একদিকে 'ফ্যাসিস্ট তকমা' অন্যদিকে পুনর্বাসনের চেষ্টা!

প্রকাশ | ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর
'ফ্যাসিস্ট তকমা' দিয়ে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে (যবিপ্রবি) অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি আওয়ামীপন্থি অভিযোগে তিন শিক্ষক-কর্মকর্তাকে সাময়িক বহিষ্কারের পর ক্যাম্পাসে দু'পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এরপর ক্যাম্পাসে অনুমতি ছাড়া সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলেও 'প্রো-ভিসি নিয়োগ নিয়ে' মাঠে নেমেছে শিক্ষার্থীদের একাংশ। তাদের দাবি, আওয়ামীপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক ড. এ এফ এম সাইফুল ইসলামকে যবিপ্রবি'র প্রো-ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এর প্রতিবাদে তারা নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যপক্ষের দাবি, ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলনের নামে কাউকে ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে; আবার কাউকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। আর নেপথ্যে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি চক্র ক্যাম্পাস অশান্ত করার ষড়যন্ত্র করছে। যবিপ্রবি সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, গত ৬ ফেব্রম্নয়ারি যবিপ্রবি রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. আহসান হাবীব স্বাক্ষরিত পৃথক তিনটি অফিস আদেশে দুজন অধ্যাপক ও একজন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরা হলেন, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল কবীর জাহিদ, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গালিব এবং ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের রিসার্চ অফিসার (চলতি দায়িত্ব) ও টেকনিক্যাল অফিসার মো. হেলালুল ইসলাম। পৃথক অফিস আদেশে বলা হয়, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল কবির জাহিদ ও কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়াদ মো. গালিবের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে দুর্নীতি ও অসদাচরণের গুরুতর অভিযোগ থাকায় গত ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত রিজেন্ট বোর্ডের ১০৪তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যবিপ্রবি শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সাধারণ আচরণ, শৃঙ্খলা ও আপিল সংক্রান্ত ধারা মোতাবেক শাস্তি আরোপের ভিত্তি থাকায় বিধি-১৫(১) অনুযায়ী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হলো। অপর অফিস আদেশে বলা হয়, যবিপ্রবির শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সাধারণ আচরণ, শৃঙ্খলা ও আপিল সংক্রাস্ত বিধি মোতাবেক মো. হেলালুল ইসলামকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হলো। প্রসঙ্গত, এর আগে অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গালিব মুন্সী মো. মেহেরুলস্নাহ হলের প্রভোস্ট, রিজেন্ট বোর্ড সদস্য, নীল দলের প্যানেলে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন করেন। এরপর ২০২২ সালে সহসভাপতি ও ২০২৩ সালে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি যবিপ্রবির প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন-এর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অধ্যাপক ড. মো. ইকবাল কবির জাহিদ ২০১৯ ও ২০২৪ সালে দুই মেয়াদে শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের ডিন এবং জীববিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষদের ডিন ছিলেন। এছাড়াও তিনি যবিপ্রবি নীল দলের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অপরদিকে ২০২২ সালে টেকনিক্যাল অফিসার হেলালুল ইসলাম যবিপ্রবি কর্মকর্তা সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি যশোর জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের ও যশোর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এদিকে, এই বহিষ্কারাদেশের পর ৭ ফেব্রম্নয়ারি রাতে যবিপ্রবিতে দু'পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ৮ জন শিক্ষার্থী আহত হন। দু'পক্ষকে থামাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন প্রক্টর। এ ঘটনা নিয়ে ৮ ফেব্রম্নয়ারি সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যশোর জেলা কমিটির যুগ্ম আহবায়ক ও কেমি প্রকৌশলী বিভাগের শিক্ষার্থী সাদেকা শাহানী উর্মি বলেন, অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গালিবকে বহিস্কারের সূত্র করে ক্যাম্পাসে মারামারি হয়েছে। ওই বিভাগের শিক্ষার্থীরা ধারণা করছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে অধ্যাপক ড. গালিবকে বহিস্কার করা হয়েছে। ফ্যাসিস্টের দোসররা ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে ক্যাম্পাসে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। অন্যদিকে, পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এ কে এম এস লিমন বলেন, অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গালিব স্যারের বহিস্কারের বিষয়টি প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এজন্য বিভাগের পক্ষ থেকে আমরা প্রতিবাদ করেছি। আমরা বলেছি, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তদন্তের ভিত্তিতে দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আমরা ড. গালিব স্যারের বহিস্কারের প্রতিবাদ করায় আমাদের ওপর তারা ক্ষুব্ধ ছিল। স্বৈরাচারের দোসরের সঙ্গে আমাদের আপস নেই। আমরাও স্বৈরাচারের দোসরের বিচার চাই।' এ ঘটনার পর ক্যাম্পাসে অনুমতি ছাড়া সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ওই ঘটনার পর গত ১২ ফেব্রম্নয়ারি রাতে ফের আন্দোলনে নামেন যবিপ্রবি শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক ড. এ এফ এম সাইফুল ইসলামকে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি বানানোর চেষ্টা চলছে। ১৩ ফেব্রম্নয়ারি সংবাদ সম্মেলনে যবিপ্রবি শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান ইমরান দাবি করেন, ড. এ এফ এম সাইফুল ইসলাম পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দোসর হিসেবে পরিচিত চাকরিচু্যত সাবেক সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুমের স্বামী। তিনি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন 'গণতান্ত্রিক শিক্ষক পরিষদের' নেতা ছিলেন। স্বৈরাচারের দোসরকে যবিপ্রবিতে নিয়ে আসলে ক্যাম্পাস অচল করে দেওয়ার হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে, যবিপ্রবি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ক্যাম্পাসে একদিকে আওয়ামীপন্থিদের একাংশকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে নানাধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে, কাউকে কাউকে পুনর্বাসনও করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধু পরিষদ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা প্রফেসর ড. এইচএম জাকির হোসেনকে রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য করা হয়েছে; অধ্যাপক ড. মিনহাজ উদ্দিন মনির রিসার্চ সেলের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন। প্রফেসর ড. মীর মোশাররফ হোসেন ছাত্র উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনকালে 'রাজনীতি নিষিদ্ধ' ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তাকে আবারও একই দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত প্রকৌশলী ড. আমজাদ হোসেনকে প্রক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, আওয়ামীপন্থি বা ফ্যাসিস্ট নিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি বা আন্দোলনের নেপথ্যে বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি চক্র ভূমিকা রাখছে। চক্রটি নানা উপায়ে ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল রেখে তাদের ফায়দা হাসিল করতে চায়। তবে আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান ইমরান দাবি করেছেন, বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে যারা রাজনীতিকে ব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছেন। আন্দোলনের নেপথ্যে কারো কোনো ভূমিকা নেই। ক্যাম্পাসেও যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তাদের। এ ব্যাপারে রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য প্রধান প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্ব থাকা প্রফেসর ড. এইচএম জাকির হোসেন জানিয়েছেন, আন্দোলনের নেপথ্যে কারা আছে তা জানা নেই। আর অভিযোগের ব্যাপার তিনি খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে যবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল মজিদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৫ বছরের জঞ্জাল রয়েছে। একদিনে তা পরিষ্কার করা সম্ভব নয়। প্রো-ভিসি নিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে। তবে তারা ক্যাম্পাসের বাইরে কর্মসূচি করেছে।