বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

অবাধ্য সন্তানকে ত্যাজ্য করার আইনি ভিত্তি কতটুকু?

করিম ও রুনা একে অপরকে ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসাকে বাস্তবে রূপ দিতে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। সাবালক-সাবালিকা হিসেবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও আইনগত অধিকার তাদের আছে। সেই অধিকারের ভিত্তিতে তারা স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় উভয় পরিবারের পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন। উভয় পরিবারই তাদের ওপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ত্যাজ্য পুত্র-কন্যা হিসেবে সব সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘোষণা দেন
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
অবাধ্য সন্তানকে ত্যাজ্য করার আইনি ভিত্তি কতটুকু?

অনেক সময় পিতামাতা রাগের বশবতী হয়ে পুত্র কিংবা কন্যাকে ত্যাজ্য করার ঘোষণা দেন কিংবা সহায় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার ঘোষণা দেন। কিন্তু আইনে ত্যাজ্য বলে কিছুই নেই। এটি নিছক একটি ভ্রান্ত ধারণা এবং লোকমুখে প্রচলিত একটি শব্দ মাত্র।

করিম ও রুনা একে অপরকে ভালোবাসে। তাদের ভালোবাসাকে বাস্তবে রূপ দিতে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। সাবালক-সাবালিকা হিসেবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও আইনগত অধিকার তাদের আছে। সেই অধিকারের ভিত্তিতে তারা স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় উভয় পরিবারের পিতামাতা, আত্মীয়স্বজন। উভয় পরিবারই তাদের ওপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ত্যাজ্য পুত্র-কন্যা হিসেবে সব সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘোষণা দেন।

এটা আমাদের সমাজের একটি পরিচিত ঘটনা। অনেকে হলফনামার মাধ্যমে নোটারি পাবলিকের সামনে সন্তানকে ত্যাজ্য বলে ঘোষণা দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না।

মুসলিম পারিবারিক আইনে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া আছে- কে কতটুকু সম্পত্তি পাবেন। মুসলিম সন্তান পরিবারের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার অর্জন করেন এবং এ অধিকার থেকে তাকে কোনোভাবেই বঞ্চিত করা যায় না। তবে কোনো মা-বাবা দান, উইল বা বিক্রয়ের মাধ্যমে তাঁদের সম্পত্তি যে কারও কাছে হস্তান্তর করতে পারেন। এখানে মনে রাখতে হবে মুসলিম আইনে উইলের দ্বারা এক-তৃতীয়াংশের বেশি হস্তান্তর করা যায় না।

তবে এ উইল ওই ব্যক্তির মৃতু্যর পর তা কার্যকর হয়। জীবিতকালে কোনো মা-বাবা তাদের সম্পত্তি অন্য কাউকে যথাযথ উপায়ে দান না করে গেলে কিংবা বিক্রয় করে না গেলে মৃতু্যর পর তাদের সন্তানরা অবধারিতভাবেই উত্তরাধিকারী হিসেবে সেই রেখে যাওয়া সম্পত্তির অংশীদার হবেন। যতই ত্যাজ্য ঘোষণা দেওয়া হোক না কেন।

কাজেই যে কোনো দলিল সম্পাদন কিংবা হলফনামার মাধ্যমে ত্যাজ্য করার ঘোষণা আইনের চোখে অচল এবং আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করার সুযোগ নেই। যদি এমন হয় যে, বাবা-মা ত্যাজ্যপুত্র বলে সন্তানদের ঘোষণা দিয়ে গেছেন এবং এ জন্য অন্য অংশীদাররা তাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করছেন তাহলে সন্তানরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। এক্ষেত্রে ১৮৯৩ সালের বাঁটোয়ারা আইনে ৫০০ টাকা কোর্ট ফি দিয়ে দেওয়ানি আদালতে বাঁটোয়ারা মামলা করা যায়। কোনো বাবা-মা যদি তাদের অবাধ্য সন্তানকে কোনো সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে চান তাহলে জীবিতাবস্থায় ওই সম্পত্তি অন্য কাউকে দান করে কিংবা বিক্রি করে সম্পত্তির দখল ছেড়ে দিয়ে যেতে হবে।

মনে রাখতে হবে, যেটুকু সম্পত্তিই বাবা-মা নিজের নামে রেখে যান না কেন তাদের মৃতু্যর পর তার বৈধ উত্তরাধিকারীরা এ সম্পত্তির অংশীদার হবেন। তবে নরহত্যাজনিত অপরাধে অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত বা ভুলবশত কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করলে সে ব্যক্তি সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে এবং যদি সে ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করে তাতেও সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।

পাশাপশি হিন্দু আইনে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। ধর্মান্তরিত হওয়া, দুশ্চরিত্র হলে, শারীরিক বা মানসিকভাবে অসমর্থ হলে, হত্যাকারী হলে, সন্ন্যাসী হলে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। অপরদিকে, মুসলিম আইনের বিধানে শুধু নরহত্যা ও ধর্মান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

আইনগ্রন্থ প্রণেতা।

ইমেইলঃ ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে