রাজধানীর যানজট নিরসন পরিকল্পনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলেও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতার কারণে রাজধানীর চারদিকে বৃত্তাকার সড়ক নির্মাণ নিয়ে জটিলতা কাটছে না। ২০২০ সালের ১২ মার্চ ঢাকা-ভাঙ্গা ও ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করা হয়। এক্সপ্রেসওয়েটিতে ফ্লাইওভার রয়েছে সব মিলিয়ে পাঁচটি। এগুলোর মধ্যে একটি হলো '?গাবতলী-বাবুবাজার-কদমতলী (কেরানীগঞ্জ) লিংক রোড' ফ্লাইওভার। প্রায় সাড়ে ৪ বছর ধরে ফ্লাইওভারটির কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া অংশ রাখা হয়েছে ঝুলন্ত অবস্থায়। কোনো সড়কের সঙ্গে সংযোগ না থাকায় গুরুত্বপূর্ণ এ ফ্লাইওভারের সিংহভাগ অংশে চলাচল করতে পারছে না যানবাহন। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্মাণকারী সংস্থার যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে ফ্লাইওভারটি। ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় এটির কাঠামোগত ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা।
পাঁচ বছর আগে 'গাবতলী-বাবুবাজার-কেরানীগঞ্জ' অংশের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা ও চূড়ান্ত নকশা করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। কিন্তু এর একাংশে রাস্তা নির্মাণ করতে চায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সংস্থাটি তাদের জমি ব্যবহারের অনুমতি না দেওয়ায় বৃত্তাকার সড়কের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। ৮৫ কিলোমিটার বৃত্তাকার সড়কের (ইনার সার্কুলার সড়ক) গাবতলী-বাবুবাজার-কেরানীগঞ্জ অংশের ১২ কিলোমিটার নির্মাণ সবচেয়ে জরুরি হলেও চার বছরের বেশি সময় ধরে কাজ বন্ধ রয়েছে। সড়কের অন্য অংশ নিয়ে সমন্বয়হীনতা আছে পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। বিভিন্ন সংস্থার রশি টানাটানিতে সব মিলিয়ে জগাখিচুড়ি অবস্থায় রয়েছে 'গাবতলী-বাবুবাজার-কেরানীগঞ্জ' ফ্লাইওভার।
সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ফ্লাইওভারটি শুরু ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে কেরানীগঞ্জ-বাবুবাজার সেতু এলাকা থেকে। কিন্তু ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে থেকে এসে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া বেগুনবাড়ি এলাকায় ঝুলন্ত অবস্থায় রেখে নির্মাণকাজ শেষ করে দেওয়া হয়েছে। কোনো সড়কের সঙ্গে এর সংযোগ নেই। চার লেনের বাবুবাজার-কেরানীগঞ্জ লিংক রোড ফ্লাইওভারটি দৈর্ঘ্যে ২ দশমিক ৩ কিলোমিটার। ফ্লাইওভারের নিচে নির্মাণ করা হয়েছে ছয় লেনের প্রশস্ত সড়ক। ফ্লাইওভারে ওঠার সুযোগ না থাকায় এ সড়ক দিয়েই চলছে যানবাহন। তবে সড়কটিতে পার্কিং, উল্টোপথে চলাচলের কারণে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলায় যানবাহন চলাচল করছে থেমে থেমে।
এ বিষয়ে চুনকুটিয়া চৌরাস্তা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা শামসুল হক বলেন, 'পদ্মাসেতু, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন হলেও প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে এ ঝুলন্ত অবস্থা দেখছি ফ্লাইওভার। নিচের সড়কে বিশৃঙ্খলার কারণে যানবাহন চলাচলে সমস্যা হলেও ফ্লাইওভারটি কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। নির্মাণকাজ শেষ করার পর কাউকে ফ্লাইওভারটির খোঁজখবর করতেও দেখিনি। দীর্ঘদিন ধরে অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকায় ফ্লাইওভারটির ওপরে সন্ধ্যার পর মাদকসেবীদের আখড়া পরিণত হয়েছে।
এদিকে ঢাকা-খুলনা (এন-৮) মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী ইন্টারসেকশন থেকে (ইকুরিয়া-বাবুবাজার লিংক সড়কসহ) মাওয়া পর্যন্ত এবং পাঁচ্চর-ভাঙ্গা অংশ ধীরগতির যানবাহনের জন্য পৃথক লেনসহ চার লেনে উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে তৈরি করা হয় এ ফ্লাইওভার। পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। ইনার সার্কুলার সড়ক প্রকল্প সূত্র
বলছে, ফ্লাইওভারটির জন্য দক্ষিণ সিটি করপোরেশন জমি দিতে রাজি না হওয়ায় গাবতলীতে ইন্টারচেঞ্জ এবং সেখান থেকে বছিলা পর্যন্ত ৪ দশমিক ২৬ কিলোমিটার অংশে দুই পাশে সার্ভিস লেনসহ চার লেনের সড়ক নির্মাণের প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে। এতে ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে।
রাজধানী থেকে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশ ও বের হওয়ার পথ দুটি। একটি যাত্রাবাড়ী-পোস্তগোলা সেতু দিয়ে। অন্যটি মালিটোলা হয়ে বাবুবাজার সেতু দিয়ে। বাবুবাজার সেতু পার হয়ে সহজেই এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য তৈরি করা হয় '?বাবুবাজার-কেরানীগঞ্জ লিংক রোড' ফ্লাইওভার। প্রায় সাড়ে চার বছর আগে উদ্বোধন হলেও সংযোগ না থাকায় এখনো ফ্লাইওভারটি কোনো কাজে লাগছে না।
এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অতিরিক্ত নির্বাহী প্রকৌশলী (ঢাকা জোন) একেএম আজাদ রহমান বলেন, 'ফ্লাইওভারটি আমরা ভবিষ্যতে সম্প্রসারণের জন্য রেখে দিয়েছি। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, ঢাকার গাবতলী থেকে এ ফ্লাইওভারের সংযোগ দেওয়া। সংযোগ দেয়ার জন্য সোয়ারীঘাটে একটি সেতু নির্মাণ করা হবে। এ সেতুর নকশা প্রণয়নের কাজ করা হচ্ছে। সোয়ারীঘাট সেতুর পর একটি ইন্টারচেঞ্জের মাধ্যমে গাবতলী পর্যন্ত ফ্লাইওভারটি সংযুক্ত করা হবে, যেন ঢাকা-আরিচা, বেড়িবাঁধ, মিরপুর সড়ক ব্যবহারকারীরা সহজেই ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশ করতে পারেন।'
তিনি বলেন, 'সম্প্রসারিত অংশটি দুই ভাগে বাস্তবায়ন করা হবে। গাবতলী থেকে মিরপুর এলাকা পর্যন্ত প্রায় ছয় কিলোমিটার অংশ বাস্তবায়ন করবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। অন্যদিকে লোহারপুল থেকে কেরানীগঞ্জ ফ্লাইওভার পর্যন্ত অংশটি সওজ অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করবে। এজন্য নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়েছে।'
সম্প্রসারিত অংশের কাজ সম্পন্ন করে বাবুবাজার-কেরানীগঞ্জ লিংক ফ্লাইওভারটি নির্মাণ করতে কতদিন সময় লাগব এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমরা এসব কাজ বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রকল্প তৈরি করছি। প্রকল্পটি এখনো অনুমোদিত হয়নি। সার্কুলার সড়কের পশ্চিমাংশ নির্মাণে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) ঋণ চাওয়া হয়েছিল। তবে চীনের ব্যাংকটি আগ্রহ দেখিয়েও সরে গেছে বলে জানা যায়। যানজট নিরসন পরিকল্পনায় ঘুরপাক খাওয়ার আরেকটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকার পতন। এতে ফ্লাইওভার বাস্তবায়নে জটিলতা বেড়েছে।'
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান জানান, পূর্ব পরিকল্পনা না করে 'বাবুবাজার-কেরানীগঞ্জ' এ ফ্লাইওভারটি তৈরি করা হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, এ ফ্লাইওভারটি গাবতলীর সঙ্গে যুক্ত করা হবে। কিন্তু এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভূমি অধিগ্রহণসহ নতুন করে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। যেহেতু ফ্লাইওভারটি ব্যবহৃত হচ্ছে না, সেহেতু ধরেই নেয়া যায় সেটি রক্ষণাবেক্ষণও হচ্ছে না, যা ভবিষ্যতে ফ্লাইওভারটির জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।'
তিনি জানান, 'আরএসটিপির অগ্রাধিকারের প্রকল্প ইনার সার্কুলার রুট। প্রস্তাবিত আটটি রেডিয়াল সড়কের একটি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। 'ফরোয়ার্ড লিঙ্ক' হিসেবে এ সড়ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু 'ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্ক' হিসেবে ইনার সার্কুলার সড়ক তৈরি হয়নি। সমন্বিত পরিকল্পনা মাধ্যমে এই ফ্লাইওভারটির কাজ দ্রম্নত বাস্তবায়ন জরুরি।