মঙ্গলবার মেলার দশম দিনে স্টলগুলোতে পছন্দের বই দেখছেন ক্রেতারা -ফোকাস বাংলা
ভাষার মাস ফেব্রম্নয়ারির দশ দিন পেরুতেই জমে উঠেছে অমর একুশে বইমেলা। মঙ্গলবার মেলার শুরু থেকেই ক্রেতা-দর্শনার্থীর ভিড় বাড়তে থাকে। সন্ধ্যায় দর্শনার্থী পূর্ণ মেলায় বিক্রিও ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। এদিকে, সোমবার সন্ধ্যার পর বইমেলার একটি স্টলে বাগবিতন্ডা-হট্টগোলের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ ধরনের বিশৃঙ্খল আচরণ বাংলাদেশে নাগরিকের অধিকার এবং দেশের আইন উভয়ের প্রতিই অবজ্ঞা প্রদর্শন বলে এক বিবৃতিতে উলেস্নখ করেছেন তিনি। ওই ঘটনায় বাংলা একাডেমি গঠন করেছে তদন্ত কমিটি। অন্যদিকে, 'বইমেলায় আক্রমণ মতপ্রকাশের ওপর আঘাত' উলেস্নখ করে ১২৪ লেখক-শিল্পী-অধিকারকর্মীর বিবৃতি দিয়েছেন। আর ১১তম দিনে বইমেলায় ৯১টি বই প্রকাশিত হয়েছে বলে বাংলা একাডেমির নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
মঙ্গলবার যথারীতি বেলা তিনটায় খুলে দেওয়া হয় বইমেলার দুয়ার। চলে রাত নয়টা পর্যন্ত। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে গত কয়েকদিন ঢাকার শাহবাগ এলাকা উত্তাল থাকলেও এদিন ছিল ব্যতিক্রম। বিক্রেতারা বলছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় পাঠক ছুটেছেন প্রাণের বইমেলার দিকে। এদিন শুরু থেকেই পাঠকের সমাগম বাড়ে। অনেকে বই কিনেছেন।
এ বিষয়ে অনুভব প্রকাশনীর প্রকাশক তুষার প্রসূন বলেন, 'গত কয়েকদিনের তুলনায় বিক্রি বেড়েছে। আশা করছি, পহেলা ফাল্গুন থেকেই জমজমাট বেচাকেনা শুরু হবে।'
প্রধান উপদেষ্টার বিবৃতি
এদিকে বইমেলার একটি স্টলে বাগবিতন্ডা-হট্টগোলের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একুশে বইমেলা এদেশের লেখক ও পাঠকদের প্রাণের মেলা। এদেশের সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, চিন্তক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সকল শ্রেণি-পেশা-বয়সের মানুষের মিলনস্থল। বইমেলায় এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা বাংলাদেশের উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক চর্চাকে ক্ষুণ্ন করে, ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের মর্যাদার প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করে।
অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ এবং বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে ঘটনাটি তদন্ত করে দোষীদের বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছে জানিয়ে মেলায় নিরাপত্তা জোরদার করতে এবং এই তাৎপর্যপূর্ণ স্থানে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তা নিশ্চিত করতে পুলিশকে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে।
স্টলে হট্টগোলের ঘটনায় তদন্ত কমিটি
এদিকে, বইমেলায় 'সব্যসাচী' স্টলে তসলিমা নাসরিনের বই রাখা নিয়ে বাগ্?বিতন্ডা ও হট্টগোলের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
বাংলা একাডেমির
সচিব ও বইমেলা টাস্কফোর্স কমিটির প্রধান সেলিম রেজা মঙ্গলবার এ কথা জানান। তিনি বলেন, 'গতকালের (সোমবার) ঘটনায় বাংলা একাডেমির পরিচালক মোহাম্মদ হারুন রশিদকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
সোমবার সন্ধ্যায় বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে থাকা 'সব্যসাচী' স্টলে ওই হট্টগোলের ঘটনা ঘটে। পরে ওই স্টল বন্ধ করে দেয় পুলিশ। স্টলটি বন্ধ রয়েছে উলেস্নখ করে বইমেলা টাস্কফোর্স কমিটির প্রধান বলেন, 'বাংলা একাডেমি স্টল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়নি। আইনশৃঙ্খলার স্বার্থে পুলিশ আপাতত স্টল বন্ধ করেছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর স্টলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে একাডেমি।'
বইমেলায় আক্রমণ মতপ্রকাশের ওপর আঘাত
'হামলা ও বাধার ঘটনাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং ধারাবাহিক সহিংসতার অংশ। বইমেলায় যে আক্রমণ হয়েছে, তা মতপ্রকাশের ওপর আঘাত' উলেস্নখ করে দেশের ১২৪ জন লেখক-শিল্পী-অধিকারকর্মী এক বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তারা মেলার নিরাপত্তা জোরদার করা ও আক্রমণকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার গণমাধ্যমে ওই বিবৃতি পাঠানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'ফেসবুকে আগাম হুমকি দিয়ে সোমবার সব্যসাচী স্টলে হামলা চালানো হয়েছে। এই মব (দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা) আক্রমণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর আঘাত। এই মবগোষ্ঠী দেশের জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী।'
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'এই আক্রমণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০০৪ সালে লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর নৃশংস হামলা, ২০১৫ সালে লেখক অভিজিৎ রায় এবং প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যাকান্ড থেকে সম্প্রতি মাজার ভাঙা, নারীদের ফুটবল খেলতে বাধা দেওয়া, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের সময় বেঁধে দেওয়া একই ধরনের সহিংসতার ধারাবাহিকতার অংশ। বিশেষত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ভিন্ন চিন্তা ও বৈশিষ্ট্যের মানুষদের হত্যার ক্ষেত্রে প্রথমে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রচারণা ও সম্মতি উৎপাদন; পরবর্তী সময়ে সরকারের নিষ্িক্রয়তা ও পরোক্ষ মদদে এসব হত্যার ঘটনা ঘটেছে। জুলাই অভু্যত্থানের পরবর্তী সময়েও একইভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন হতে দেখা যাচ্ছে।'
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, নৃবিজ্ঞানী নাসরিন খন্দকার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম সারওয়ার, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষক লাবনী আশরাফি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাসউদ ইমরান, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ, লেখক ও গবেষক কলেস্নাল মোস্তফা, আইনজীবী মানজুর আল মতিন, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হারুন উর রশীদ প্রমুখ।
অন্যদিকে বাংলা একাডেমির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়ছে মঙ্গলবার মেলায় নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে ৯১টি। বিকালে মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে 'আদর্শায়িত কল্পলোক ও শাহেদ আলীর দ্বিধাচিত্ত মন' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিবলী আজাদ। আলোচনায় অংশ নেন মোস্তাক আহমাদ দীন। সভাপতিত্ব করেন চঞ্চল কুমার বোস।
এদিন লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন- নাসির আলী মামুন এবং মামুন সারওয়ার।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেন কবি মুস্তাফা মজিদ। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী শফিকুল ইসলাম বাহার এবং আনজুমান আরা। আজ ছিল সালমা মাহবুবের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন 'বাংলাদেশ সোসাইটি ফর দ্যা চেঞ্জ এন্ড অ্যাডভোকেসি নেক্সাস (বি-স্ক্যান)'-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী মো. সালমান, মাহমুনুল হক সিদ্দিক, জাকির হোসেন আখের, সঞ্জয় কুমার দাস, শরণ বড়ুয়া, শ্রাবন্তী আক্তার জেরিন, নুরুন্নাহার হায়াত এবং মো. শাহীনুর ইসলাম।
আজ বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে 'গণ-অভু্যত্থান ২০২৪-এর কবিতা' শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন হাসান রোবায়েত। আলোচনায় অংশ নেবেন মঈন জালাল চৌধুরী এবং আশফাক নিপুন। সভাপতিত্ব করবেন ফরহাদ মজহার।
