পহেলা ফাল্গুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস

যশোর ও ঝিনাইদহে শত কোটি টাকার ফুল বেচাকেনার প্রস্তুতি

প্রকাশ | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০

মিলন রহমান, যশোর ও তারেক মাহমুদ, ঝিনাইদহ
ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালি এবং ঝিনাইদহের ফুলচাষীদের এখন দম ফেলবার ফুসরত নেই। আসন্ন পহেলা বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস ঘিরে দুই জেলায় শত কোটি টাকার ফুল বিক্রির আশা করছেন চাষীরা। যশোরের গদখালীর ফুল চাষীরা এখন ক্ষেত ও ফুলের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রকৃতিতে গরমের আভাস থাকায় গোলাপের প্রস্ফুটন বিলম্বিত করতে গোলাপ-কলিতে পরানো হচ্ছে ক্যাপ। দামও বাড়তে শুরু করেছে গোলাপের। বাজার জমে উঠছে ধীরে ধীরে। গদখালি ফুলের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সাইকেল-ভ্যানে বাহারি ফুল নিয়ে বাজারে এসেছেন চাষিরা। তাদের কারও কাছে গোলাপ, গস্নাডিওলাস, রজনীগন্ধা; কারও কাছে জারবেরা, চন্দ্রমলিস্নকাসহ বাহারি সব ফুল। দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যাপারীরা সেই ফুল কিনছেন। ফুলবেচাকেনার এমন হাকডাক যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের সড়ক ঘেঁষে গড়ে উঠা ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালিতে। হঠাৎ গরম পড়ায় ফুল ফুটে যাওয়া বাজারে ফুলের জোগানও বেশি। গস্নাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জারবেরা, চন্দ্র মলিস্নকা, গাঁদা ফুলের দাম কিছুটা কম হলেও উর্ধ্বমুখী গোলাপের দাম। মাত্র কয়েকদিন আগেও যে গোলাপ বিক্রি হয়েছে ৩ থেকে ৫ টাকায়। সেই গোলাপ এখন বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকা দরে। চাষিদের দাবি, বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে বাড়তে শুরু করেছে ফুলের দাম। সামনের দিনগুলোতে ফুলের দাম আরও বাড়বে এবং তারা লাভবান হবেন। একশ' পিচের আঁটি বেঁধে ১৩ আঁটি গোলাপ নিয়ে এসেছেন পানিসারার হাড়িয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল মান্নান। একটি সাইকেলের পিছনে বেঁধেই বিক্রির জন্য গদখালি বাজারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। বাজারে আসার পর ব্যাপারিরা দাম-দর করছেন। দাম পছন্দ না হওয়াতে গোলাপগুলো ছাড়লেন না তিনি। আব্দুল মান্নান জানান, 'এ বছর ফুলের তেমন দাম নেই। দুই বিঘা জমিতে গোলাপ চাষ করেছি। আজ বাজারে ১৩শ' পিচ ফুল এনেছি। এর মধ্যে ৭টাকা পিচ ধরে এক হাজার গোলাপ ৭ হাজারে বিক্রি করেছি। বাকী তিনশ' গোলাপ একটু কম বলছে, তাই দেইনি। এ বছর অতিবৃষ্টির কারণে ফুলে একটু লসে আছি। তবে আশা করছি সামনের অনুষ্ঠানগুলোতে ভালো দাম পেলে লাভবান হতে পারব।' জালাল হোসেন নামে অপর এক চাষি বলেন, '১৪ ফেব্রম্নয়ারি উপলক্ষে ফুলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। যে গোলাপ ৩ থেকে ৫ টাকা গত চার দিন আগে বিক্রি করেছি; সেই গোলাপ আজ ৭ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। জারবেরা বিক্রি করেছি ১০ থেকে ১৫ টাকা ও চন্দ্রমলিস্নকা দুই তিন টাকা পিস বিক্রি হচ্ছে। আশা করছি সামনের দিনগুলোতে আরও ভালো দাম পাব।' আকবর হোসেন নামে আরেক চাষি বলেন, 'প্রথম দিকে গোলাপের দাম বেশ কম পাচ্ছিলাম। ৭ ফেব্রম্নয়ারি থেকে দাম বাড়ছে। ক্ষেতে যে ফুল রয়েছে, তা আগামীতে ১৫-১৬ টাকা দরে বিক্রি হবে বলে আশা করছি।' গোলাপের দাম মূলত আকার, রঙ ও সৌন্দর্য্যের ওপর নির্ভর করে বলে তিনি জানান। গদখালীর টাওরা গ্রামের ফুলচাষি কামাল সরকার বলেন, 'আমার কাছে যে চায়না গোলাপ রয়েছে, তার দাম প্রতি পিস ২৫ টাকা। দেখতে সুন্দর ও বেশ কয়েক দিন রাখা যায় বলেই এর দাম বেশি। ২৫ কাঠা জমিতে রয়েছে চায়না গোলাপ। আশা করছি ১৪ ফেব্রম্নয়ারিকে সামনে রেখে ৩০ টাকার বেশি দাম পাবো এই গোলাপের।' এদিকে, বসন্তবরণ ও ভালোবাসা দিবসে গোলাপ ফুলের চাহিদা বৃদ্ধি পায় কয়েকগুণ। ফুল চাষিরা এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে গোলাপ ফুল বিক্রি করে বাড়তি টাকা রোজগার করেন। তবে মাঘেও শীত নেই। অনুভূত হচ্ছে গরম। এই গরমে ফুল সময়ের আগেই ফুটে যাচ্ছে। তাই দ্রম্নত ফুল কেটে ফেলতে হচ্ছে। ক্ষতির মুখে পড়েছেন ফুলচাষিরা। এমন পরিস্থিতিতে ফুল চাষিরা তাদের ফুল সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করছেন ক্যাপ। যাতে আগাম ফুল ঝরে না পড়ে সেজন্য ফুলের কলি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ পড়িয়ে দিচ্ছেন। আগামি ১২ ফেব্রয়ারি সকাল থেকেই ফুল কাটা হবে। কিছু ফুল কাটা হবে বসন্তের দিন সকালে। আগাম ফুল কেটে রাখলে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এর চাহিদা যেমন থাকে না, তেমনি দামও পাওয়া যায় না। এজন্য যেন কলি না ফোটে এবং পাতা ঝরে না পড়ে সেজন্য তারা কলিতে ক্যাপ পরিয়ে দেয়া হচ্ছে। পানিসারা এলাকার নীলকন্ঠ নগরের ফুলচাষি ইব্রাহিম খলিল বলেন, 'আড়াই বিঘা জমিতে গোলাপ চাষ করেছি। ফুল ফুটেছে অনেক। তবে এখন ফুল কাটলে দাম বেশি পাবো না। তাই ফুলের কলিতে ক্যাপ পরিয়ে রাখছি। তিনি বলেন, আগে আমরা রাবার দিয়ে কলি বেঁধে রাখতাম। এতে করে ফুলের পাতা নষ্ট হয়ে যেত। এ কারণে ক্যাপ পদ্ধতি ব্যবহার করছি। বিক্রি করার আগ পর্যন্ত কলিতে ক্যাপ পরানো থাকে। এতে ফুলের পাতা যেমন ঝরে পড়ে না, তেমনি ফুল নষ্টও হয় না। গত কয়েক বছর বছর ধরে এই এলাকার চাষিরা এভাবে ফুলের কলিতে ক্যাপ পরিয়ে রাখছেন বলে জানান। ফুল উৎপাদক ও বিপণন সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, 'চলতি মৌসুমে ফুলের উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আসন্ন তিনটি বিশেষ দিবস ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা। কোন দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক কোনো প্রভাব না পড়লে অন্তত শত কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে বলে আশাবাদী তারা। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, যশোরে প্রায় ৬০০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয় এবং এ ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লক্ষাধিক মানুষ জড়িত। আসন্ন বসন্ত, ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে ব্যাপক ফুল বিক্রি হলে চাষিদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন। এদিকে, ঝিনাইদহ মাঠের ফুলক্ষেতের ছোট-বড় গাছে ফুটে আছে গোলাপের কুড়ি। কয়েকদিন আগে মাটি কুপিয়ে দেওয়া হয়েছে সার, এখন গাছের গোড়া বেঁধে দেওয়া হবে পানি সেচ। পুষ্ট হলেই ক্ষেত থেকে তুলে তা বিক্রি করা যাবে। রাতদিন গোলাপ পরিচর্যা করছেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না গ্রামের কৃষক মেহেদী হাসান রাজু। তিনি জানালেন, ২৫ শতাংশ জমিতে গোলাপের গাছ রয়েছে। এ থেকে পহেলা ফাল্গুন ভালবাসার দিবস ও একুশে ফেব্রম্নয়ারি ঘিরে অন্তত ২০-৩০ টাকা পিস দরে ৫ হাজার গোলাপের স্টিক বিক্রি করতে পারবো আশা করছি। গোলাপি ও হলুদ কালারের গোলাপ রয়েছে। প্রতিবছর বসন্ত ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বরণ করতে উন্মুখ থাকে তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সী মানুষ। ফুলছাড়া এ দিনটি যেন একেবারেই চলে না। ফলে অন্য সময়ের থেকে এ দিনগুলি এলে ফুলের চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুণে। ব্যস্ততা বেড়ে যায় ফুলচাষী ও ব্যবসায়ীদের। অতিরিক্ত চাহিদার কারণে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে ঝিনাইদহের দুইটি বড় ফুল বাজারে। জেলার বড় ফুলের পাইকারী বাজার জেলা সদরের গান্না ও কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা। দুই ফুল বাজারে গিয়ে দেখা যায় পাইকারি একটি গোলাপ আকার ভেদে ১৮ থেকে ২৫ টাকা বিক্রি হয়েছে। এক থেকে দুই সপ্তাহ আগে একই গোলাপ বিক্রি হয়েছিল ১২ থেকে ১৭ টাকা। এছাড়া জারবেরা বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে ৬ টাকা। যা দুই সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছিল ২ থেকে ৩ টাকা। রজনীগন্ধার স্টীক বিক্রি হয়েছে ৩ থেকে ৪ টাকা টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছিল ১ থেকে ২ টাকায়। একই সময়ে গাদা ফুল বিক্রি হয়েছে ১২০ থেকে ২৫০ টাকা ধোপা। যে গাঁদাফুল দুই সপ্তাহ আগেও বিক্রি হয়েছিল ১০০ থেকে ১৫০ টাকা ধোপা। জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মাঠে মাঠে ফুটে আছে লাল, হলুদ ও কমলা রঙের জারবেরা। ফুটে আছে রং বে-রঙের গোলাপ, রজনীগন্ধা, গস্নাডিয়াস ও গাদা ফুল। ফুটে থাকা ফুলের রঙে স্বপ্ন রাঙ্গাতে ব্যস্ত সময় পার করছে জেলার ফুলচাষীরা। প্রতিবছর বসন্ত বরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রম্নয়ারি ও ২৬ মার্চ এলেই এ জেলার ফুলচাষি ও ফুলকর্মীদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বিভিন্ন জাতীয় উৎসবে এ এলাকায় উৎপাদিত ফুল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ফলে ফুলের বাড়তি চাহিদা মিটাতে ব্যস্ত সময় পার করে জেলার ফুলচাষীরা। ব্যবসায়ী ও কৃষকরা বলছেন, ঝিনাইদহে গাদা ফুলের পরিমাণ সব থেকে বেশী। দেশের গাদা ফুলের মোট চাহিদার ৬৫ শতাংশ পুরণ করে ভারতীয় সীমান্তবর্তি এ জেলার উৎপাদিত ফুল। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত জেলায় ৯২ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের ফুলের আবাদ হয়েছে। সাধারনত প্রতি ৩৩ শতাংশের এক বিঘা জমিতে মৌসুমে গোলাপ ক্ষেত পরিচর্যায় খরচ প্রায় এক লাখ টাকা আর গাদা ফুল পরিচর্যায় খরচ ৭০ হাজার টাকা। গেল ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে জেলায় গাদা ২৩২ হেক্টর, রজনীগন্ধা ৯৮ হেক্টর, গোলাপ ৩১ হেক্টর, জারবেরা ২০ হেক্টর, গস্নাডিওলাস ৮ হেক্টর, চন্দ্রমলিস্নকা ফুল ২ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছিল। জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের ত্রিলোচনপুর গ্রামের ফুলচাষী টিপু সুলতান জানান, ২০১৭ সালে ৫৫ লাখ টাকা খরচ করে ৫ বিঘা জমিতে জারবেরা ফুলের চাষ করেছিলাম। বর্তমানে প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে আমার ফুল চাষ রয়েছে। এরমধ্যে গোলাপ রয়েছে ৪ বিঘার মত। বিদেশি ফুল জারবেরা কাটার পরেও ১ সপ্তাহের বেশি সময় তাজা থাকে। ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর-এ-নবী বলেন, বর্তমানে দিনে তাপমাত্রা বেশী আর রাতে কম। এমন আবহাওয়াই ফুলে ছত্রাকের সংক্রমণের ঝুকি বেড়ে যায়। ফলে ৭ থেকে ১০ দিন পর পর রোগের ধরন অনুসারে ছত্রাক নাশক প্রয়োগ করলে এ জাতীয় রোগ থেকে ফুলকে রক্ষা করা সম্ভব। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ ষষ্টি চন্দ্র রায় বলেন, তিন দিবস ঘিরে যে সকল কৃষক ক্ষেতে ফুল প্রস্তুত করছেন। অবস্থা বুঝে পরিমিত মাত্রায় সেচ, জৈব সার ও কিছু ছত্রাক নাশক স্প্রে করতে হবে। এতে করে ফুলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। ক্ষেতের গাছ থেকে ফুল ছেড়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যেন ফুলে কোন ক্ষতের সৃষ্টি না হয়। এসব বিষয় মেনে চললে কৃষকরা ভালো দামে মানসম্মত ফুল বিক্রি করতে পারবেন। গ্রাহকরাও ভালো মানের ফুল পাবেন বলে যোগ করেন।