সংস্কার করে সব বিচারকের জন্য উন্মুক্ত, গণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
বিচার বিভাগের পুনর্গঠন ও সংস্কারে সাবেক বিচারকদের প্রস্তাবনা
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বাগত ও অভিনন্দন জানিয়ে বিচার বিভাগের পুনর্গঠন ও সংস্কারের লক্ষ্যে ১২ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছে সাবেক বিচারকরা। তারা মাসদার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন চেয়েছেন।
'অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ফোরাম' নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ ফিরোজ আলম এই প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।
এতে সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান রেজিস্ট্রার জেনারেলসহ সব বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের এবং আইন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আওয়ামী সরকারের সহযোগী বিশেষ করে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম সারোয়ার, যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহা ও শেখ গোলাম মাহবুব, মাহাবুবুর রহমান সরকার (বর্তমানে জেলা জজ, নরসিংদী), এ এইচ এম হাবিবুর রহমান জিন্নাহ (সদস্য, যুদ্ধ অপরাধ ট্রাইবু্যনাল), শহিদুল আলম ঝিনুক (তথ্য কমিশনার ও সাবেক আইজিআর)-সহ সংশ্লিষ্ট অন্য সব কর্মকর্তাকে অবিলম্বে অপসারণ করে সৎ, যোগ্য ও নিরপেক্ষ কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদান এবং ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করার দাবি জানানো হয়।
সাবেক বিচারকদের ১০ দফা প্রস্তাবনা নিম্নরূপ:
১। বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত ও দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনের সংশোধন আনয়ন।
২। বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচারকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ প্রদান।
৩। বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতিসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার নীতিমালা প্রণয়ন ও অন্যান্য কার্যাদি সম্পন্ন করার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় গঠন।
৪। মাসদার হোসেন মামলায় প্রদত্ত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়নকরণ।
৫। সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নকরণ।
৬। যে সব বিচারক আচরণবিধি লঙ্ঘন করে স্বৈরাচারী সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য প্রকাশ্যে সরকারকে সমর্থন করে ন্যায়বিচারের পরিপন্থি কাজ করেছে; জামিনযোগ্য মামলায় জামিন না দিয়ে শত সহস্র নিষ্পাপ মানুষকে কারাগারে পাঠিয়েছে; রিমান্ড আদেশ দিয়ে হয়রানি ও নির্যাতনের সুযোগ করে দিয়েছে। ফরমাইশি রায় দিয়ে শাস্তি দিয়েছে। চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ।
৭। বিচারিক আদালতের সব স্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে কাজ করা বিচারকদের বদলি করে তদস্থলে সৎ ও নিরপেক্ষ বিচারকদের পদায়নকরণ।
৮। চুক্তিভিক্তিক নিয়োগকৃত সব বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করে তদস্থলে যোগ্য ও নিরপেক্ষ অবসর প্রাপ্ত বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তাদের নিয়োগ প্রদান করণ।
৯। ভবিষ্যৎ স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা বিলুপ্তি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সংবিধানের আমূল সংস্করণ আনয়নের দাবি জানাচ্ছি।
১০। অবসরপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা দেশ ও জাতির এহেন ক্রান্তিলগ্নে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও প্রধান বিচারপতি মহোদয়কে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতে ইচ্ছুক। বর্তমান সরকার যদি প্রয়োজন মনে করেন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারকদের প্রতি যদি কোনো দায়িত্ব অর্পণ করেন তবে তারা ওই দায়িত্বসমূহ আন্তরিকতার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে সম্মত আছেন।